শুক্রবার, ২৪ জুন, ২০১৬, ০৫:২১:১৩

বিপদে ধৈর্য ধারণ করা সওয়াবের কাজ

বিপদে ধৈর্য ধারণ করা সওয়াবের কাজ

ইসলাম ডেস্ক : পবিত্র কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, মানুষ কি মনে করে যে, আমরা ইমান এনেছি বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে, আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না? আর আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদের পরীক্ষা করেছি। ফলে আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন, কারা সত্য বলে এবং অবশ্যই তিনি জেনে নেবেন, কারা মিথ্যাবাদী। সূরা আনকাবুত : ২-৩ আল্লাহ তায়ালার কুদরত অসীম। তিনি মানুষকে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের বিপদ ও মুসিবত দ্বারা পরীক্ষা করে থাকেন। এটা সৃষ্টির সূচনা থেকেই চলে আসছে। আলোচ্য আয়াত তারই ইঙ্গিত বহন করছে। কিন্তু আমরা এই পরীক্ষার গূঢ় রহস্য সম্পর্কে কেউ জানি না, একমাত্র তিনিই ভালো জানেন। তবে আলেমরা বলে থাকেন, এর মাধ্যমে তিনি বান্দাদের সত্যিকারের তওবার সুযোগ করে দেন, পাপমোচন করে থাকেন ইত্যাদি। তাই বিপদ ও মুসিবতের সময় মুমিনদের কর্তব্য হলো- ধৈর্যধারণ করা ও আল্লাহ তায়ালার সিদ্ধান্তে সন্তুষ্টি প্রকাশ করা।

ধৈর্যের প্রকারভেদ :
ধৈর্য ৫ প্রকার যথা [১] ওয়াজিব ধৈর্য [৩] মুস্তাহাব ধৈর্য [৪] মুবাহ ধৈর্য [৪] মাকরুহ ধৈর্য [ঙ] হারাম ধৈর্য। উল্লেখিত ধৈর্য সমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে উল্লেখ করা হল :

[ক] ওয়াজিব ধৈর্য : প্রথমত: জীবনের জন্য কঠিন ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও আল্লাহর হুকুম পালনে অবিচল থাকার ধৈর্য প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ওয়াজিব। দ্বিতীয়ত: মনের শত চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ হতে বিরত থাকার ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করা। তৃতীয়ত : দ্বীনের পথে সংগ্রাম করতে গিয়ে আপতিত সকল প্রকার মুছিবতে ধৈর্য ধরা। চতুর্থত: পার্থিব জীবনে যত রকম মুছিবত আসবে তা মোকাবেলার ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করা।

[খ] মুস্তাহাব ধৈর্য : বৈধ কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করা। অর্থাৎ শরিয়তে যে সকল কাজ ফরজ নয় অথচ বৈধ এবং অত্যন্ত সওয়াবের ঐ সকল কাজ সম্পাদনে ধৈর্য ধরা মুস্তাহাব। যেমন গভীর রজনীতে ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া। সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর যিকির করা। মানুষের বিপদে নিজেকে স¤পৃক্ত করে প্রতিনিয়ত মানব কল্যাণে কাজ করা ইত্যাদি।

[গ] মুবাহ ধৈর্য : কোন দায়িত্বশীল কাউকে কোন বৈধ কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব দিলে ঐ কাজ সম্পাদন না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্বশীলের ধৈর্য ধারণ করা মুবাহ। এছাড়া কেউ যদি কোন ব্যক্তিকে সংশোধনের জন্য কোন পাপ কাজ পরিহারের এবং ভাল কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব প্রদান করে সে ক্ষেত্রে ঐ কাজ সম্পাদনে যে পরিমাণ সময়ের প্রয়োজন ঐ সময় পর্যন্ত দায়িত্ব প্রদানকারী ব্যক্তির ধৈর্য ধারণ করা মুবাহ।

[ঘ] মাকরুহ ধৈর্য : যে সকল বৈধ কাজ সময় মত সম্পাদন না করলে শারীরিক বা আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। ঐ সকল ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরা মাকরুহ। যেমন সময় মত খাদ্য-পানীয় গ্রহণ না করলে শরীরের ক্ষতি হয়। এ ক্ষেত্রে কোন যুক্তিযুক্ত কারণ ব্যতীত ধৈর্য ধরা মাকরুহ। রাসূল [সা.] বলেছেন “তোমরা সব কাজ ধৈর্যের সাথে [আস্তে-ধীরে] করবে- তবে ৫টি কাজ তাড়াতাড়ি করবে- প্রথমত : মেয়ে সাবালিকা হলে তাড়াতাড়ি বিবাহ দিবে, দ্বিতীয়ত কেউ মারা গেলে দ্রুত দাফন-কাফন শেষ করবে, তৃতীয়ত : মেহমান আসলে কারো অপেক্ষায় বসিয়ে না রেখে তাড়াতাড়ি খাবার দিবে, চতুর্থত : ঋণ থাকলে তাড়াতাড়ি পরিশোধ করবে, পঞ্চমত: গুনাহ করলে দ্রুত তওবা করবে।”

[ঙ] হারাম ধৈর্য : সকল প্রকার নিষিদ্ধ কাজ সম্পাদনে ধৈর্য ধারণ নিষিদ্ধ। সহজ কথায় হারাম কাজ সম্পাদনে ধৈর্য ধারণ করা হারাম। এছাড়া এমন কিছু বিষয় রয়েছে যেখানে সবর করলে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটতে পারে। যেমন- কোন স্থানে আর অপেক্ষার প্রয়োজন নেই- বরং অপেক্ষা করলে হিংস্র প্রাণী বা চোর ডাকাত দ্বারা জান-মালের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে ঐ স্থানে ধৈর্য ধারণ করে অপেক্ষা করা সম্পূর্ণ হারাম।

বড় মুসিবতের সঙ্গে বড় প্রতিদান
এ প্রসঙ্গে হজরত রাসুলুল্লাহ [সা.] বলেছেন, বড় মুসিবতের সঙ্গে প্রতিদান বড়ই প্রদান করা হয়। আর আল্লাহ যখন কোনো গোত্রকে ভালোবাসেন, তিনি তাদের পরীক্ষা করেন। যে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে, তার জন্য সন্তুষ্টি, আর যে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে, তার জন্য অসন্তুষ্টি। তিরমিজি বিপদ ও মুসিবত প্রসঙ্গে কোরানে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, আর আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জানমাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। যারা, তাদের যখন বিপদ আক্রান্ত করে তখন বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তার দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। [সুরা বাকারা : ১৫৫-১৫৬]

আমাদের উচিত জীবনের ভালো-মন্দ সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে এ কথার দৃঢ় বিশ্বাস করা। এ বিশ্বাস ইমানের অংশ বিশেষও বটে। ইতিহাসে আছে, অনেক নবি-রাসুলকে আল্লাহ তায়ালা বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করেছেন। এটা তকদিরেরই অংশ। তাই এর ওপর ধৈর্যধারণ করে সন্তুষ্টি প্রকাশ করা ইমানের দাবি। অধিকন্তু এটা ইমানের ছয়টি রুকনেরও অন্তর্ভুক্ত। যেমন হাদিসে জিবরিলে এসেছে, ইমান হচ্ছে তোমার বিশ্বাস স্থাপন করা আল্লাহর ওপর, তার ফেরেশতাদের ওপর, তার কিতাবগুলোর ওপর, তার রাসুলদের ওপর, কিয়ামত দিবসের ওপর এবং বিশ্বাস স্থাপন করা ভালো-মন্দ তকদিরের ওপর। [মুসলিম]

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যুগে যুগে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বার বার তার প্রিয় বান্দাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছেন। সীমাহীন বিপদে আচ্ছন্ন রেখে তাদের ধৈর্যকে আরও মজবুত করেছেন। ইয়াকুব আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় সন্তান ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হারিয়ে যখন শোকে বিহ্বল, তখনও তিনি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশ মতোই ধৈর্যের শরণাপন্ন হন। তিনি তার দুঃখ-কষ্ট যা ছিল তা আল্লাহর দরবারে পেশ করেন এবং বলেন, সে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহই আমার সাহায্যস্থল। [সূরা ইউসুফ : ১৮]।

আনাস বিন মালিক [রা.] থেকে বর্ণিত, রাসূল [সা.] বলেন, 'আল্লাহ তায়ালা যখন তাঁর কোনো বান্দার মঙ্গল করতে চান, তখন দুনিয়াতেই তার [অপরাধের] শাস্তি দিয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে তিনি যখন তাঁর কোনো বান্দার অমঙ্গল করতে চান, তখন দুনিয়াতে তার পাপের শাস্তি দেয়া থেকে বিরত থাকেন, যেন কেয়ামতের দিন তাকে পূর্ণরূপে শাস্তি দেন।' [তিরমিজি]।

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া [রহ.] বলেন, মুসিবত [বিপদাপদ] এক ধরনের নেয়ামত। কেননা এগুলো মানুষের গোনাহের কাফফারাস্বরূপ। মুসিবত মানুষকে সবরের শিক্ষা দেয়। বান্দা যদি মুসিবতে পড়ে সবর করে, তাহলে এর বিনিময়ে তাকে সওয়াব প্রদান করা হয়। সেই সঙ্গে বিপদাপদ ও মুসিবতের কারণে বান্দারা আল্লাহ তায়ালার দিকে ফিরে আসে, আল্লাহর সামনে নত হয় এবং মাখলুকের [সৃষ্টির] কাছে নিজের প্রয়োজন পেশ করা থেকে বিরত থাকে। মুসিবতে পতিত বান্দার জন্য আরও অনেক দ্বীনি স্বার্থ হাসিল হয়। মূলত মুসিবতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বান্দার গোনাহ মিটিয়ে দেন। সুতরাং এটি বান্দার জন্য এক বিরাট নেয়ামত। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল [রহ.] বলেন, আল্লাহ তায়ালা স্বীয় কিতাব কোরআনে ৯০ বার সবরের [ধৈর্যের] উল্লেখ করেছেন।

বিপদে ধৈর্যধারণ : দশটি উপদেশ
১. যে কোন পরিস্থিতি মেনে নেয়ার মানসিকতা লালন করা : প্রত্যেকের প্রয়োজন মুসিবত আসার পূর্বেই নিজকে মুসিবত সহনীয় করে তোলা, অনুশীলন করা ও নিজেকে শোধরে নেয়া। কারণ ধৈর্য কষ্টসাধ্য জিনিস, যার জন্য পরিশ্রম অপরিহার্য। স্মর্তব্য যে, দুনিয়া অনিত্য, ভঙ্গুর ও ক্ষণস্থায়ী। এতে কোনো প্রাণীর স্থায়িত্ব বলে কিছু নেই। আছে শুধু ক্ষয়িষ্ণু এক মেয়াদ, সিমীত সামর্থ। এ ছাড়া আর কিছুই নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পার্থিব জীবনের উদাহরণে বলেন, “পার্থিব জীবন ঐ পথিকের ন্যায়, যে গ্রীষ্মে রৌদ্রজ্জ্বল তাপদগ্ধ দিনে যাত্রা আরম্ভ করল, অতঃপর দিনের ক্লান্তময় কিছু সময় একটি গাছের নীচে বিশ্রাম নিল, ক্ষণিক পরেই তা ত্যাগ করে পুনরায় যাত্রা আরম্ভ করল।” হে মুসলিম! দুনিয়ার সচ্ছলতার দ্বারা ধোঁকা খেওনা, মনে করো না, দুনিয়া স্বীয় অবস্থায় আবহমানকাল বিদ্যমান থাকবে কিংবা পট পরিবর্তন বা উত্থান-পতন থেকে নিরাপদ রবে। অবশ্য যে দুনিয়াকে চিনেছে, এর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছে, তার নিকট দুনিয়ার সচ্ছলতা মূল্যহীন।

২. তাকদিরের উপর ঈমান : যে ব্যক্তি মনে করবে তাকদির অপরিহার্য বাস্তবতা এবং তা অপরিবর্তনীয়। পক্ষান্তরে দুনিয়া সংকটময় ও পরিবর্তনশীল, তার আত্মা প্রশান্তি লাভ করবে। দুনিয়ার উত্থান-পতন সুখ-দুঃখ স্বাভাবিক ও নগন্য মনে হবে তার কাছে। আমরা দেখতে পাই, তাকদিরে বিশ্বাসী মুমিনগণ পার্থিব মুসিবতে সবচে’ কম প্রতিক্রিয়াশীল, কম অস্থির ও কম হতাশাগ্রস্ত হন। বলা যায় তাকদিরের প্রতি ঈমান শান্তি ও নিরাপত্তার ঠিকানা। তাকদির-ই আল্লাহর কুদরতে মোমিনদের হৃদয়-আত্মা নৈরাশ্য ও হতাশা মুক্ত রাখে। তদুপরি চিরসত্যবাদী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসে বিশ্বাস তো আছেই, জেনে রেখ, সমস্ত মানুষ জড়ো হয়ে যদি তোমার উপকার করতে চায়, কোনও উপকার করতে পারবে না, তবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। আবার তারা সকলে মিলে যদি তোমার ক্ষতি করতে চায়, কোনও ক্ষতি করতে পারবে না, তবে যততুটু আল্লাহ তোমার কপালে লিখে রেখেছেন। কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে, কিতাব শুকিয়ে গেছে।”

৩. রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আদর্শ পূর্বসূরীদের জীবন চরিত পর্যালোচনা : পরকালে বিশ্বাসী আল্লাহ ভীরু গোটা মুসলিম জাতির আদর্শ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আল্লাহ তাআলা বলেন, “অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত চিন্তাশীল, গবেষকদের উপজীব্য ও শান্তনার বস্তু। তার পূর্ণ জীবনটাই ধৈর্য ও ত্যাগের দীপ্ত উপমা। লক্ষ্য করুন, সল্প সময়ে মধ্যে চাচা আবু তালিব, যিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কাফেরদের অত্যাচার প্রতিহত করতেন; একমাত্র বিশ্বস্ত সহধর্মিনী খাদিজা; কয়েকজন ঔরসজাত মেয়ে এবং ছেলে ইব্রাহিম ইন্তেকাল করেন। চক্ষুযুগল অশ্রসিক্ত, হৃদয় ভারাক্রান্ত, স্মায়ুতন্ত্র ও অস্থিমজ্জা নিশ্চল নির্বাক। এর পরেও প্রভুর ভক্তিমাখা উক্তি, “চোখ অশ্রুসিক্ত, অন্তর ব্যথিত, তবুও তা-ই মুখে উচ্চারণ করব, যাতে প্রভু সন্তুষ্ট, হে ইব্রাহিম! তোমার বিরহে আমরা গভীর মর্মাহত।”

৪. আল্লাহর রহমতের প্রসস্ততা ও করুণার ব্যাপকতার স্মরণ : সত্যিকার মুমিন আপন প্রভুর প্রতি সুধারণা পোষণ করে। হাদিসে কুদসিতে আছে, আল্লাহ তাআলা বলেন, “আমার ব্যাপারে আমার বান্দার ধারণা অনুযায়ী, আমি ব্যবহার করি।” মুসিবত দৃশ্যত অসহ্য-কষ্টদায়ক হলেও পশ্চাতে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। তাই বান্দার কর্তব্য আল্লাহর সুপ্রসস্ত রহমতের উপর আস্থাবান থাকা।

ইরশাদ হচ্ছে, “এবং হতে পারে কোন বিষয় তোমরা অপছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হতে পারে কোন বিষয় তোমরা পছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “মোমিনের বিষয়টি চমৎকার, আল্লাহ তাআলা যা ফয়সালা করেন, তা-ই তার জন্য কল্যাণকর।” আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে যে সমস্ত নেয়ামত ও অনুদান দ্বারা আবৃত করেছেন, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা, যাতে এ অনুভূতির উদয় হয় যে, বর্তমান মুসিবত বিদ্যমান নেয়ামতের তুলনায় বিন্দুমাত্র। আল্লাহ তাআলা চাইলে মুসিবত আরো বীভৎস-কঠোর হতে পারত। তদুপরি আল্লাহ তাআলা আরো যে সমস্ত বালা মুসিবত থেকে নিরাপদ রেখেছেন, যে সকল দুর্ঘটনা থেকে নাজাত দিয়েছেন, তা অনেক বড়, অনেক বেশী।

৫. অধিকতর বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিদের দেখা : অন্যান্য বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিদের দেখা, তাদের মুসিবতে স্মরণ করা। বরং অধিকতর বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির দিকে নজর দেয়া। এতে সান্ত্বনা লাভ হয়, দুঃখ দূর হয়, মুসিবত হয় সহনীয়। হ্রাস পায় অস্থিরতা ও নৈরাশ্যতা। জেনে রাখা ভাল, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “ধৈর্য অসম্ভব বা অসাধ্য কিছু নয়, যে র্ধৈয্যধারণ করে আল্লাহ তাকে ধৈর্য্যধারণের ক্ষমতা দান করেন।” বিকলাঙ্গ বা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি, তার চেয়ে কঠিন বিপদগ্রস্তকে দেখবে। একজনের বিরহ বেদানায় ব্যথিত ব্যক্তি, দুই বা ততোধিক বিরহে ব্যথিত ব্যক্তিকে দেখবে। এক সস্তানহারা ব্যক্তি, অধিক সন্তানহারা ব্যক্তিকে দেখবে। সব সন্তানহারা ব্যক্তি, পরিবারহারা ব্যক্তিকে দেখবে। এক ছেলের মৃত্যু শোকে শোকাহত দম্পত্তি স্মরণ করবে নিরুদ্দেশ সন্তান শোকে কাতর দম্পত্তিকে- যারা স্বীয় সন্তান সর্ম্পকে কিছুই জানে না যে, জীবিত না মৃত। ইয়াকুব আলাইহিস সালাম ইউসুফ আ.-কে হারিয়ে অনেক বছর যাবৎ পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে রাখেন। বৃদ্ধ ও দুর্বল হওয়ার পর আবার দ্বিতীয় সন্তান হারান। প্রথম সন্তান হারিয়ে বলেছিলেন, “সুতরাং [আমার করণীয় হচ্ছে] সুন্দর ধৈর্য। আর তোমরা যা বর্ণনা করছ সে বিষয়ে আল্লাহই সাহায্যস্থল।” দ্বিতীয় সন্তান হারিয়ে বলেন, “সে বলল, ‘বরং তোমাদের নাফ্‌স তোমাদের জন্য একটি গল্প সাজিয়েছে, সুতরাং [আমার করণীয় হচ্ছে] সুন্দর ধৈর্য। আশা করি, আল্লাহ তাদের সকলকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনবেন, নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।”

৬. মুসিবত পুণ্যবাণ হওয়ার আলামত : মুসিবত পুণ্যবাণ হওয়ার আলামত, মহত্বের প্রমাণ। এটাই বাস্তবতা। একদা সাহাবী সাদ বিন ওয়াক্কাস রা. রসূল সা.কে জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রসূল, দুনিয়াতে সবচেয়ে বেশি বিপদগ্রস্ত কে? উত্তরে তিনি বলেন, “নবীগণ, অতঃপর যারা তাদের সাথে কাজ-কর্ম-বিশ্বাসে সামঞ্জস্যতা রাখে, অতঃপর যারা তাদের অনুসারীদের সাথে সামঞ্জস্যতা রাখে। মানুষকে তার দ্বীন অনুযায়ী পরীক্ষা করা হয়। দ্বীনি অবস্থান পাকাপোক্ত হলে পরীক্ষা কঠিন হয়। দ্বীনি অবস্থান দুর্বল হলে পরীক্ষাও শিথিল হয়। মুসিবত মুমিন ব্যক্তিকে পাপশূন্য করে দেয়, এক সময়ে দুনিয়াতে সে নিষ্পাপ বিচরণ করতে থাকে।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার সাথে কল্যাণের ইচ্ছা করেন, তার থেকে বাহ্যিক সুখ ছিনিয়ে নেন।” তিনি আরো বলেন, আল্লাহ তাআলা যখন কোন সম্প্রদায়কে পছন্দ করেন, তখন তাদেরকে বিপদ দেন ও পরীক্ষা করেন।”[২৯]

৭. মুসিবতের বিনিময়ে উত্তম প্রতিদানের কথা স্মরণ : মোমিনের কর্তব্য বিপদের মুহূর্তে প্রতিদানের কথা স্মরণ করা। এতে মুসিবত সহনীয় হয়। কারণ কষ্টের পরিমাণ অনুযায়ী সওয়াব অর্জিত হয়। সুখের বিনিময়ে সুখ অর্জন করা যায় না- সাধনার ব্রিজ পার হতে হয়। প্রত্যেককেই পরবর্তী ফলের জন্য নগদ শ্রম দিতে হয়। ইহকালের কষ্টের সিঁড়ি পার হয়ে পরকালের স্বাদ আস্বাদান করতে হয়। ইরশাদ হচ্ছে, “কষ্টের পরিমাণ অনুযায়ী প্রতিদান প্রদান করা হয়।” একদা হজরত আবু বকর রা. ভীত-ত্রস্ত হালতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর কীভাবে অন্তরে স্বস্তি আসে?

৮. বালা-মুসিবতের পুনরাবৃত্তি থেকে বিরত থাকা : যার ওপর দিয়ে কোন মুসিবত বয়ে যায়, তার উচিত এর স্মৃতিচারণ বা পুনরাবৃত্তি না করা। যখন মনে বা স্মৃতি পটে চলে আসে, সাধ্যমত এড়িয়ে যাওয়া। পুনঃপুন বৃদ্ধি বা লালন না করা। কারণ এর ভেতর বিন্দু পরিমাণ লাভ নেই। উপরন্তু ধৈর্য্য ছাড়া কোন উপায়ও নেই। বরং এ নিয়ে কল্পনা-জল্পনা করা দৈন্যদের কাজ, তাদের মূলপুঁজি। দ্বিতীয়ত যে চলে গেছে, সে কখনো ফিরে আসবে না। যে সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে তা পাল্টাবে না। হজরত উমর রা. এর একটি উপদেশ :لا تستفزوا الدموع بالتذكر. “তোমরা স্মৃতিচারণ করে চোখের পানি উছলে তুলো না।” অধিকাংশ প্রিয়জনহারা শোকাতুর লোক মৃত ব্যক্তির স্মৃতি সংরক্ষণ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে প্রতি মুহূর্ত মৃত ব্যক্তির স্মরণে সে ব্যস্ত থাকে। শোক-দুঃখ মোচনের পথে যা বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

৯. একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা বর্জন : শোকাতুর ব্যক্তির একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা পরিহার করা উচিত। কেননা সংশয় প্রবঞ্চনা নিঃসঙ্গ-অবসর ব্যক্তির পিছু নেয়। নিঃসঙ্গদের ওপর শয়তান অধিক কূটকৌশল ও প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। কল্যাণকর ও অর্থবহ কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। অটল থাকতে হবে পূর্ব নির্ধারিত স্বীয় সিদ্ধান্তে। নিয়মিত তেলাওয়াত, দু’আ-দরুদ, নামায ইত্যাদিতে মশগুল থাকতে হবে। এসবকেই অন্তরঙ্গ বন্ধু ও নিত্যসঙ্গি বানিয়ে নিতে হবে। কারণ আল্লাহর যিকিরের মালেঝই নিহিত রয়েছে আত্মিক প্রশান্তি।

১০. আপত্তি অভিযোগ ও অস্থিরতা ত্যাগ করা : যে কোন বিপদাপদের সময় অসহিষ্ণুতা ও আপত্তি-অভিযোগ পরিহার করা। এটাই সান্ত্বনার শ্রেয়পথ। শান্তির উপায়-উপলক্ষ। যে এর থেকে বিরত থাকবে না, তার কষ্ট ও অশান্তি দ্বিগুন হবে। বরং সে নিজেই স্বীয় শান্তি বিনাশকারী-নিঃশেষকারী। কোন অর্থেই তার জন্য ধৈর্য্য প্রযোজ্য হবে না, মুসিবত থেকে নাজাতও পাবে না। কারণ ধৈর্য যদি হয় বিপদাপদ মূলোৎপাটনকারী, অধৈর্য্যতা তার পৃষ্ঠপোষকতা-দানকারী। যার বিশ্বাস আছে, নির্ধারিত বস্তু নিশ্চিত হস্তগত হবে, নির্দিষ্ট বস্তু নিশ্চিত অর্জিত হবে, তার ধৈর্য্য পরিহার করা নিরেট বিড়ম্বনা- আরেকটি মুসিবত। আল্লাহ তাআলা বলেন, “যমীনে এবং তোমাদের নিজদের মধ্যে এমন কোন মুসীবত আপতিত হয় না, যা আমি সংঘটিত করার পূর্বে কিতাবে লিপিবদ্ধ রাখি না। নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে খুবই সহজ। যাতে তোমরা আফসোস না কর তার উপর যা তোমাদের থেকে হারিয়ে গেছে এবং তোমরা উৎফুল্ল না হও তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তার কারণে। আর আল্লাহ কোন উদ্ধত ও অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না।”[৪৭]-প্রিয়.কম

লেখক : মাওলানা মিরাজ রহমান
২৪ জুন, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে