সোমবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪, ০৪:৩৪:৫৬

বাম পা দিয়ে লিখে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে সিয়াম

বাম পা দিয়ে লিখে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে সিয়াম

মমিনুল ইসলাম কিসমত, সরিষাবাড়ি, জামালপুর :  দুই হাত নেই, বাম পা দিয়ে লিখে চলমান এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে অদম্য শারীরিক প্রতিবন্ধী সিয়াম। অভাব, দরিদ্রতা ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে ইচ্ছা আর মনোবল নিয়েই এগুতে চায় সে। জন্মের পর থেকে দুটি হাতবিহীন জীবন সংগ্রামে নেমেছে হতদরিদ্র পরিবারে প্রতিবন্ধী এই কিশোর। মনে বিন্দুমাত্র নেই কোনো হতাশা।

হতে চায় সে সরকারি বড় কোনো কর্মকর্তা। তাই উচ্চ শিক্ষা চালিয়ে যেতে সমাজের বিত্তবান ব্যক্তি বা সরকারিভাবে সহায়তা কামনা করেন সিয়াম ও তার পরিবার।

বিদ্যালয় ও পরিবার সূত্রে জানা গেছে, জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার ডোয়াইল ইউনিয়নের উদনাপাড়া গ্রামের দিনমজুর দম্পতি জিন্না মিয়া ও জোসনা বেগমের ছেলে সিয়াম। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে সিয়াম ছোট।

জন্ম থেকেই তার দুটি হাত নেই। কিন্তু থেমে নেই তার পড়ালেখা ও খেলাধুলা। তবে পরিবারের অর্থনৈতিক সংকটের কারণে প্রাথমিকের মাঝ পথে বন্ধ হয়ে যায় তার পড়ালেখা। বিদ্যালয় থেকে বেতন মওকুফ করলে পুনরায় পড়ালেখা শুরু করে সিয়াম।

২০১৮ সালে ব্র্যাক শিশু নিকেতন স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে একই ইউনিয়নের চাপারকোনা উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয় সে। এরপর কৃতিত্বের সঙ্গে জেএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় সিয়াম। সে এবার ডোয়াইল ইউনিয়নের চাপারকোনা মহেশ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে।

সরজমিনে স্থানীয় মুজিবুর রহমান আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে সিয়ামকে পা দিয়ে লিখে বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা দিতে দেখা গেছে তাকে।

পা দিয়ে লিখে পরীক্ষা দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিয়াম বলে, ‘আমার দুই হাত না থাকলেও তাতে আমার কোনো সমস্যা হয় না।

পা দিয়ে লিখতে লিখতে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। আমার সব কাজ আমি নিজেই করতে পারি। আমার বাবা গরিব মানুষ, তার পক্ষে আমাদের ভাই-বোনের পড়ালেখার খরচ চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে আমি লেখাপড়া করতে চাই। লেখাপড়া করে সরকারি বড় একটা কর্মকর্তা হতে চাই। কর্মকর্তা হয়ে দেশের সেবা করতে চাই। বাবা-মায়ের দুঃখ ঘোচাতে চাই। সমাজের বিত্তবান ও সরকারের সহযোগীতা পেলে আমার পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারতাম।’

সিয়ামের মা জোসনা বেগমের সাখে কথা হলে তিনি বলেন, ‘লেখাপড়ার জন্য সিয়ামকে কখনো বলতে হয় না। নিজের ইচ্ছায় সব সময় পড়ালেখা করে। কিছু কিছু কাজ ছাড়া সব কাজ নিজেই করতে পারে। সাঁতার কাটা থেকে শুরু করে সা ধরনের খেলাধুলাও করতে পারে। 

অর্থের অভাবে ছেলেকে কখনো ভালো কিছুই খাওয়াতে বা পরাতে পারি না। সিয়ামসহ তিনটি সন্তানকে পড়ালেখা করানো ওদের বাবার অনেক কষ্টকর হয়ে পড়েছে। সরকারিভাবে কোনো সহায়তা না দিলে সিয়ামের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।’

সিয়ামের সহপাঠীরা বলে, লেখাপড়া, খাওয়া-দাওয়া, ক্রিকেট খেলা, সাঁতার কাটা, মোবাইল ফোন চালানো, টিউবওয়েল চেপে পানি ব্যবহার করাসহ তার নিজের প্রায় সব কাজ সে পা দিয়ে করে থাকে। শ্রেণি কক্ষেও পড়ালেখায় সবার চেয়ে ভালো সে। অনেক শান্ত স্বভাবের ছেলে সিয়াম। ওর আশা পড়ালেখা শেষ করে ভালো একটা চাকরি করার।

প্রতিবেশীরা জানান, সিয়াম গরিব ঘরের ছেলে। পড়ালেখা করার অনেক ইচ্ছা তার। পা দিয়ে লেখেই বিগত দিনে ভালো রেজাল্ট করেছে সে। এসএসসি পরীক্ষায়ও ভালো করবে। তবে তার বাবার পক্ষে সিয়ামের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

চাপারকোনা মহেশ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ষষ্ঠ শ্রেণিতে এই স্কুলে ভর্তি হয় সিয়াম। পড়ালেখার সকল বেতন মওকুফ করা হয়েছে তার। বিদ্যালয়ে সে নিয়মিত আসা-যাওয়া করত সে। 

আর দশটা ছেলে মেয়েদের চেয়ে সব সময় পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করত সিয়াম। চলতি এসএসসি পরীক্ষায় মানবিক শাখা থেকে পরীক্ষা দিচ্ছে সে। এখানেও ভালো ফলাফল করবে।’ সিয়ামের উচ্চ শিক্ষার জন্য সবার সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।

হরখালি মজিবুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয় পরীক্ষা কেন্দ্রের কেন্দ্র সচিব আবুল কালাম বলেন, ‘শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। ছেলেটি অনেক মেধাবী। পা দিয়েই পরীক্ষা দিচ্ছে। তবে পা দিয়ে লিখলেও তার লেখা অনেক দ্রুত।’

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় কেন্দ্র সচিবকে তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় পরীক্ষা নিতে বলা হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের চেয়ে ৩০ মিনিট তার জন্য বেশি দেওয়া হয়।’ সিয়ামের জন্য তার দপ্তর থেকে সকল সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে বলে তিনি জানান। সিয়ামের জন্য বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান এ শিক্ষা কর্মকর্তা।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে