মঙ্গলবার, ২৮ জুন, ২০১৬, ০৬:০৬:২৫

ইমাম হোসাইন (রা.) সম্পর্কে জানতে এসেই ইসলাম গ্রহণ করেন আমেরিকান নওমুসলিম হাজার হোসাইনি

ইমাম হোসাইন (রা.) সম্পর্কে জানতে এসেই ইসলাম গ্রহণ করেন আমেরিকান নওমুসলিম হাজার হোসাইনি

ইসলাম ডেস্ক : ইসলাম সম্পর্কে অসচেতন কিংবা ইসলাম-বিদ্বেষী কোনো কোনো মহল মাঝে মধ্যে অভিযোগ করে থাকে যে, এই ধর্ম তরবারির জোরেই বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু এটা যে পুরোপুরি অসত্য ও ভুল বক্তব্য তার বহু প্রমাণ দেয়া যায়।

ইসলাম যদি তরবারির জোরেই প্রচারিত হতো তাহলে ভারতবর্ষে প্রায় ৮০০ বছর ও স্পেনে প্রায় ৫০০ বছর ধরে রাজত্ব করা সত্ত্বেও মুসলমানরা সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এখনও বিপুল সংখ্যক খ্রিস্টান, ইহুদি ও অগ্নি-উপাসক বংশ পরম্পরায় বসবাস করে আসছেন। তাই এটাই বাস্তব সত্য যে ইসলামের উন্নত চিন্তাধারা ও শিক্ষা মানুষকে আকৃষ্ট করেছে বলেই এ মহান ঐশী ধর্ম সারা বিশ্বে এতটা বিস্তৃত হতে পেরেছে।

ইসলাম যুক্তি ও মানুষের প্রকৃতির ধর্ম। বিশ্বনবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইত মানুষের কাছে চিরসৌভাগ্যের ও চিরমুক্তির পথ হিসেবে বাস্তব জীবনে ইসলামের শিক্ষাগুলো প্রদর্শন করতে পেরেছিলেন বলেই এ ধর্ম বিশ্বব্যাপী এতটা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সেই একই বাস্তবতাগুলো আজ প্রায় ১৪০০ বছর পরও সত্য-পিয়াসি মানুষকে আকৃষ্ট করছে গভীরভাবে। মার্কিন নও-মুসলিম মহিলা হাজার হোসাইনি বা “সাবেক ডায়ানা ট্রেভান গোসো” এইসব সৌভাগ্যবান সত্য-পিয়াসীদের মধ্যে অন্যতম।

ডায়ানা ট্রেভান জন্ম নিয়েছিলেন একটি গোঁড়া ক্যাথলিক খ্রিস্টান পরিবারে। তার পরিবার তুলনামূলকভাবে ধর্মীয় মূলনীতিকে বেশি গুরুত্ব দিত। অন্য ধর্মগুলো ও আধ্যাত্মিক বাস্তবতা সম্পর্কে জানার ব্যাপক আগ্রহ ছিল ডায়ানার মধ্যে। খ্রিস্ট ধর্মকে পুরোপুরি বুঝতে পারার পরই ডায়ানা ট্রেভান ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন।

মার্কিন এই নারী তথ্যের জগতে ডুবে থাকলেও ইসলাম সম্পর্কে খুব কমই জানতেন। কিন্তু তার কৌতূহলী মন তাকে এ ব্যাপারে দিনকে দিন বেশি সক্রিয় করে তোলে।

ইসলামের নেতৃত্ব বা ইমামতের বিষয়টি ডায়ানার কাছে খুবই আকর্ষণীয় বা ইসলামের শ্রেষ্ঠ বিষয় বলে মনে হয়েছে। ইমামত নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে উচ্চতর এক পর্যায়ে শহীদদের সর্দার হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)’র প্রসঙ্গ ডায়ানা ট্রেভানের সামনে চলে আসে। তিনি খ্রিস্টান ধর্মের সঙ্গে মুসলমানদের নানা দৃষ্টিভঙ্গির তুলনা করতেন। ডায়ানা ট্রেভান হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) সম্পর্কে যতই জানছিলেন ততই তার অতি উচ্চ মহত্ত্ব সম্পর্কে আরো বেশি জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছিলেন। এভাবে ইমাম হোসাইন (রা.) ডায়ানা ট্রেভানের জীবনের সবচেয়ে বিমুগ্ধ মুহূর্তগুলোর প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হন।

এ প্রসঙ্গে ট্রেভান বলেছেন, “আমি (ধর্ম নিয়ে গবেষণায়) যতই অগ্রসর হচ্ছিলাম ততই নতুন নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমার সামনে আসতে লাগল। প্রথমদিকে মোটেই বুঝতে পারছিলাম না যে কী করব। এর আগে আমি গির্জার একজন প্রচারক হিসেবে প্রচারের ব্যবস্থাগুলোর সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। নৈতিক ও ধর্মীয় বিষয়গুলো ছিল আমার আগ্রহের বিষয়। কিন্তু আশুরা ও ইমাম হোসাইন (রা.)’র মহত্ত্বের নানা দিক আমার জন্য খুবই ভিন্ন ধরনের এক জগত খুলে দিল। আশুরা আমার জন্য মহাসত্যের প্রমাণগুলোর ষোল কলা পূর্ণ করে দেয়। আমি এ ব্যাপারে আরো গভীরভাবে গবেষণা শুরু করি।”

কারবালার মহাবিপ্লব ও হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)’র চিন্তাধারা বিশ্বের মানুষের ওপর এবং এমনকি অমুসলমানদের ওপরও গভীর প্রভাব রেখেছে। ওই মহাবিপ্লবের অতুল মহত্ত্ব ও বীরত্বব্যঞ্জক আত্মত্যাগের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত এবং হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর সঙ্গীদের ব্যক্তিত্বের নানা দিক বিশ্বের বহু চিন্তাশীল ও দূরদর্শী মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। থমাস মাসারিক নামের একজন খ্রিস্টান চিন্তাবিদ বলেছেন, “যখন আমাদের পাদ্রিরা হযরত ঈসা মাসিহ’র নানা দুঃখ ও বিপদের কথা বলেন তখন মানুষ দুঃখ অনুভব করে, কিন্তু হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)’র অনুরাগী ও অনুসারীদের মধ্যে যে উচ্চ মাত্রার আলোড়ন ও শিহরণ দেখা যায় তা কখনও হযরত ঈসা (রা.)’র ক্ষেত্রে দেখা যায় না। এ দুইয়ের মধ্য তুলনা করলে মনে হবে যেন ঈসা (রা.)’র দুঃখ-বেদনাগুলো হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)’র বিপদ ও কষ্টের তুলনায় পাহাড়ের বিপরীতে সামান্য খড়ের মত।”

মার্কিন নও-মুসলিম মহিলা হাজার হোসাইনি বা “সাবেক ডায়ানা ট্রেভান গোসো” মনে করেন হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)’র বৈশ্বিক ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “আমি মুসলমান হয়েছি আমেরিকায়। এরপর আমি ইসলাম ও ইমাম হোসাইন (রা.)’র নামে খ্যাত ইরানে আসার চেষ্টা করি যাতে এইসব বিষয়ে পড়াশুনা অব্যাহত রাখতে পারি। আমি ঈসা (রা.)’র জীবনের সব দিক নিয়ে যথাযথ ও নিখুঁত গবেষণা করেছি। গবেষণার মাধ্যমে আমি এটা বুঝতে পেরেছি যে, তিনি মানবজাতিকে এই ইমামের আদর্শই অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ইসলামে এ ধরনের আদর্শ অত্যন্ত ব্যাপক ও প্রভাবশালী। আমার জন্য যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা হলো ইমাম হোসাইন (রা.)’র ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানা। তিনি সারা বিশ্বের ওপরও ব্যাপক প্রভাব রেখেছেন। ইমামের আন্দোলন ছিল সত্যকে পুনরুজ্জীবিত করার আন্দোলন। তিনি সব কিছুই উৎসর্গ করেছিলেন যাতে সত্যিকারের ধর্ম ও মনুষ্যত্বের বাস্তবতা টিকে থাকে। এ বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চিন্তা ও বুদ্ধিমত্তার নানা দিক। এর অর্থ আপনার পুরো জীবনটাকেই আল্লাহ বা পাওয়ার জন্য উৎসর্গ করতে হবে।”

মার্কিন নও-মুসলিম মহিলা হাজার হোসাইনি আরো বলেছেন, “নানা ধর্ম ও বিশেষ করে খ্রিস্ট ধর্ম ইতিহাসের পরিক্রমায় গোত্রীয় বা জাতিগত নানা গোঁড়ামির কারণে সঠিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে। কিন্তু ইসলামের পবিত্র ইমামগণ ও বিশেষ করে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ইসলামকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষার জন্য ও এ ধর্মকে তার প্রকৃত পথে টিকিয়ে রাখার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। খ্রিস্ট ধর্মে হযরত ঈসা (রা.)’র পর এ ধর্মকে টিকিয়ে রাখার জন্য কেউ কি এমন কাজ করেছেন? ইসলাম ও খ্রিস্ট ধর্মের মধ্যে মূলনীতির বিষয়ে কোনো পার্থক্য না থাকলেও বড় পার্থক্যটি হলো এটা যে খ্রিস্ট ধর্ম তার আসল রূপটি হারিয়ে ফেলেছে। খ্রিস্ট সংস্কৃতি যেমন হওয়া উচিত ছিল ও হযরত ঈসা (রা.) যেমনটি বলেছিল তেমনটি আর নেই। কিন্তু ইসলামে অন্ততঃ এমন একদল ছিলেন যারা ইসলামের মূল সংস্কৃতিকে জীবন দিয়ে রক্ষা করেছেন। আমার মতে কারবালা মানবতা বা মনুষ্যত্বের পূর্ণতার কেন্দ্রভূমি।”

হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)’র আন্দোলন ছিল অত্যন্ত গভীর ও বহুমাত্রিক। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কিছু চালিকা-শক্তি ইমামের এই বিপ্লবের ওপর প্রভাব রেখেছে। আর এ-সবকিছুই সমন্বিত হয়েছিল যে মহান ও একমাত্র উদ্দেশ্যে তা হলো ধর্মের পুনরুজ্জীবন। ইসলামের যে বিশুদ্ধ ধারা ও অসাধারণ জ্ঞান আমাদের যুগ পর্যন্ত পৌঁছেছে তা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ব্যাপক প্রচেষ্টার ফসল। ইসলাম সেইসব মহান সংস্কারকের কাছে চির-ঋণী যারা যুগে যুগে বিকৃতি ও কূপ্রথার জাল-জঞ্জাল বা আবরণকে ইসলামের পবিত্র ধারা থেকে দূর করেছেন। বিশ্বনবী (সা.)’র ওফাতের পর এই দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁরই পবিত্র আহলে বাইত (রা.) সামাজিক ও অন্যান্য পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে। এভাবে তারা মানবজাতির জন্য নতুন নতুন ও উজ্জ্বল দিগন্ত খুলে দিয়েছেন।

মার্কিন নও-মুসলিম মহিলা হাজার হোসাইনি বা সাবেক ডায়ানা ট্রেভান বর্তমানে ‘কাওসার’ নামের স্প্যানিশ ভাষার একটি ম্যাগাজিন এবং ওয়েব সাইটের লেখক। ইউরোপীয়দের কাছে ইসলাম প্রচার করতে চান এই নারী। হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও আশুরা বিপ্লবকে জানার মাধ্যমে মুসলমান হতে পারায় নিজেকে খুবই সুখী ও সৌভাগ্যবতী মনে করছেন হাজরা।-প্যারিস টুডে
২৮ জুন, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে