মঙ্গলবার, ০৩ মে, ২০১৬, ০৪:৩৮:২৩

আল্লাহর সাথে গভীর ও প্রেমময় সম্পর্কের চাবিকাঠি হলো নামাজ (১৪তম পর্ব)

আল্লাহর সাথে গভীর ও প্রেমময় সম্পর্কের চাবিকাঠি হলো নামাজ (১৪তম পর্ব)

ইসলাম ডেস্ক : প্রিয় পাঠক! নামাজের বিশ্লেষণমূলক ধারাবাহিক এই আলোচনায় আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। নামাজ, আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায়-শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার আজকের আসর থেকে আপনাদের জানাচ্ছি ইসলামী ভ্রাতৃত্ব, ভালোবাসা ও কল্যাণকামীতার অফুরন্ত দোয়ার প্রতীক তথা সহমর্মী হৃদয়ের প্রথম সম্ভাষণ ও উচ্চারণ হিসেবে পরিচিত সালাম এবং অশেষ উষ্ণ শুভেচ্ছা। আর সবার জন্য দয়াময় ও মহান আল্লাহর কাছে কামনা করছি রহমত ও বরকতের অশেষ ফল্গুধারায় সিক্ত আসন্ন পবিত্র রজব মাসের সমস্ত কল্যাণ।

নামাজ মুমিনের জন্য মেরাজস্বরূপ। যথাযথ নিয়ম মেনে ও আদব সহকারে যদি নামাজ আদায় করা যায় তাহলে মানুষের সমস্ত সৎগুণ নামাজীর মধ্যে বিকশিত হবেই। একজন প্রকৃত নামাজী কখনো কোনো অসম্মান নিজের জন্য ও কোনো মানুষের জন্য মেনে নিতে পারেন না। নামাজ ও দোয়া মানুষের মন এবং শরীরে বিস্ময়কর প্রভাব ফেলে। মানুষের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক চেতনা জোরদার করে এই নামাজ। নামাজ ও দোয়ায় অভ্যস্ত ব্যক্তির চেহারার দিকে তাকালে দেখা যায় তার মধ্যে হিংসা ও মন্দ কাজের ছাপের পরিবর্তে সততার আলোকোজ্জ্বোল আভা ফুটে উঠেছে। এ ধরনের মানুষ যে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে খুবই সচেতন এবং তারা যে অন্যদের কল্যাণকামী তা-ও তাদের সৌম্য, প্রশান্ত ও পবিত্রতায় প্রদীপ্ত উজ্জ্বল চেহারাই বলে দেয়। এ ধরনের মানুষ তথা নামাজী হন নির্মল মনের অধিকারী, আচরণে বিনয়ী, প্রশান্ত-চিত্ত, ভয়-ভাবনাহীন প্রফুল্ল বা ফুরফুরে মেজাজসম্পন্ন, প্রবল আত্মবিশ্বাসী, সত্য ও সুপরামর্শ মেনে নিতে সদা প্রস্তুত এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, ঈমানদার ব্যক্তি হাস্য-রসিক হন এবং মুমিনের মুখে মুচকি হাসি লেগে থাকে। ফার্সী প্রবাদে বলা হয়, খান্দেহ বর হার দারদে বি-দারমান দাওয়াস্ত। অর্থাৎ চিকিৎসার অযোগ্য সমস্ত রোগের ওষুধ হল হাসি।

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণায় দেখা গেছে, জীবন সম্পর্কে হতাশ ব্যক্তির চেয়ে হাসি-খুশি বা প্রফুল্ল মেজাজের মানুষের আচরণ বেশী সুন্দর। এ ধরনের মানুষ খুব কমই মানসিক ও শারীরিক রোগে ভোগেন। তাই মানুষের জন্য আনন্দদায়ক সব পদক্ষেপই শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য সহায়ক। আবার অনেক সময় মানুষের শরীরের রাসায়নিক উপাদানের পরিবর্তন তাকে বিষন্ন বা প্রফুল্ল করে। যেমন, অনেক মানুষ সকালের দিকে কোনো কারণ ছাড়াই অনিচ্ছাকৃতভাবে খিটমিটে বা ক্রুদ্ধ হয়ে থাকেন রক্তে রাসায়নিক পরিবর্তনের কারণে। কর্টিসল নামের একটি রাসায়নিক উপাদান শরীরে প্রয়োগ করা হলে মানুষ হাসি-খুশি হয়ে ওঠে। খুব ভোরের দিকে মানুষের শরীরে এই রাসায়নিক উপাদান বা হরমোন বৃদ্ধি পায়।

আর এ সময় যদি মানুষ জেগে থাকে তাহলে সে বিশেষ আনন্দ ও প্রফুল্লতা উপভোগ করতে পারে। আর এই বাড়তি আনন্দ সারাদিন তার সৃষ্টিশীলতায় ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। আর এ জন্যেই যারা খুব ভোরে বা গভীর রাতে নামাজ ও প্রার্থনায় মশগুল হন তারা সবচেয়ে শিহরণ-জাগানো মানসিক আনন্দ উপভোগ করেন বলে মনোস্তাত্ত্বিকরা মনে করেন। অনাবিল আত্মিক ও মানসিক প্রশান্তি অর্জনের মোক্ষম পন্থা হল নৈশকালীন ইবাদত। অবশ্য নামাজ, তা যে সময়েই আদায় করা হোক না কেন, সব সময়ই আধ্যাত্মিক ও খোদাপ্রেমের অতুলনীয় আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং তা মানুষের মনকে করে বিকশিত, প্রাণবন্ত ও সজীব।

বিশ্ববরেণ্য ইরানী কবি হাফেজ তার এক কবিতায় লিখেছেন,
খোদা হাফেজকে দিয়েছেন সৌভাগ্যের যত খনি এ জগতে
পেয়েছি তা নৈশ-বন্দেগী ও প্রভাতের সদা-পাঠ্য বাণীর বরকতে ।

আজকাল মনোস্তাত্ত্বিকরা বলছেন, খুব ভোরে ঘুম থেকে জাগা ও নামাজসহ বিভিন্ন এবাদত-বন্দেগীতে মশগুল হওয়া মানুষের শারীরিক সুস্থতাসহ মানসিক প্রফুল্লতার জন্য সহায়ক। ফলে ভোরের নামাজ ও এবাদত মানুষকে বিষন্নতা থেকে রক্ষা করে। বিষন্নতায় ভুগছেন এমন রোগীদের শতকরা ৭৫ ভাগই সকালের ঘুমের মধ্যে বিভিন্ন সমস্যায় ভুগেন এবং বিষন্নতার উপসর্গগুলো সকালের দিকেই তীব্রতর হয়। তাই মনোস্তাত্ত্বিকরা খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা ও এবাদত করাকে বিষন্নতা দূর করার মোক্ষম উপায় বলে মনে করছেন।
 
পবিত্র কোরআনে পাকেও ভোররাতের দোয়া এবং নামাজের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ সময়ের এবাদত মানুষের মানসিক বোঝাকে হাল্কা করে এবং দূর করে মানসিক জটিলতা ও বিষন্নতা বা হতাশা। ভোরবেলায় খোদাপ্রেমের আকুতিতে টুইটুম্বর এবাদতের মাধ্যমে অর্জিত আল্লাহর সান্নিধ্যের পরশ মানুষের তৃষ্নার্ত আত্মাকে জোগায় প্রশান্তির মদিরা। ফলে মনের নড়বড়ে ভাব দূর হয়ে যায় এবং আল্লাহর ওপর একান্ত নির্ভরতায় পরিপূর্ণ দৃঢ়-মনোবল নিয়ে সে শুরু করে এক নতুন দিন। আর এ জন্যই আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ) বলেছেন, "আল্লাহ যখন বান্দার কল্যাণ চান তখন তাকে স্বল্প আহার, স্বল্প ঘুম ও কম পরিমাণে কথা বলার গুণে বিভূষিত করেন। "

রবিয়া বিন কা'ব ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র বিশিষ্ট সাহাবী। তিনি বহু বছর রাসূল (সাঃ)'র পাশে ছিলেন এবং বিভিন্ন যুদ্ধেও তাঁর সাথী ছিলেন। এ কারণে মুশরিকদের নানা অত্যাচার ও যন্ত্রণা তাকে সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু তিনি কখনো বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র কাছে কিছু চান নি। একদিন মহানবী (সাঃ) তাকে বললেন, হে রবিয়! তুমি ৭ বছর ধরে আমার সাথে ছিলে এবং আমার কাছে কিছুই চাও নি। তুমি কি আমার কাছে কিছুই চাইবে না? উত্তরে মাথা নিচু করে তিনি বললেন, হে রাসূল আমাকে এ ব্যাপারে ভাবনার সময় দিন।

ঘরে ফিরে অনেক কথা মনে হলো রবিয়ার। অর্থনৈতিক সংকট দূর করার কথা কিংবা কখনো অসুস্থ না হবার আশার কথা। তার একজন ঘনিষ্ঠ লোক বড় কোনো পদ চাওয়ার পরামর্শ দিল তাকে। কিন্তু রাসূল (সাঃ)'র কাছে ফিরে এসে রবিয়া বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করুন যেন আমি আপনার সাথে বেহেশতে যেতে পারি।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাকে বললেন, কেউ কি তোমাকে এ বিষয়টি শিখিয়ে দিয়েছে? উত্তরে রবিয়া বললেন, না, আমি নিজেই ভেবেছি যে সম্পদ তো চিরস্থায়ী নয়, দীর্ঘ হায়াত বা জীবন ও পদ-এসবও একদিন শেষ হয়ে যাবে। বিশ্বনবী (সাঃ) রবিয়ার প্রশংসা করে বললেন, আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করবো যাতে তোমাকে আমার সাথে বেহেশতে যেতে দেয়া হয়, তবে তুমিও অত্যধিক নামাজ ও সিজদার মাধ্যমে এই আশা পূরণের ব্যাপারে আমাকে সহায়তা কর।
 
রবিয়া বিন কা'ব খুব খুশী হলেন। তিনি একনিষ্ঠ মনে ও আল্লাহর প্রতি গভীর অনুরাগ নিয়ে বেশী বেশী নামাজ আদায় করতে লাগলেন। তিনি বুঝতে পারলেন সৌভাগ্য ও সুপথ এবং আল্লাহর সাথে গভীর ও প্রেমময় সম্পর্কের চাবিকাঠি হলো নামাজ ও প্রার্থনা।
৩ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে