বাবা-মা সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন একমাত্র ছেলে সাদ্দাম হোসেন পাপন (২৩) ঘরে নেই। তার মোবাইল ফোনে কল দিয়ে সেটি বন্ধ পান। ভাবেন- হয়তো বাইরে গেছে, ফিরে আসবে শিগগিরই। কিন্তু কয়েক মাস পার হলেও ফিরে আসেননি তাদের আদরের সন্তান। ১৪ মে সকালে পাপন রাজধানীর লালবাগের বাসা থেকে বের হওয়ার পর তার সঙ্গে পরিবারের যোগাযোগ একেবারেই বিচ্ছিন্ন।
গুলশান হলি আর্টিজান বেকারি অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলাকারীরা আগে থেকেই বাড়ি থেকে চলে গিয়ে নিখোঁজ ছিল এমন খবর জানার পর পাপনের বাবা মাসুদ ও মা রোখসানা মাসুদ উৎকণ্ঠিত। তাদের সন্তানও তো বাড়ি থেকে কাউকে কিছু না বলে চলে গেছে। কোথায় আছে, কাদের সঙ্গে আছে সে ব্যাপারেও কোনো তথ্য জানা নেই তাদের কাছে।
মা রোখসানা মাসুদ জানান, স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর পাপন হতাশায় ভুগছিল। তার এক ছেলে সন্তান আছে। তাকে নিয়ে পাপন চিন্তিত ছিল। বেকার থাকায় ছোট্ট ছেলেকে কোনোকিছু দিতে না পারার কষ্ট তাকে কুরে কুরে খেত।
রোখসানা বলেন, ‘শুনেছি যারা হতাশাগ্রস্ত থাকে এমন ছেলেদের জঙ্গিরা নিজেদের দলে টানে। জানি না আমার ছেলের কপালে কী ঘটেছে। কোথায় আছে সে।’ শুধু পাপনের পরিবারই নয়, র্যাবের হালনাগাদ নিখোঁজ তালিকায় থাকা অনেক ব্যক্তির পরিবারই জানে না, তাদের স্বজন কোথায় আছে। কেমন আছে। দু-একজন মাঝে মধ্যে ফোন দিয়ে বা মেসেজের মাধ্যমে স্বজনদের জানান, তারা ভালো আছেন। তাদের জন্য দোয়া করতে বলেন।
সাদ্দাম হোসেন পাপনের মা রোখসানা জানান, পাপন প্রায় ৮ বছর আগে নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন প্রেম করে বিয়ে করে। এরপর আর পড়ালেখা নিয়ে এগোতে পারেনি। বিয়ের পর তাদের এক ছেলে সন্তান হয়। সংসারের ২ বছরের মাথায় তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়।
ডিভোর্সের পর পাপন মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। এ কারণে তাকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রেও রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে নিজেই ভালো হওয়ার চেষ্টা করে। রোখসানা বলেন, আমার ছেলে খুব ভালো ছিল। তবে সে একটু খেয়ালিপনা ছিল। যখন যা ইচ্ছা করত তাই করত।
খিলগাঁও চৌধুরীপাড়া থেকে সপরিবারে নিখোঁজ রয়েছেন ডা. খন্দকার রোকন উদ্দিন। গত বছরের জুলাই মাসে স্ত্রী নাঈমা আক্তার, দুই মেয়ে রেজওয়ানা রোকন নাদিয়া ও রামিতা রোকন এবং নাদিয়ার স্বামী সাদ কায়েস শিশিরকে নিয়ে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন।
তারা কোথায় আছেন সেই তথ্য সঠিকভাবে স্বজনরা জানেন না। তবে মাঝেমধ্যে বিদেশী নম্বর থেকে স্বজনদের কারও কারও মোবাইলে ফোন করে কথা বলেন রোকন উদ্দিন। নির্দিষ্ট কোন দেশে আছেন সেই তথ্য দেন না।
শুধু বলেন, কোনো একটা মুসলিম দেশে তারা অবস্থান করছেন এবং সিরিয়া ও ইরাকে যুদ্ধাহত শিশুদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। র্যাবের নিখোঁজ তালিকায় তাদের নাম রয়েছে।
দেড় বছর আগে রাজধানীর কলাবাগান এলাকার এক নারী তার নর্থ সাউথ পড়ুয়া দুই সন্তান ও পুত্রবধূকে নিয়ে সিরিয়ায় গিয়েছেন বলে জানা গেছে। এরা হলেন পান্না শরীফ (৫৫) ও তার দুই সন্তান মহিউদ্দিন শরীফ (৩০) ও রেজোয়ান শরীফ (২৮) এবং মহিউদ্দিন শরীফের স্ত্রী তাসনুভা হায়দার।
পান্না শরীফের বাড়ির কেয়ারটেকার জানান, ম্যাডাম যাওয়ার সময় বলেছেন- তিনি তাদের নিয়ে সিরিয়া যাচ্ছেন। আত্মীয়দের কেউ খোঁজ করলে যেন বলি তারা কুয়াকাটা ঘুরতে গিয়েছেন। আর বাড়ির আশপাশের লোকজন খুঁজলে বলতে বলেছে, তারা মিরপুরে আত্মীয়ের বাড়িতে থাকেন।
পল্টনে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হন জাকির হোসেন : জাকিরের বয়স আনুমানিক ২৮ বছর। তিনি বৈদ্যুতিক বাতির হোল্ডারের ডাইস কারখানায় কাজ করতেন। পড়ালেখা করেননি। তার ২ বছর বয়সের এক মেয়ে রয়েছে। তাদের বাসা যাত্রাবাড়ী থানাধীন দনিয়া বাজার রোডে।
তার বড় ভাই জাহাঙ্গীর বলেন, ‘গত ১৮ জানুয়ারি সকালে পল্টনে যাওয়ার নাম করে বাসা থেকে বের হয় জাকির। এরপর থেকে সে বাসায় ফেরেনি। মোবাইল নম্বরও বন্ধ পাওয়া যায়। তাকে না পেয়ে ২৫ জানুয়ারি যাত্রাবাড়ী থানায় সাধারণ ডায়েরি করি।’
ঠাকুরগাঁওয়ে যাওয়ার কথা বলে বের হন আশরাফুজ্জামান : আশরাফুজ্জামানের বাসা রাজধানীর সূত্রাপুরে। তিনি শ্যামবাজারে ব্যবসা করতেন। তার পালক পিতা আবদুল মালেক জানান, ২০১৫ সালের ৫ এপ্রিল ঠাকুরগাঁওয়ে পাওনা টাকা আনতে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয় আশরাফুজ্জামান (৩২)।
যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ৩/৪ দিন বাসায় যোগাযোগ করার পর আর যোগাযোগ করেনি। তার ফোন বন্ধ। আবদুল মালেক বলেন, ‘ব্যবসা করতে গিয়ে আশরাফুজ্জামান প্রায় ১০ লাখ টাকা ঋণি হয়ে যায়। সে কারণে চলে গেছে কিনা বুঝতে পারছি না।’
মালয়েশিয়ায় হানিমুনের কথা বলে বের হন তাহমিদ দম্পতি : র্যাবের নিখোঁজ তালিকায় তাহমিদ রহমান সাফির (৩০) নাম রয়েছে তিন নম্বরে। সাফি সাবেক নির্বাচন কমিশনার মৃত সফিউর রহমানের ছেলে। বিয়ের আনুমানিক ২ মাসের মধ্যে ২০১৫ সালের ২৩ এপ্রিল স্ত্রী সায়মা খানকে নিয়ে মালয়েশিয়ায় হানিমুনে যাওয়ার কথা বলে ঢাকার নীলক্ষেতের নিকুঞ্জের বাড়ি ত্যাগ করেন সাফি।
যাওয়ার সময় বলেছিলেন মালয়েশিয়ায় হানিমুন শেষ করে ১০ দিনের মধ্যে ঢাকায় ফিরবেন। যাওয়ার পর স্বজনদের কাছে ফোন করে জানান, তারা ঠিকঠাক মতো মালয়েশিয়ায় পৌঁছেছেন। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে দেশে না ফেরায় পরিবারের সদস্যরা রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, তারা মালয়েশিয়ায় যাননি। গেছেন তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে।
এ ঘটনায় ৯ মে উভয় পরিবারের পক্ষ থেকে খিলক্ষেত থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। সেটির তদন্ত কর্মকর্তা খিলক্ষেত থানার এসআই কামাল হোসেন বলেন, মাঝেমধ্যে পরিবারের সদস্যদের কাছে তারা মেসেজ পাঠান। তবে কোথায় আছেন সে ব্যাপারে কিছু জানান না তারা।
শুধু বলেন, তারা ভালো আছেন। গত ৩১ মে তাদের মেয়ে সন্তান হয়েছে সে খবরও জানিয়েছেন স্বজনদের। সাফির ব্যাপারে তার ভাই শাহরুখ সফির কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে কথা বলতে ইন্টারেস্টেড না।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, নিখোঁজদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।-যুগান্তর
১০ আগস্ট ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সবুজ/এসএ