ইসলাম ডেস্ক: হযরত ওমর (রা.) ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা এবং প্রধান সাহাবীদের অন্যতম। আবু বকরের মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে দায়িত্ব নেন। উমর ইসলামি আইনের একজন অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ ছিলেন। ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করার কারণে তাকে আল ফারুক (সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী) উপাধি দেয়া হয়। আমিরুল মুমিনিন উপাধিটি সর্বপ্রথম তার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। ইতিহাসে তাকে প্রথম উমর হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। নামের মিল থাকার কারণে পরবর্তী কালের উমাইয়া খলিফা উমর ইবনে আবদুল আজিজকে দ্বিতীয় উমর হিসেবে সম্বোধন করা হয়। সাহাবীদের মর্যাদার ক্ষেত্রে সুন্নিদের কাছে আবু বকরের পর উমরের অবস্থান।
খলিফা হিসেবে শাসন:
প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ
ক্ষমতাপ্রাপ্তি পর সকল মুসলিম তাকে বায়াত প্রদান করেন। তার ব্যক্তিত্বের কারণে জনতা তাকে সমীহ করত। মুহাম্মদ হুসাইন হায়কলের মতে উমরের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল তার প্রজা ও মজলিশ আল শুরার সদস্যদের মন জয় করা।
উমর বাগ্মী ব্যক্তি ছিলেন। জনগণের মনে স্থান করে নেয়ার জন্য তার এই দক্ষতা সাহায্য করেছে।
শাসক হিসেবে উমর দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন। ফিদাকের জমির ব্যাপারে তিনি আবু বকরের নীতির অনুসরণ করেছেন এবং একে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহারের নীতি চালু রাখেন।
রিদ্দার যুদ্ধে কয়েক হাজার বিদ্রোহী ও ধর্মত্যাগীকে দাস হিসেবে বন্দী করা হয়েছিল। উমর এসকল বন্দীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং তাদের মুক্তির নির্দেশ দেন। এই ঘোষণা বেদুইন গোত্রগুলোর কাছে উমরের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছিল।
রাজনৈতিক ও বেসামরিক প্রশাসন
উমরের সরকার এককেন্দ্রীক ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়। এতে খলিফা ছিলেন সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ। পুরো সাম্রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়। পাশাপাশি আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া এসব অঞ্চলের কিছু স্বায়ত্তশাসিত এলাকা খিলাফতের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেয়। প্রদেশগুলো প্রাদেশিক গভর্নর বা ওয়ালি কর্তৃক শাসিত হত। উমর ব্যক্তিগতভাবে ওয়ালিদের নিযুক্ত করতেন। প্রদেশগুলোকে বিভিন্ন জেলায় বিভক্ত করা হত। পুরো সাম্রাজ্যে প্রায় ১০০ এর মত জেলা ছিল। প্রতিটি জেলা বা প্রধান শহর একজন অধস্তন গভর্নর বা আমিলের দায়িত্বে থাকত। আমিলরা সাধারণত উমর কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হতেন তবে প্রাদেশিক গভর্নররাও তাদের নিয়োগ দিতে পারতেন। প্রাদেশিক স্তরে অন্যান্য অফিসাররা ছিলেন:
ক. কাতিব, প্রধান সচিব
খ. কাতিব উদ দিওয়ান, সামরিক সচিব
গ. সাহিব উল খারাজ, রাজস্ব আদায়কারী
ঘ. সাহিব উল আহদাস, পুলিশ প্রধান
ঙ. সাহিব বাইতুল মাল, কোষাগার কর্মকর্তা
চ. কাজি, প্রধান বিচারক
অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওয়ালি প্রদেশের সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে কর্মরত থাকলেও কিছু প্রদেশে পৃথক সামরিক অফিসার থাকত। প্রতিটি নিয়োগ লিখিত আকারে দেয়া হত। নিয়োগের সময় গভর্নরদের জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হত। দায়িত্বগ্রহণের পর গভর্নররা জনতাকে প্রধান মসজিদে জড়ো করে তাদের সামনে নির্দেশনা পড়ে শোনাতেন।
কর্মকর্তাদের প্রতি উমরের সাধারণ নির্দেশনা ছিল:
স্মরণ রেখ, আমি তোমাকে জনগণের উপর নির্দেশদাতা ও স্বেচ্ছাচার হিসেবে নিয়োগ দিইনি। আমি তোমেকে একজন নেতা হিসেবে পাঠিয়েছি যাতে জনগণ তোমার উদাহরণ অনুসরণ করতে পারে। মুসলিমদেরকে তাদের অধিকার প্রদান কর যাতে তারা অন্যায়ে পতিত না হয়। তাদের মুখের উপর নিজেদের দরজা বন্ধ কর না যাতে ক্ষমতাশালীরা দুর্বলদের ধ্বংস করতে না পারে। এবং নিজেকে তাদের চেয়ে উচ্চ মনে হয় এমন কোনো আচরণ কর না যা তাদের প্রতি স্বৈরাচার।
এছাড়াও আরো কিছু বিধিনিষেধ গভর্নর ও রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের উপর জারি করা হয়। প্রধান কর্মকর্তাদেরকে হজ্জের সময় মক্কায় আসতে হত এবং এসময় জনগণ তাদের বিরুদ্ধে যেকোনো অভিযোগ তুলতে পারত। দুর্নীতি রোধ করার জন্য উমর তার কর্মকর্তাদের উচ্চ বেতন দিতেন। নিজ অঞ্চলে সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ প্রধান থাকাবস্থায় গণিমতের সম্পদ ছাড়াও গভর্নররা বার্ষিক পাঁচ থেকে সাতহাজার দিরহাম করে পেতেন।
উমরের অধীনে সাম্রাজ্যকে নিম্নোক্ত প্রদেশে বিভক্ত করা হয়.
১। আরবকে মক্কা ও মদিনা প্রদেশে বিভক্ত করা হয়;
২। ইরাককে বসরা ও কুফা প্রদেশে বিভক্ত করা হয়;
৩। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর উচ্চ অংশে আল-জাজিরা প্রদেশ ছিল।;
৪। সিরিয়া ছিল একটি প্রদেশ;
৫। ফিলিস্তিনকে ইলিয়া ও রামলাহ প্রদেশে বিভক্ত করা হয়;
৬। মিশরকে উচ্চ মিশর ও নিম্ন মিশর প্রদেশে বিভক্ত করা হয়;
৭। পারস্যকে খোরাসান, আজারবাইজান ও ফারস প্রদেশে বিভক্ত করা হয়।
রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের জন্য উমর সর্বপ্রথম বিশেষ বিভাগ গঠন করেন। এই বিভাগ প্রশাসনিক আদালত হিসেবে কাজ করত এবং এর আইনি কর্মকাণ্ড উমর ব্যক্তিগতভাবে তদারক করতেন। এই বিভাগ মুহাম্মদ ইবনে মাসলামার দায়িত্বে দেয়া হয়। গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগগুলোর ক্ষেত্রে তিনি ঘটনাস্থল, অভিযোগ তদন্ত ও পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে উমরের সহায়তা করতেন। কিছু ক্ষেত্রে অনুসদ্ধান কমিটির সাথে তদন্তের বিষয়ে আলোচনা করা হত। ক্ষেত্রবিশেষে অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে মদিনায় তলব করে আদালতের সম্মুখীন করা হত। উমর তার গোয়েন্দা বিভাগের সহায়তায় কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনেন।[৩২]
কিছু ক্ষেত্রে উমর পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন:
ক. উমর সর্বপ্রথম পাবলিক মিনিস্ট্রি প্রথা চালু করেন যেখানে সরকারি কর্মকর্তা ও সৈনিকদের রেকর্ড লিপিবদ্ধ করা থাকত। গভর্নর ও রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে পাঠানো চিঠির অনুলিপিও রেকর্ড হিসেবে রক্ষিত থাকত।
খ. আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তিনি প্রথম পুলিশ বাহিনী নিয়োগ দেন।
গ. জনতা বিশৃংখল পরিস্থিতির সৃষ্টি করলে তিনি প্রথম তাদের শৃঙ্খলায় আনেন।
খাল:
উমরের শাসনামলে বসরা শহর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পানীয় জল ও সেচের জন্য তিনি খাল খননের ব্যবস্থা করেন। আল তাবারির বিবরণ অনুযায়ী শহর পরিকল্পনাধীন অবস্থায় উতবা ইবনে গাজওয়ান প্রথম টাইগ্রিস নদী থেকে বসরা পর্যন্ত প্রথম খাল খনন করেন। শহর তৈরির পর আবু মুসা আশআরিকে এর প্রথম গভর্নর নিয়োগ দেয়া হয়। আবু মুসা আশআরি বসরা ও টাইগ্রিস নদীকে সংযোগকারী দুইটি গুরুত্বপূর্ণ খাল খনন করান। এগুলো হল আল-উবুলা নদী ও মাকিল নদী। সমগ্র বসরা অঞ্চলে কৃষির উন্নয়ন এবং পানীয় জলের সরবরাহের জন্য এই খালদ্বয় মূল ভূমিকা পালন করেছে। উমর পতিত জমির চাষাবাদের জন্য নীতি গ্রহণ করেন। যারা এসকল জমি আবাদ করত তাদেরকে এসব জমি প্রদান করা হয়। এই নীতি উমাইয়া আমলেও চালু ছিল। ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে খাল খননের ফলে ব্যাপক অঞ্চলজুড়ে কৃষিক্ষেত্র গড়ে উঠে।
উমরের শাসনামলে খিলাফতের সীমানা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। তাই বিশাল সাম্রাজ্যকে ধরে রাখার জন্য তিনি রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে শুরু করেন। তিনি বেশ কিছু প্রশাসনিক সংস্কার সাধন করেন। নতুন বিজিত অঞ্চলে তিনি প্রশাসন গঠন করেন যতে কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও আমলাতন্ত্র ছিল। তার শাসনামলে বসরা ও কুফা শহরদ্বয় নির্মিত ও সম্প্রসারিত হয়। ৬৩৮ সালে তিনি মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববী বর্ধিত ও সংস্কার করেন।
নাজরান ও খায়বারের খ্রিষ্টান ও ইহুদিদেরকে সিরিয়া ও ইরাকে চলে যাওয়ার জন্য তিনি নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। তিনি ইহুদিদেরকে জেরুজালেমে পুনরায় বসতি করার সুযোগ দেন। পূর্বে এই সুযোগ ছিল না। তিনি আদেশ জারি করেন যাতে বলা হয় যে এই খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের সাথে ভালো আচরণ করতে হবে এবং তাদের নতুন বসতিতে সমপরিমাণ জমি প্রদান করা হয়। উমর অমুসলিমদের জন্য হেজাজে তিন দিনের বেশি অবস্থান করায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। উমর সর্বপ্রথম সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রীয় বিভাগ হিসেবে গঠন করেন।
বায়তুলমাল:
৬৪১ সালে তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার হিসেবে বাইতুল মাল গঠন করেন। মুসলিমদেরকে বার্ষিক ভিত্তিতে ভাতা প্রদান করা হত। কেউ যখন রাজা হয় তার কি কোন কিছুর অভাব থাকে? থাকেনা। একজন রাজার থাকে উজির-নাজির, পাইক-পেয়াদা। থাকে দাস-দাসী। অন্যদিকে থাকে অট্টালিকা, বালাখানা। রাজ্যের সমস্ত ধন-সম্পদের মালিক হয়ে যায় তখন রাজা। যত রকমের সুযোগ সুবিধা সব নিজের জন্যে। ছেলে-মেয়েদের জন্য আর তার নিজের লোকদের জন্য।
কিন্তু আমরা বলছি এমন এক রাজার কথা কথা। যার ছিলনা কোন বালা খানা। ছিলনা সুরম্য রাজ প্রাসাধ। খেজুর পাতার বিছানা ছিল তার নিত্য সঙ্গী। নিজের সরকারী সস্পত্তি অন্যায়ভাবেতো দুরের কথা প্রাপ্য অংশটাও ভোগ করতেন না। আর কাউকে তা ভোগ করতেও দিতেন না। তিনি হলেন ফারুকে আযম হযরত ওমর ফারুক।
একবার তার ছেলে একটি উট কিনে ছিলেন। উটটি দেখতে তেমন ভাল ছিলনা। দূর্বল উট। তার হাড়ঁগুলো গোনা যেত। আর এরকম একটা শুকনো উটের দামই বা কত? খুবই কম দাম দিয়ে এটি কিনে নিয়ে আসেন আবদুল্লহ। কিন্তু এরকম দুর্বল উট দিয়ে কি হবে। তিনি ভাবলেন এটাকে মোটাতাজা করতে হবে। তাই তিনি সরকারী খামারে কিছু দিনের জন্য উটটাকে ছেড়ে ছিলেন। কিছুদিন সরকারী খামারে ভাল খাবার পেয়ে উটটি মোটা তাজা হয়ে উঠলো। দেখতেও খুব সুন্দর হলো।
একদিন আবদুল্লাহ এই মোটাতাজা উটটিকে বিক্রি করতে নিয়ে গেলেন। হযরত ওমর ছিলেন তখন সেখানে। তিনি দেখলেন তার ছেলে সুন্দর একটি উট বিক্রি করছে। তিনি এগিয়ে গিয়ে তার ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন: এই উট তুমি কোথায় পেলে? আবদুল্যা জবাব দিল এটি আমি কিনেছিলাম। খুব দুর্বল ছিল। দামও ছিল কম। ওমর বললেন কই আগেতো দেখিনি? আবদুল্লা জবাব দিল এটিকে আমি কিছু দিনের জন্যে সরকারী খথামাওে ছেড়ে দিয়েছিলাম। ওখানে ভাল খাবার পেয়ে এমন বলিষ্ঠ ও সন্দির হয়েছে। হযরত ওমর তখন আর তাকে কিছু বললেন না। উটটা খুব ভাল দামে বিক্রি হয়ে গেল। বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর হযরত ওমর তার ছেলেকে ডেকে বললেন: “উটের আসল দাম রেখে বাকী টাকা তুমি বায়তুল মালে জমা দিয়ে দাও” কারণ হযরত ওমর জানতেন সরকারী খামারে আবদুল্লাহর অধিকার নেই। সে উটটিকে ওখানে ছেড়ে দিয়ে যে লাভবান হয়েছে ওটা তার হতে পারেনা। এই হলেন শাসক। এই হলেন অর্ধজাহানের খলীফা। আমীরুল মোমেনীন হযরত ওমর ফারুক (রা:)।
জেরুজালেম সফর:
উমরের জেরুজালেম সফর বেশ কিছু সূত্রে উল্লেখ রয়েছে। সাম্প্রতিককালে আবিষ্কৃত একটি জুডিও-আরবি বিবরণে নিম্নোক্তভাবে উল্লেখ করা হয়েছে:[৩৬]
"উমর অইহুদি এবং কিছু ইহুদিদেরকে হারাম আল শরিফ এলাকা পরিচ্ছন্ন করার আদেশ দেন। উমর এই কাজ পরিদর্শন করেছেন। আগত ইহুদিরা বাকি ফিলিস্তিনের ইহুদিদের চিঠি লিখে এবং জানায় যে উমর ইহুদিদের জেরুজালেমে পুনরায় বসবাসের অনুমতি দিয়েছেন। আলোচনার পর উমর সত্তরটি ইহুদি পরিবারকে ফেরার অনুমতি দেন। তারা শহরের দক্ষিণ অংশ অর্থাৎ ইহুদি বাজারে ফিরে আসে (সিলোয়ামের পানি, হারাম আল শরিফ ও এর ফটকের নিকটে থাকা তাদের লক্ষ্য ছিল)। এরপর অধিনায়ক উমর তাদের অনুরোধ মঞ্জুর করেন। টাইবেরিয়াস ও এর আশপাশের অঞ্চল থেকে সত্তরটি পরিবার তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ফিরে আসে।"
খলিফা উমরের যুদ্ধ:
মুসলিমদের সিরিয়া জয়ের পর ৬৩৮ সালে উমর খালিদ বিন ওয়ালিদকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেন। ইতিপূর্বে খালিদ সিরিয়ায় মুসলিম বাহিনীর প্রধান ছিলেন। মানুষ খালিদকে বিজয়ের মূল চাবিকাঠি মনে করতে থাকায় উমর তাকে পদচ্যুত করেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে বিজয় আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে এবং কোনো মানুষ তা আনতে পারে না। আরবে দুর্ভিক্ষ এবং লেভান্টে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে ৬৩৮ থেকে ৬৩৯ সালের মধ্যে এক বছর সময় সামরিক অভিযান সাময়িকভাবে মুলতবি ছিল। উমরের শাসনামলে লেভান্ট, মিশর, সিরেনাইকা, ত্রিপলিতানিয়া, ফেজান, পূর্ব আনাতোলিয়া এবং ব্যাক্ট্রিয়া, পারস্য, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, ককেসাস ও মাকরানসহ প্রায় সমগ্র সাসানীয় সাম্রাজ্য খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। মিশর ও নতুন বিজিত সাসানীয় সাম্রাজ্যে শাসনব্যবস্থা স্থিতিশীল করে তোলার জন্য উমর মৃত্যুর পূর্বে সামরিক অভিযান স্থগিত করেছিলেন। মৃত্যুর সময় তার শাসন পশ্চিমে বর্তমান লিবিয়া থেকে পূর্বে সিন্ধু নদ এবং উত্তরে আমু দরিয়া নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
দুর্ভিক্ষ
৬৩৮ সালে আরবে খরার ফলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ক্ষুধা ও মহামারীর কারণে অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] মদিনায় সঞ্চিত খাদ্য শেষ হয়ে যাওয়ার পর উমর সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও ইরাকের প্রাদেশিক গভর্নরদেরকে সাহায্যের জন্য চিঠি লেখেন। গভর্নরদের সময়মত পাঠানো সাহায্য হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বাচিয়েছিল। সিরিয়ার গভর্নর আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ সর্বপ্রথম আবেদনে সাড়া দেন।
পরে আবু উবাইদা ব্যক্তিগভভাবে মদিনা সফর করেন এবং সেখানে দুর্যোগ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠার জন্য উমরের সহায়তা করেন।[স্পষ্টকরণ প্রয়োজন] মদিনায় সাহায্য পৌছানোর পর উমর ইরাক, ফিলিস্তিন ও সিরিয়ার পথে মরুভূমির বসতির দিকে তার লোকদের পাঠান যাতে সেখানে অবস্থানরতদের সাহায্য পৌছানো যায়। ফলে লক্ষাধিক লোক প্রাণে বেঁচে যায়। ৬৩৯ সাল নাগাদ অবস্থার উন্নতি হয়। আরবে বৃষ্টিপাত হওয়ায় দুর্ভিক্ষ শেষ হয়। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কাজ উমর ব্যক্তিগতভাবে তদারক করেছিলেন।
প্লেগ মহামারী
আরবে দুর্ভিক্ষ শেষ হওয়ার পর সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের অনেক জেলায় প্লেগ দেখা দেয়। সিরিয়া সফরের সময় পথিমথ্যে সিরিয়ার গভর্নর আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ তার সাথে সাক্ষাত হয় এবং তিনি উমরকে প্লেগ সম্পর্কে সতর্ক করে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানান। উমর আবু উবাইদাকে তার সাথে আসতে বললে আবু উবাইদা নিজ বাহিনীকে কঠিন অবস্থায় ফেলে মদিনা যাওয়াতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। ৬৩৯ সালে আবু উবাইদা প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এসময় সিরিয়ায় প্রায় ২৫,০০০ মুসলিম প্লেগে মৃত্যুবরণ করে। সে বছরে পরবর্তীতে প্লেগের প্রাদুর্ভাব কমে এলে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পুনর্গঠনের জন্য উমর সিরিয়া সফর করেন।
কল্যাণ রাষ্ট্র
দরিদ্রদের কাছাকাছি থাকার জন্য উমর নিজে সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তার বাড়ি ছিল মাটির তৈরি এবং তিনি প্রতি সন্ধ্যায় জনগণের অবস্থা পরিদর্শনের জন্য রাস্তায় বের হতেন। উমর বাইতুল মাল নামক রাষ্ট্রীয় কোষাগার স্থাপন করেন। বাইতুল মাল থেকে মুসলিম ও অমুসলিম দরিদ্র, অসহায়, বৃদ্ধ, এতীম, বিধবা ও অক্ষমদেরকে সহায়তা প্রদান করা হত। বাইতুল মাল পরবর্তী উমাইয়া ও আব্বাসীয় খিলাফতের সময়েও প্রচলিত ছিল। এছাড়াও উমর শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করেন। ও প্লেগ মহামারীর জন্য ৬৩৮-৬৩৯ সময়ে সামরিক অভিযান স্থগিত করা হয়েছিল।
মুক্ত বাণিজ্য
ইতিপূর্বে ইহুদি ও স্থানীয় খ্রিষ্টানদের উপর বাইজেন্টাইন-সাসানীয় যুদ্ধের ব্যয়ভার মেটানোর জন্য অধিক হারে করারোপ করা হয়েছিল। মুসলিমদের অভিযানের সময় তারা বাইজেন্টাইন ও পারস্যের বিপক্ষে মুসলিমদের সহায়তা করে। ফলে বিজয় তরান্বিত হয়েছিল। ইসলামি রাষ্ট্রে নতুন এলাকা অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এসব অঞ্চলের জনগোষ্ঠী মুক্ত বাণিজ্যের সুবিধা ভোগ করে। এর ফলে ইসলামি রাষ্ট্রের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে বাণিজ্য সহজতর হয়। বাণিজ্যকে উৎসাহিত করার জন্য ইসলামি বাণিজ্যের পরিবর্তে সম্পদের উপর কর ধার্য করা হয়।মুসলিমরা দরিদ্রদের যাকাত দিতে বাধ্য থাকে। মুহাম্মদ (সা) কর্তৃক মদিনা সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা ইসলামি রাষ্ট্রের অধীনে তাদের নিজেদের আইনে চলতে পারত এবং নিজস্ব বিচারকের কাছে বিচার চাইতে পারত। একারণে তারা শুধু নিরাপত্তার জন্য কর প্রদান করত। সাম্রাজ্যের দ্রুত বৃদ্ধিতে সহায়ক হওয়ার জন্য বাইজেন্টাইন ও পারস্যের বিজিত অঞ্চলগুলোতে কর আদায় প্রক্রিয়া পূর্বের মত রাখা হয়। কর ব্যবস্থার আওতায় লোকেরা পূর্বের বাইজেন্টাইন ও সাসানীয় সময়ের চেয়ে কম হারে কর প্রদান করত।
লিখে দাও ওমরের কাছে আমার কোন দাবী নাই:
হযরত ওমর একদিন হেটে কোথাও যাচ্ছিলেন। কিছু দুর যাওয়ার পরই দেখলেন এক বৃদ্ধাকে। বৃদ্ধা কি যেন বিড় বিড় করছে। হযরত ওমর তার কাছে গেলেন। তার খোঁজ-খবর নিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন: আচ্ছা বুড়ি মা, খলীফা ওমর সম্পর্কে তোমার ধারনা কি? বুড়ি হযরত ওমরকে আগে কখনো দেখেনি। তাই তাকে সে চিনতে পারেনি। বুড়ি হযরত ওমর এর কথা শুনে কিছুটা বিরক্ত হলো। বললো: ওমর টোমর দিয়ে আমি কি করবো। আমার কি এমন ঠেকা পড়লো যে তার খবর আমাকে নিতে হবে। নিজের চিন্তায় বাঁচিনা। বুড়রি কথায় ছিল রাগ আর অসন্তোষের ছাপ। হযরত ওমর আবার তাকে জিজ্ঞাসা করলেন। বুড়ি মা, ওমরের উপর তোমার এতো রাগ কেন? বুড়ি চেঁচিয়ে জবাব দেয়: রাগ হবেনা কেন? এই যে খলীফা হয়েছে সে, তো আমায় একটি পয়সাও দিয়েছে? নাকি কোন দিন আমার খোজ-খবর নিয়েছে যে আমি কি হালতে আছি। ও মানুষনা।
হযরত ওমর বুড়ির কথা শুনে বড়ই চিন্তিত হলেন। ঠিকইত আমি তো তার তোন খোঁজ-খবর নিতে পারিনি। তিনি কিছুটা নরম হয়ে বুড়িকে আবার বললেন: আচ্ছা তুমি কি অবস্থায় আছো ওমর কি কওে জানবে? তুমি গিয়ে ওমরকে সব জানিয়ে আসলেই তো পারতে। বুড়ি জবাব দেয় কেন? আমি জানাতে যাব কেন? ওমরইতো আমীরুল মোমেনীন। সে-তো সবার খোঁজ-খবর নিবে বলে রাষ্ট্রের দায়ীত্ব গ্রহণ করেছে। প্রত্যেকের খোঁজ-খবর রাখার দায়িত্ব তো তারই। রুক্ষ ভাষায় বৃদ্ধা জবাব দিল। হযরত ওমর শান্তভাবে আবার বললেন- আচ্ছা “ওমর ফলীফা হওয়ার পর তুমি যে কষ্ট পেয়েছ, সে কষ্টের বিনিময়ে তুমি কত টাকা পেলে ওমরকে মাফ করে দিবে?” বৃদ্ধার সাথে এসব কথা চলছে। এমন সময় হযরত আলী ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) এসে হাজির হলেন। তারা হয়তো কোথাও যাচ্ছিলেন। এসেই সালাম দিলেন। আস্সালামু আলাইকুম ইয়া আমীরুল মু’মিনীন! আগন্তুক দুই ব্যক্তির মুখে আমীরুল মু’মিনীন শব্দ শুনে বৃদ্ধা তাজ্জব হয়ে গেল। সে ভয়ে কাঁপতে লাগলো। আর ভাবতে লাগলো সে হযরত ওমরের সামনেই তাকে এত গালমন্দ করেছে। দারুন অনুতপ্ত হলো বুড়ি। হযরত ওমর বৃদ্ধাকে শান্তনা দিলেন। আর বৃদ্ধার হাতে পচিশটি স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে বললেন: “বুড়ি মা! তুমি এই চামড়ায় লিখে দাও যে কেয়ামতের দিন ওমরের কাছে আমার কোন দাবী নাই”। বৃদ্ধা তখন তাই করলো। চামড়ার উপর তা লিখে দিল বৃদ্ধা। আর হযরত আলী (রা:) সাক্ষী হিসেবে তাতে উপর দস্তখত করলেন।
২৬ সেপ্টেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/মাহমুদ