শুক্রবার, ১৫ জুলাই, ২০১৬, ০৬:৩৯:৫৩

'পরিপূর্ণ কোরআনের জ্ঞানধারী ব্যক্তি হলেন হযরত আলী (রা.)'

'পরিপূর্ণ কোরআনের জ্ঞানধারী ব্যক্তি হলেন হযরত আলী (রা.)'

ইসলাম ডেস্ক : আসমানি সুরার আলোচনায় আপনাকে স্বাগতম। আজও আমরা সুরা রাদের কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যা তুলে ধরবো। সুরা রাদের ১২ ও ১৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:

'(১২)তিনিই সেই আল্লাহ যিনি তোমাদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত ও আশান্বিত করতে বিজলি বা বিদ্যুৎ দেখান এবং ভারী মেঘমালা সৃষ্টি করেন। (১৩) বজ্রধ্বনি তাঁর প্রশংসায় এবং ফেরেশতাকুল তাঁর ভয়ে মহিমা বা প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করে। এবং তিনি বিজলী পাঠান, এরপর একে যার ওপর ইচ্ছা নিক্ষেপ করে তার ক্ষতি করেন, অথচ তারা (স্রস্টার এইসব নিদর্শন দেখা সত্ত্বেও) আল্লাহ সম্পর্কে (অনর্থক) বাদানুবাদ করে এবং তাঁর শক্তি অশেষ, তিনি শাস্তিদানে অত্যন্ত কঠোর।'

সুরা রাদের 'রাদ' শব্দটির অর্থ হল বজ্রধ্বনি। এখানে একত্ববাদের পাশাপাশি মহান অল্লাহর মহত্ত্বের ও কর্তৃত্বের নানা নিদর্শন সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এইসব প্রাকৃতিক নিদর্শন মানুষের মনে একদিকে আতঙ্ক ও অন্যদিকে আশা জাগিয়ে তোলে। যেমন, বিদ্যুতের চমক ও বজ্রপাতের প্রচণ্ড গর্জন ভীত-সন্ত্রস্ত করে মানুষকে এবং অন্যদিকে বৃষ্টি জাগিয়ে তোলের আশা। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, মেঘমালায় বিদ্যুতের চমক ও বজ্রপাতের পর শুরু হয় প্রবল বৃষ্টি। এ ছাড়াও বিদ্যুত ও তাপের প্রভাবে বৃষ্টির পানিতে যুক্ত হয় অ্যাসিড যা ভূমিতে উদ্ভিদের জন্য যোগায় মূল্যবান সার। এভাবে গাছপালা হয় শক্তিশালী। এখানে মেঘমালার বিদ্যুতের বা বজ্রের গর্জনকে মহান আল্লাহর প্রশংসা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাসবীহ-এর অর্থ হল আল্লাহকে সব ধরনের দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে পবিত্র জ্ঞান করা। এ কাজটি কখনও জিহ্বা দিয়ে, কখনও অন্তর দিয়ে, কখনও অঙ্গ দিয়ে, কখনও কেবল শারীরিক ভাষায় প্রকাশিত হয়। এ কারণে আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, কোন বস্তু এমন নেই যে আল্লাহর প্রশংসা বা তাসবিহ করে না তথা তাঁকে সব দোষ থেকে মুক্ত মনে করে না। আর বজ্র তো তাঁরই সৃষ্ট, তাই এর তাসবীহ করা বিস্ময়কর নয়।

সুরা রাদের ১৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ সত্য ও মিথ্যার মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে বলেছেন, 'তিনিই আকাশ থেকে বারি বর্ষণ করেন, ফলে উপত্যকাগুলো তাদের ধারণ ক্ষমতা অনুসারে প্লাবিত হয়, এরপর প্লাবন-স্ফীত ফেনাগুলো বহন করে, এবং যে ধাতু গুলোকে তারা অলংকার বা অন্য পণ্যগুলো পাওয়ার উদ্দেশ্যে আগুনে উত্তপ্ত করে সেগুলো হতেও অনুরূপ ফেনা সৃষ্টি হয়- এভাবে আল্লাহ সত্য ও অসত্যের উপমা দিয়ে থাকেন যে, ফেনা অপসারিত হয়ে যায় এবং যা মানুষের উপকারে আসে তা ভূমিতে থেকে যায় এবং এভাবেই আল্লাহ উপমা দিয়ে থাকেন।'

এই দৃষ্টান্তে মহান আল্লাহ সত্যকে স্বচ্ছ পানি ও মিথ্যাকে ফেনার সঙ্গে তুলনা করেছেন। বৃষ্টির ফলে যে পানি-প্রবাহ বা প্লাবন দেখা দেয় তাতে নানা বস্তু মিশে ফেনা তৈরি হয়। এই ফেনা ধীরে ধীরে তলিয়ে যায় ওইসব বস্তুর সঙ্গে। ফলে ঘোলা পানি আবারও স্বচ্ছ ও পরিস্কার হয়ে যায়। আল্লাহ এখানে বলতে চাচ্ছেন যে সত্য সব সময়ই স্বচ্ছ পানির মত উপকারী এবং জীবন ধারণের জন্য পানির মতই অপরিহার্য। কিন্তু মিথ্যা হচ্ছে অর্থহীন ও কল্যাণবিহীন। বৃষ্টির পানি মাটিতে মিশে গেলেও তা ঝর্ণা, কুয়া ও খালের আকারে উদ্ভিদসহ পানির ওপর নির্ভরশীল জীবের তৃষ্ণা মেটায়। এভাবে ফুল ও ফলে সমৃদ্ধ সুশোভিত হয় উদ্ভিদ-জগত। মিথ্যা হচ্ছে অন্তঃসারশুন্য ফেনার মত। মিথ্যা হচ্ছে মরিচিকার তুল্য ও শ্লোগানসর্বস্ব কথার মত যা সত্যের পোশাক পরে সরলমনা সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেয়। কিন্তু সত্য হচ্ছে সুদৃঢ় এবং যখন তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন মানুষ মিথ্যাকে ফেনার মতই দূরে নিক্ষেপ করে। তাই মিথ্যাকে বিতাড়িত করতে সত্যকে ফুটিয়ে তোলা জরুরি।

সুরা রাদের ২০ থেকে ২২ নম্বর আয়াতে 'উলিল-আলবাব' বা প্রজ্ঞাবান ও সত্য-প্রেমিকদের কিছু বৈশিষ্ট তুলে ধরা হয়েছে। এসব হল:

- তাঁরা আল্লাহকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন, আল্লাহকে ও পরকালের বিচার-দিবসকে ভয় করেন, আল্লাহ যেসব বন্ধনকে রক্ষা করতে বলেছেন সেইসব বন্ধনকে অটুট রাখেন, আল্লাহকে খুশি রাখার জন্য ধৈর্য ধারণ করেন ও দৃঢ়তা বা প্রতিরোধকামীতা বজায় রাখেন, নামাজ কায়েম করেন ও আল্লাহর দেয়া রিজিক হতে গোপনে ও প্রকাশ্যে দান করেন এবং নানা সৎ কাজের মাধ্যমে অসৎ ও মন্দ বিষয়গুলো দূর করেন।

সুরা রাদের ২৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর দিকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের সম্পর্কে বলেছেন, (২৮) 'তারা সেসব লোক যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের চিত্ত আল্লাহর স্মরণে প্রশান্তি লাভ করে; জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণেই চিত্ত প্রশান্ত হয়।'

আল্লাহর স্মরণই প্রশান্তি আনে। আল্লাহকে স্মরণ বলতে কেবল মুখেই আল্লাহর নাম নেয়া বোঝায় না। আল্লাহর মহত্ত্বগুলোকে সমগ্র হৃদয় দিয়ে অনুভব করলে সর্বোচ্চ প্রশান্তি অর্জিত হয়। প্রশান্তি ও উদ্বেগ মানুষ এবং সমাজ-দেহের নানা সংকট বা রোগ ও সৌভাগ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। দয়াময় ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর ভরসা মানুষকে করে নিরুদ্বিগ্ন ও প্রশান্ত।

সুরা রাদের শেষ আয়াতে বলা হয়েছে, ' (৪৩) যারা অবিশ্বাস করেছে তারা বলে, ‘তুমি আল্লাহর রাসূল নও।’ তুমি বল, ‘আমার ও তোমাদের মধ্যে (রেসালাতের) সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট এবং সেই ব্যক্তি যার কাছে পূর্ণ গ্রন্থের জ্ঞান রয়েছে।’

কাফিররা সব সময়ই নানা অজুহাত তুলতো ও প্রায়ই নানা অলৌকিক ঘটনা দেখানোর দাবি করত বিশ্বনবী (সা.)'র কাছে। আর নানা মু'জিজা দেখার পরও বলত, তুমি আল্লাহর রাসুল নও! এর জবাবে আল্লাহ বলছেন, রেসালাতের সাক্ষী হিসেবে আল্লাহ এবং 'পূর্ণ গ্রন্থের জ্ঞানধারী' ব্যক্তিই যথেষ্ট।কাফিররা যদি সত্যকে মেনে নেয়ার ব্যাপারে সৎ-সাহসী হত তাহলে তারা কুরআনকে দেখেই বুঝতে পারত যে এই মহাগ্রন্থ যাঁর কাছে আছে তিনি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল এবং ভুলভ্রান্তিহীনতাসহ বহু অলৌকিকতায় সমৃদ্ধ কুরআন আল্লাহর বাণী ছাড়া অন্য কারো বাণী হতে পারে না।

বেশিরভাগ তাফসীরকারকের মতে এই আয়াতে বর্ণিত 'পরিপূর্ণ কুরআনের জ্ঞানধারী' ব্যক্তি হলেন হযরত আলী (আ.)। যেমন আসমী ‘যায়নুল ফাতা’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এবং সা’লাবী আবদুল্লাহ ইবনে আতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আবদুল্লাহ বিন সালাম বলতেন, ‘যার কাছে পূর্ণ গ্রন্থের জ্ঞান আছে’-এর উদ্দিষ্ট হযরত আলী (আ.)। এজন্যই হযরত আলী (আ.) বারবার বলতেন, ‘আমার মৃত্যুর আগেই তোমাদের যত প্রশ্ন আছে তা আমার কাছে জেনে নাও।’(তাফসীরে দুররে মানসুর, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৯) মনে রাখা জরুরি যে, আয়াতটি হিজরতের আগে মক্কায় নাজিল হয়েছিল। তাই আয়াতটির উদ্দিষ্ট মদীনার অধিবাসী আহলে কিতাবের কোন ব্যক্তি, যেমন আবদুল্লাহ বিন সালাম বা অন্য কেউ হতে পারে না। নিঃসন্দেহে আলী (আ.) ছাড়া অন্য কারও কাছে কিতাবের পূর্ণ জ্ঞান ছিল না যা তিনি রাসূল (সা.) এর কাছ থেকে অর্জন করেছিলেন।-প্যারিস টুডে
১৫ জুলাই, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে