সোমবার, ২৫ জুলাই, ২০১৬, ০২:২৫:৩১

সন্ত্রাস ও জঙ্গি নির্মূলে করণীয়

সন্ত্রাস ও জঙ্গি নির্মূলে করণীয়

এম এ মান্নান: সন্ত্রাস ও জঙ্গি নির্মূলের লক্ষ্যে আমাদেরকে নবী কারীম (সা.) এর জীবন থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সন্ত্রাস ও জঙ্গি নির্মূলে তিনি যে ফর্মূলা বা কৌশল অবলম্বন করেছিলেন আমরাও যদি সে পথ  অনুসরণ করি তবে উহা সমাজ থেকে দূর করা সম্ভব। আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর আবির্ভাবের পূর্বে আরবে যেসব নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কর্মকান্ড সংগঠিত হয়েছিল তা সকল যুগের সকল সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও বর্বরতাকে হার হানায়। অথচ নবীজি (সা.) তা জয় করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি যে নীতি অবলম্বন করে ঐগুলোর মূলোৎপাটন করেছিলেন আমাদেরকেও সেই নীতি অবলম্বন করতে হবে। তাছাড়া সন্ত্রাস ও জঙ্গি কর্মকান্ড রোধ করা সম্ভব নয়। আরবের বড় বড় সন্ত্রাসীরা নবীর নীতির সামনে মাথানত করে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বর্জন করত: ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিল। হেন কোন মন্দ কাজ নেই যা তারা করেনি। জুলুম নির্যাতন, চুরি ডাকাতি, ছিনতাই রাহাজানি, ব্যভিচার ও হত্যার মত জঘন্য সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সে সময় অহরহ সংঘটিত হতো। ঐসব জুলুম ও অন্যায় অত্যাচার নির্মূলের লক্ষ্যেই আমাদের প্রিয়নবী (সা.)’র আবির্ভাব ঘটে। নবুয়্যত প্রাপ্তির পরে নয় শুধু পূর্বেও তিনি ছিলেন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আপোসহীন। জানা যায়, একবার বাহির থেকে এক ব্যক্তি কিছু জিনিস বিক্রি করতে মক্কায় এসেছিল। তারপর আস ইবনে ওয়ায়েল তার নিকট থেকে তা খরিদ করে মূল্য পরিশোধ না করলে বিক্রেতা আব্দুদ দার মাখজুম, জামিহ, সাহাম ও আদীর নিকট সাহায্যের আবেদন জানায়। কিন্তু তারা কেউই বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেননি। তখন ঐ ব্যক্তি আবু কুবাইস পাহাড়ের চূড়ায় ওঠে উচ্চ আওয়াজে তাকে অত্যাচারের কথা কবিতার ভাষায় বর্ণনা করছিল। এতে জুবায়ের ইবনে আব্দুল মুত্তালিব চতুর্দিকে ছুটাছুটি করে বলছিলেন যে, এই লোকটির কি কোন সাহায্যকারী নেই? তখন কুরাইশ তথা বনু হাশেম, বনু মুত্তালিব, বনু আসাদ, বনু যুহরা ও বনু তাইমসহ বেশ কয়েকটি গোত্র মিলে আরবের জালিমদের বিরুদ্ধে ‘হিলফুল ফুযুল’ নামে যে সংগঠন গড়ে তুলেছিল বিশ বছর বয়সী যুবক মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন তাঁদের অন্যতম। ঐ সংগঠনের মাধ্যমে তিনি সন্ত্রাস ও যাবতীয় মন্দ কাজের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলেন।

ঐ সংগঠনের একটি অন্যতম শর্ত ছিল যে- মক্কা নগরীতে দেশি বা বিদেশি কারো উপর কোন প্রকার জুলুম করা হবে না। করলে জালিম ব্যক্তিকে কোন প্রকার ছাড় দেয়া হবে না। মজলুমকে সাহায্য করতে জালিমের বিরুদ্ধে সকলে ঐক্যবদ্ধ থাকবে। জালিম বা অত্যাচারী ব্যক্তি উঁচু শ্রেণীর নাকি নিচু? স্থানীয় নাকি বিদেশী? তা বিবেচনা করা হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত মজলুমের হক আদায় না হবে। এভাবে সমাজ থেকে অন্যায় অত্যাচার ও সন্ত্রাস দমনে নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভূমিকা রাখেন। কাফিরদের অত্যাচারে তিনি নিজে মক্কা ত্যাগ করেন। মদীনায় গিয়ে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে সেখানের লোকদের সাথে তিনি একটি চুক্তি সম্পাদন করেন যা Charter of Madina বা মদীনা সনদ নামে খ্যাত। ৪৭টি ধারা সম্বলিত এ সনদ সন্ত্রাস প্রতিরোধের এক অনন্য দলিল। এ সনদের একটি ধারা হল- তাকওয়া অবলম্বনকারী ধর্মপ্রাণ বিশ্বাসী ব্যক্তির বিরুদ্ধে যে  অবস্থান নিবে, যারা বিদ্রোহী হবে অথবা বিশ্বাসীদের মধ্যে অন্যায় পাপাচার, সীমালঙ্ঘন, বিদ্বেষ কিংবা দুর্নীতি ও ফাসাদ ছড়িয়ে দিতে তৎপর হবে, সকলে সমভাবে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে যদিও সে তাদেরই আপন পুত্রও হয়ে থাকে। ঐতিহাসিক মদীনা সনদে সন্ত্রাস নির্মূলের জন্য বেশকিছু ধারা ছিল। যেমন- ১. মদীনায় রক্তক্ষয় এবং অন্যায় নিষিদ্ধ করা হল। ২. চুক্তিবদ্ধ কোন সম্প্রদায়ই বাহিরের কোন শত্রুর সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারবে না। ৩. অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি ভোগ করতে হবে। ৪. মুসলিম ও অমুসলিম বিভিন্ন সম্প্রদায় স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। কেউ কারো ব্যক্তিগত ধর্মীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না ইত্যাদি। এসব ধারা অনুসরণ করা হলে ফলাফল পাওয়া যাবে। সন্ত্রাস, গোঁড়ামী, এক গুঁয়েমি ইসলাম সমর্থন করে না। সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও প্রতিশোধ নেয়ার নীতি ইসলাম শিক্ষা দেয়নি। ইসলাম ত্যাগ ও ছাড়ের শিক্ষা দেয়, সবর ও ক্ষমার শিক্ষা দেয়। দেশে বা সমাজে সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কর্মকান্ড সংগঠিত হলে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে তা প্রতিহত করার নীতি শিক্ষা দেয়। সন্ত্রাসী কর্মকান্ড প্রতিরোধ ও প্রতিহত করার পাশাপাশি কেন উহা ঘটে তা খুঁজে বের করতে হবে। তাহলে উহা  প্রতিরোধের পদক্ষেপ যথাযথভাবে গ্রহণ করা সহজ হবে। ইংরেজিতে বলা হয় ‘চৎবাবহঃরড়হ রং নবঃঃবৎ ঃযধহ পঁৎব.’ অর্থাৎ রোগ সারানোর চেয়ে রোগের প্রতিরোধই আগে প্রয়োজন। সন্ত্রাস দূরীকরণে প্রতিরোধমূলক নিন্মের কয়েকটি ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে- এক. কৌশলে বুঝানো যেতে পারে। সন্ত্রাসী ও চরমপন্থীদের হিংসা না করে বা হুমকি না দিয়ে তাদের উপলব্ধিতে পরিবর্তন আনা যেতে পারে। অপরাধের ক্ষতির দিকগুলো তুলে ধরে তাদের মধ্যে অপরাধ বিরোধী মানসিকতা গঠন করা যেতে পারে। ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাসীরা যে ভুলপথে আছে এ কথা তাদের আন্তরিকতার সাথে বুঝাতে হবে। তাদেরকে দমন করতে গিয়ে এমন কঠোর পন্থা অবলম্বন করা যাবে না, যাতে চরমপন্থা বেড়ে যায়। দুই. প্রথমে মতৈক্যের সূত্র ধরে আলোচনা শুরু করতে হবে। নবী করীম (সা.) পাপাচারীকে চিকিৎসকের দৃষ্টিতে দেখতেন যেমন রোগীকে দেখা হয়। পুলিশের মত করে তিনি দেখতেন না। অন্ধকারকে অভিশাপ দেয়ার পরিবর্তে আমাদের উচিৎ রাস্তায় বাতি লাগানোর চেষ্টা করা। তিন. সন্ত্রাস খুবই নিন্দনীয় ও গুরুতর অপরাধ। অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যার ব্যাপারে ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা করেছে। সূরা নিসার ৯৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে- যে ব্যক্তি জেনেশুনে কোন মুমিনকে হত্যা করবে তার শাস্তি জাহান্নাম। চিরদিন সে সেখানে থাকবে। তার প্রতি আল্লাহর গজব ও লা’নত। তার জন্য ভয়াবহ শাস্তি প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। চার. ত্বরিত ফলাফল লাভের চিন্তা কাম্য নয়। আজ ফসল বোনে কালই কাটতে যাওয়া যেমন বোকামী তেমনি সন্ত্রাসীরা দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যাবে তেমনটি ভাবাও বোকামী। সুপরিকল্পিত ও সুচিন্তিত কৌশল সহকারে জাতীয় সংশোধনে সচেষ্ট হতে হবে। পরিকল্পনাবিহিন কেবল জীবন কুরবানী করলেই লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে না। পাঁচ. ইসলাম নির্দেশিত পন্থা অবলম্বন জরুরি। এ প্রসঙ্গে হযরত উমর (রা.) বলেন, আমরা নিকৃষ্ট জাতি ছিলাম। আল্লাহ আমাদেরকে ইসলাম দিয়ে সম্মানিত করেছেন। যদি আমরা ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য পন্থায় সম্মানিত হতে চাই তবে আল্লাহ আমাদের গোড়া কেটে দিবেন। ছয়. ইনসাফ বা ন্যায় বিচারভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কোন গোষ্ঠীর একজন বা দুইজন কোন অন্যায় করলে সেই গোষ্ঠীর সকলের উপর দোষ চাপানো যাবে না। সূরা আনয়ামের ১৬৪ নং আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, কেউ অন্য কারো ভার গ্রহণ করবে না। তাছাড়া ঘটনা ভাল করে না জেনে রায় দেয়ার প্রবণতাও পরিহার করতে হবে। আমাদের কথাবার্তায় ও আচরণে ভারসাম্যপূর্ণ, সুবিবেচক ও উদার হতে হবে। অতিশয়োক্তি বা ত্রাস সৃষ্টিকারী কথা পরিহার করতে হবে। সাত. এক গুঁয়েমির দ্বারা এক গুঁয়েমি, গোঁড়ামীর দ্বারা গোঁড়ামী এবং অপকর্মের দ্বারা অপকর্মের মোকাবিলা করার পথ পরিহার করতে হবে। সূরা হা-মীম- সিজদার ৩৪ নং আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ভাল ও মন্দ সমান নয়। যা উৎকৃষ্ট তা দিয়ে মন্দকে প্রতিহত করুন। ফলে আপনার সাথে যার শত্রুতা আছে সে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত হয়ে যাবে। আট. আইনের দৃষ্টিতে সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ন্যায়নিষ্ঠ বিচার ব্যবস্থার অনুপস্থিতিই মূলত: সন্ত্রাস সৃষ্টির মূল কারণ। নয়. সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তরূণদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। তাদের মন মানসিকতা ও বাস্তবতা উপলব্ধি করে কথা বলতে হবে। তাদের শুধু দোষ ধরলে চলবে না, তাদের গুণগুলোকে বিকশিত করতে হবে। ইসলাম বিরোধী সকল কাজের নিষেধ ও প্রয়োজনে বাধা দান করতে হবে। তবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে যেন বৃহত্তম ফিৎনা সৃষ্টি না হয়, মুসলমানদের অযথা রক্তপাত যেন না হয় এবং স্থিতিশিীলতা যেন নষ্ট না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। ফিৎনা বৃদ্ধিকারী  প্রতিবাদের চেয়ে নীরবতাই শ্রেয়। অপরাধীদের সৎ ও ভাল মানুষের সাহচর্যে এবং নীতি নৈতিকতার পরিবেশে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে তাদের চারিত্রিক পরিবর্তন আশা করা যেতে পারে। দশ. এতসব ফ্যাসিলিটি দেয়ার পরও যদি তারা সংশোধন না হয় তবে তাদের জন্য কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নির্ধারিত শাস্তি দিতে হবে। জনসমক্ষে শাস্তি দিতে হবে যাতে অন্যায়কারীর মনে ভীতির সঞ্চার হয়। এগার. সন্ত্রাসের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোরও মূলোৎপাটন করতে হবে।  ব্যভিচার, ইভটিজিং, সুদ ঘুষ আদান প্রদান, চুরি ডাকাতি, জুলুম অত্যাচার নির্যাতন নিষ্পেষণ ইত্যাদি সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অংশ। এগুলো যারা করে তারা সন্ত্রাসী। দায়িত্বশীলদেরকে এসব অপকর্মকান্ড বন্ধ করতে হবে। বুখারী শরীফের ২৯৩৯ নং হাদীসে আছে, নবী করীম (সা.) বলেন, নিশ্চয়ই নিকৃষ্ট দায়িত্বশীল হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে তার অধীনস্তদের প্রতি অত্যাচার করে। এসব সন্ত্রাসীদের শাস্তির ব্যাপারে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআন শরীফে যে নীতিমালা দিয়েছেন তা অনুসরণ করা জরুরী। তা নাহলে সন্ত্রাস বন্ধ হবে না। সূরা মায়িদার ৩৩ নং আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায় তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শুলিতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হাত পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা হবে অথবা তাদেরকে দেশ থেকে নির্বাসন করা হবে। এটি হল তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। কুরআনের এই নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদী কর্মকান্ড নির্মূল হবে। দেশ ও সমাজে নেমে আসবে বেহেশতী শান্তি।
লেখক: প্রিন্সিপাল, এক্সিলেন্ট স্কুল এন্ড মাদরাসা,
ডিগ্রি কলেজ রোড, ফুলপুর, ময়মনসিংহ।
ও খতীব, দিউ বায়তুস সালাম জামে মসজিদ, ফুলপুর
২৫ জুলাই ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে