২২ বছর কারাবন্দী সেই ফজলু মিয়ার পরিবারের খোঁজ
জামালপুর প্রতিনিধি : দীর্ঘ ২২ বছর বিনাদোষে কারাভোগের পর অবশেষে মিলল ফজলু মিয়ার প্রকৃত অভিভাবকের খোঁজ। সিলেট কারাগারে বন্দিজীবন কেটেছে নিরপরাধ ফজলু মিয়ার। দু’বার আদালত ফজলু মিয়াকে মুক্তির আদেশ দিলেও প্রকৃত অভিভাবকের অভাবে মুক্তি দিতে পারেননি কারা কর্তৃপক্ষ।
ফজলু মিয়াকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে স্থানীয় সাবেক এক জনপ্রতিনিধির জিম্মায় মুক্তি দেয় আদালত।
জামালপুর জেলার সদর উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নের সাউনিয়া গ্রামের মৃত বিশু মিয়া ও মজিরন বেওয়ার একমাত্র ছেলে ফজলু মিয়া। গত কয়েকদিন ধরে ফজলু মিয়াকে নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে তার ছবি দেখে নিশ্চিত করে তার পরিবার।
ফজলু মিয়ার পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ফজলু মিয়া জামালপুর সদর উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নের মৃত বিশু মিয়া এবং বাকপ্রতিবন্ধী মজিরন বেওয়ার একমাত্র ছেলে। তাদের এক মেয়েও রয়েছে। তার নাম হামিদা বেগম।
১৯৭৮ সালের কোনো এক সময় ফজলু মিয়া কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে চলে যায়। ১৯৮৪/৮৫ সালের দিকে ফজলুর মামা আব্দুল হালিম ঢাকায় বেড়াতে গিয়ে গুলিস্তানের একটি মনোহারি দোকানে ফজলুকে দেখতে পান।
ওই সময় তাকে ফজলু জানিয়েছিলেন, সিলেটের সৈয়দ গোলাম মাওলার মালিকানাধীন দোকানে তিনি কাজ করছেন। দোকান মালিক গোলাম মাওলার কোনো সন্তান না থাকায় ফজলু মিয়াকে ছেলে বানিয়েছে। পরে ১৯৮৭ সালে গোলাম মাওলাকে সঙ্গে নিয়ে ফজলু মিয়া জামালপুরের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন।
১৯৯০ সালে ফজলু মিয়া একাই তার বাড়িতে এসেছিলেন। এরপর আর কোনো যোগাযোগ করেননি তিনি। তবে দুই-এক বছর পর ফজলুর খোঁজ করতে তার মামা আব্দুস ছাত্তার সিলেটের সুরমা থানার ধরাধরপুর এলাকার গোলাম মাওলার মীর বাড়িতে যান তিনি।
সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, দোকান মালিক গোলাম মাওলা ও তার স্ত্রী মারা গেছেন। তাদের মৃত্যুর পর ফজলু মিয়া বাড়ি থেকে চলে গেছে। তার খোঁজ-খবর কেউ জানে না। দীর্ঘ সময় কেটে যাওয়ায় ফজলু মিয়ার যখন খোঁজ মিলছিল না পরিবারের সবাই ধরে নিয়েছিলেন যে, ফজলু মিয়া আর বেঁচে নেই। পুত্রশোকে ফজলু মিয়ার বাকপ্রতিবন্ধী ৮০ বছর বয়সী মা মজিরন বেওয়া কেঁদে হারিয়েছেন চোখের দৃষ্টি। মানসিক ভারসাম্যও হারিয়েছেন তিনি।
গত কয়েকদিন ধরে টিভি ও পত্রপত্রিকায় ফজলু মিয়ার ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তার স্বজনদের বিষয়টি জানান এক প্রতিবেশি। এরপর ফজলু মিয়ার স্বজনরা সেই পত্রিকার প্রতিবেদনের কপিটি সংগ্রহ করে নিশ্চিত হয় যে, ছবিটি তাদের ফজলু মিয়ার।
এদিকে স্বজনদের কাছে ছেলে বেঁচে থাকার খবর জানতে পেরে বৃদ্ধা মা ছেলেকে ফিরে পাবার আকুতি নিয়ে স্বজনদের কাছে ছুটে যাচ্ছেন। নিখোঁজ ফজলু মিয়ার সন্ধান পাওয়ার খবরে প্রতিদিন ফজলু মিয়ার বাড়িতে ভিড় করছে অসংখ্য মানুষ।
এ ব্যাপারে ফজলু মিয়ার মামা আব্দুল হালিম জানান, ৩০-৩৫ বছর আগে ফজলু না বলেই বাড়ি থেকে চলে যায়। এরপর দুই-একবার বাড়িতে আসলেও আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম সে আর বেঁচে নেই।
বিনাঅপরাধে ২২ বছর কারাবন্দি জীবন কাটানো ফজলু মিয়াকে ফিরে পেতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চেয়েছেন তার বৃদ্ধা মা। পাশাপাশি স্থানীয়রা এ ব্যাপারে পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম এমপির সহযোগিতা কামনা করেছেন।
এ বিষয়ে জামালপুর জেলা প্রশাসক মো. শাহাবুদ্দিন খান জানান, ফজলু মিয়ার খোঁজ নিতে সিলেটে যোগাযোগ করা হচ্ছে। ফজলু মিয়াকে তার স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দিতে সবধরনের সহযোগিতা করা হবে বলে জানান তিনি।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমার ধরাধরপুরের সহকারী পোস্ট মাস্টার নিঃসন্তান সৈয়দ গোলাম মাওলার মীর বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলেন ফজলু মিয়া। ফজলু মিয়াকে সন্তানের মত দেখতেন মাস্টার সাহেব। কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি মানসিক ভারসাম্যহীন ফজলু মিয়ার।
১৯৯৩ সালে নগরীর কোর্ট পয়েন্ট এলাকা থেকে ফজলু মিয়াকে আটক করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয় পুলিশ। ২০০২ সালে আদালত খালাসের নির্দেশ দিলেও মুক্ত করতে তার পক্ষের কোনো লোক না আসায় কারাগারই হয় তার ঠিকানা।
দীর্ঘ ২২ বছর পর আইনি সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা ব্লাস্টের সহায়তায় গত বৃহস্পতিবার সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তির পর তেতলি ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের একটি কক্ষে আশ্রয় হয় ফজলু মিয়ার।
২১ অক্টোবর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/প্রতিনিধি/এমআর