বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৫, ০৬:৪৫:২৫

বিনাদোষে ২২ বছর, ২৫ বছর পর পরিবারের সাথে কথা

বিনাদোষে ২২ বছর, ২৫ বছর পর পরিবারের সাথে কথা

জামালপুর প্রতিনিধি : দীর্ঘ ২২ বছর বিনাদোষে কারাভোগের পর ফজলু মিয়ার প্রকৃত অভিভাবকের খোঁজ মিলেছে। খোঁজ মেলার প্রায় ২৫ বছর পর পরিবারের সদস্যদের সাথে মুঠোফোনে কথা হয়েছে তার। তাদের পরিচয় নিশ্চিত করতে বৃহস্পতিবার জামালপুর জেলা প্রশাসক নিজ বাসায় ফজলুর পরিবারের সদস্যদের ডেকে এনে সিলেটে অবস্থানরত ফজলু মিয়ার সঙ্গে ফোনে কথা বলান। ফজলু মিয়ার পরিবার সাংবাদিকদের জানান, বুধবার বিকেলে জামালপুর জেলা প্রশাসক মো. শাহাবুদ্দিন খান তার বাসায় ডেকে এনে মুঠোফোনে ফজলু মিয়ার পরিচয় নিশ্চিত করতে কথা বলতে বলেন। আজ সকালে ফজলু মিয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে ফজলু মিয়ার মামা আব্দুল হালিম, আব্দুস ছাত্তার, মফিজ উদ্দিন, নানা মৌলভী হাসমত উল্লাহ এবং ভগ্নিপতি মন্টু মিয়া জেলা প্রশাসকের বাসায় এসে ফজলু মিয়ার পরিচয় নিশ্চিত করতে সিলেটের সুরমা থানার তেতুলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেন। মুঠোফোনে পরিবারের সদস্যরা নিজেদের নাম উল্লেখ করে চিনতে পারছে কিনা জানতে চাইলে ফজলু মিয়া অস্পষ্ট ভাষায় চিনতে পারছেন বলে স্বীকার করেন। ফজলু মিয়ার সঙ্গে কথা বলতে পেরে পরিবারের সদস্যরা স্বস্তিবোধ করেন। এ সময় ফজলু ছাড়াও তেতুলী ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার কামাল উদ্দিন রাসেল, জামিন আবেদনকারী দুই আইনজীবী জোস্না ইসলাম ও ইরফানের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেন জামালপুর জেলা প্রশাসকসহ ফজলু মিয়ার পরিবারের সদস্যরা। ফজলুর পরিবার জেলা প্রশাসককে জানিয়েছে, আজ বিকেলেই আব্দুস ছাত্তার ও মফিজ উদ্দিন সিলেটে ফজলু শিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। সেখান গিয়ে তারা ফজলুকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে নিশ্চিত হলে আগামী শনিবার ফজলুর মা মজিরন বেওয়াসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও সিলেটে যাবেন। ফজলুর মামা আব্দুল হালিম জানান, আমাদের ধারণা ছিল ফজলু মারা গেছে, কিন্তু আজ ২৫/২৬ বছর পর ওর সঙ্গে কথা বলে স্বস্তিবোধ করছি। এ বিষয়ে জামালপুর জেলা প্রশাসক মো. শাহাবুদ্দিন খান জানান, ফজলুর পরিচয় নিশ্চিত করতে তার পরিবারের সদস্যদের বাসায় ডেকে আনা হয়েছিল। তারা মুঠোফোনে সিলেটে অবস্থানরত ফজলুর সঙ্গে কথা বলেছে। প্রাথমিকভাবে ফজলুর পরিচয় নিশ্চিত হয়েছে তারা। ফজলুকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে বলে জানান তিনি। উল্লেখ্য, দীর্ঘ ২২ বছর বিনাদোষে কারাভোগের পর মুক্তি পান ফজলু মিয়া। সিলেট কারাগারে বন্দিজীবন কেটেছে নিরপরাধ ফজলু মিয়ার। দু’বার আদালত ফজলু মিয়াকে মুক্তির আদেশ দিলেও প্রকৃত অভিভাবকের অভাবে মুক্তি দিতে পারেননি কারা কর্তৃপক্ষ। ফজলু মিয়াকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে স্থানীয় সাবেক এক জনপ্রতিনিধির জিম্মায় মুক্তি দেয় আদালত। জামালপুর জেলার সদর উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নের সাউনিয়া গ্রামের মৃত বিশু মিয়া ও মজিরন বেওয়ার একমাত্র ছেলে ফজলু মিয়া। গত কয়েকদিন ধরে ফজলু মিয়াকে নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে তার ছবি দেখে নিশ্চিত করে তার পরিবার। ফজলু মিয়ার পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ফজলু মিয়া জামালপুর সদর উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নের মৃত বিশু মিয়া এবং বাকপ্রতিবন্ধী মজিরন বেওয়ার একমাত্র ছেলে। তাদের এক মেয়েও রয়েছে। তার নাম হামিদা বেগম। ১৯৭৮ সালের কোনো এক সময় ফজলু মিয়া কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে চলে যায়। ১৯৮৪/৮৫ সালের দিকে ফজলুর মামা আব্দুল হালিম ঢাকায় বেড়াতে গিয়ে গুলিস্তানের একটি মনোহারি দোকানে ফজলুকে দেখতে পান। ওই সময় তাকে ফজলু জানিয়েছিলেন, সিলেটের সৈয়দ গোলাম মাওলার মালিকানাধীন দোকানে তিনি কাজ করছেন। দোকান মালিক গোলাম মাওলার কোনো সন্তান না থাকায় ফজলু মিয়াকে ছেলে বানিয়েছে। পরে ১৯৮৭ সালে গোলাম মাওলাকে সঙ্গে নিয়ে ফজলু মিয়া জামালপুরের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। ১৯৯০ সালে ফজলু মিয়া একাই তার বাড়িতে এসেছিলেন। এরপর আর কোনো যোগাযোগ করেননি তিনি। তবে দুই-এক বছর পর ফজলুর খোঁজ করতে তার মামা আব্দুস ছাত্তার সিলেটের সুরমা থানার ধরাধরপুর এলাকার গোলাম মাওলার মীর বাড়িতে যান তিনি। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, দোকান মালিক গোলাম মাওলা ও তার স্ত্রী মারা গেছেন। তাদের মৃত্যুর পর ফজলু মিয়া বাড়ি থেকে চলে গেছে। তার খোঁজ-খবর কেউ জানে না। দীর্ঘ সময় কেটে যাওয়ায় ফজলু মিয়ার যখন খোঁজ মিলছিল না পরিবারের সবাই ধরে নিয়েছিলেন যে, ফজলু মিয়া আর বেঁচে নেই। পুত্রশোকে ফজলু মিয়ার বাকপ্রতিবন্ধী ৮০ বছর বয়সী মা মজিরন বেওয়া কেঁদে হারিয়েছেন চোখের দৃষ্টি। মানসিক ভারসাম্যও হারিয়েছেন তিনি। গত কয়েকদিন ধরে টিভি ও পত্রপত্রিকায় ফজলু মিয়ার ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তার স্বজনদের বিষয়টি জানান এক প্রতিবেশি। এরপর ফজলু মিয়ার স্বজনরা সেই পত্রিকার প্রতিবেদনের কপিটি সংগ্রহ করে নিশ্চিত হয় যে, ছবিটি তাদের ফজলু মিয়ার। এদিকে স্বজনদের কাছে ছেলে বেঁচে থাকার খবর জানতে পেরে বৃদ্ধা মা ছেলেকে ফিরে পাবার আকুতি নিয়ে স্বজনদের কাছে ছুটে যান। নিখোঁজ ফজলু মিয়ার সন্ধান পাওয়ার খবরে প্রতিদিন ফজলু মিয়ার বাড়িতে ভিড় করছে অসংখ্য মানুষ। এ ব্যাপারে ফজলু মিয়ার মামা আব্দুল হালিম জানান, ৩০-৩৫ বছর আগে ফজলু না বলেই বাড়ি থেকে চলে যায়। এরপর দুই-একবার বাড়িতে আসলেও আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম সে আর বেঁচে নেই। অবশেষে খোঁজ মিলল তার। ১৯৯৩ সালে সিলেট নগরীর কোর্ট পয়েন্ট এলাকা থেকে ফজলু মিয়াকে আটক করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয় পুলিশ। ২০০২ সালে আদালত খালাসের নির্দেশ দিলেও মুক্ত করতে তার পক্ষের কোনো লোক না আসায় কারাগারই হয় তার ঠিকানা। দীর্ঘ ২২ বছর পর আইনি সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা ব্লাস্টের সহায়তায় গত বৃহস্পতিবার সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তির পর তেতলি ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের একটি কক্ষে আশ্রয় হয় ফজলু মিয়ার। ২১ অক্টোবর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/প্রতিনিধি/এমআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে