বৃহস্পতিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৬, ০৪:৫৩:৩২

ধানমন্ডি ছাড়তে হবে ২৫০ প্রতিষ্ঠানকে

ধানমন্ডি ছাড়তে হবে ২৫০ প্রতিষ্ঠানকে

মামুনুর রশীদ : ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় রয়েছে ২৫৫টি বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে স্কুল ৫১টি, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ১০টি। এ ছাড়া রাজউকের তালিকা অনুযায়ী হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৪। এগুলোকে সরে যেতে হবে। এটা সর্বোচ্চ আদালতের রায়।

এখন বিপাকে পড়েছেন প্রতিষ্ঠান পরিচালনাকারী ব্যক্তিরা। তাঁরা জানেন না নতুন কোথায় ঠাঁই হবে। এলাকাবাসীও হাতের কাছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায়।

গত শতকের পঞ্চাশের দশকে প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছিল পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা ধানমন্ডি। আশির দশক থেকে এটির আবাসিক চরিত্র ধীরে ধীরে বদলে যেতে শুরু করে। এটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ থেকেই আদালতের শরণ নেওয়া হয়।

গত কয়েক দিনে ধানমন্ডির বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা যায়, রেস্তোরাঁসহ অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নিজেদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এরই মধ্যে জুলাই থেকে চলছে রাজউকের নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান। অননুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলো গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ওই অভিযানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। তবে এখন আপিল বিভাগের রায়ের পর দৃশ্যপট বদলে গেছে।

ঘটনার শুরু ২০১২ সালে। ওই সময় একটি রিটের সূত্র ধরে হাইকোর্ট এক রায়ে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা থেকে অননুমোদিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো সরিয়ে নিতে বলেন। তবে আগে থেকেই বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে ঘোষিত ধানমন্ডি ২, ২৭, সাতমসজিদ রোড ও মিরপুর রোড এর আওতামুক্ত ছিল।

রায় হওয়ার পর রাজউক ধানমন্ডি থেকে সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেয়। এর বিরুদ্ধে আপিল করে ধানমন্ডির সবচেয়ে বড় ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় ম্যাপললিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। চলতি মাসের ১ আগস্ট আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে খারিজ হয়ে যায় সেই আপিল। ফলে রাজউকের নির্দেশই বহাল থাকল—সব প্রতিষ্ঠানকেই সরতে হবে।

এ অবস্থায় এসব প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদে পরবর্তী পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) আসমাউল হোসেন বলেন, ‘রায়ের কপি এখনো আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়নি। রায়ে আদালত কী ধরনের পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সেটা দেখে আমরা করণীয় নির্ধারণ করব।’

২০১২ সালে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন, তাতে ধানমন্ডি এলাকায় ম্যাপললিফ স্কুলের ১১টি শাখা তিন বছরের মধ্যে অন্যত্র সুবিধাজনক জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এখন আপিল বিভাগের ওই রায়ের পর এগুলো সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ম্যাপললিফ কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্কুলটির অধ্যক্ষ আলী কারাম বলেন, ‘ধানমন্ডির ১১টি ক্যাম্পাসে মোট শিক্ষার্থী পাঁচ হাজারের বেশি। এতগুলো শিক্ষার্থী নিয়ে এখন কী করব, কোথায় যাব বুঝতে পারছি না। এ ব্যাপারে এখানকার সব স্কুল মিলে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।’

ধানমন্ডি এলাকায় ৫২টি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ৫০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এতগুলো স্কুলের স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় সরকার কীভাবে সাহায্য করতে পারে জানতে চাইলে আলী কারাম বলেন, ‘হাজারীবাগের ট্যানারি মালিকদের কারখানা স্থানান্তরের জন্য সরকার লম্বা সময় দিয়েছে। সাভারে জমি দিয়েছে। আমাদের জন্যও ব্যাংকঋণসহ এ রকম ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।’

ধানমন্ডি ৭ নম্বর রোডে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল সানিডেল খোলা হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। এটির উপাধ্যক্ষ ইয়াসমিন হামিদ বলেন, ‘আমরা যখন স্কুলগুলো গড়ে তুলেছি, তখন কোনো বাধা দেওয়া হয়নি। আমরা উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, এখান থেকে স্কুলগুলো সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আমাদের যেন যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়।’

আলোকচিত্র ও শিল্পকর্ম প্রদর্শন প্রতিষ্ঠান দৃক গ্যালারিও আছে রাজউকের উচ্ছেদের তালিকায়। প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (পরিচালন) এ এস এম রেজাউর রহমান বলেন, ‘আদালতের সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু সামাজিক কাঠামোতে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটি বাণিজ্যিক হলেও এর অবাণিজ্যিক ব্যবহারও কম নয়। মানুষের বিনোদন, মননশীলতার বিষয়টিও বিবেচনায় আসা উচিত।’

এদিকে ধানমন্ডির ৫ নম্বর সড়কে অবস্থিত ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য আবদুর রব আদালতের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা সাভারে নিজস্ব ক্যাম্পাসে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

৬ নম্বর সড়কে অবস্থিত ‘পেডিহোপ হসপিটাল ফর সিক চিলড্রেন’। এটির কর্তৃপক্ষকে এর মধ্যেই ‘যত দ্রুত সম্ভব’ সরে যাওয়ার জন্য নোটিশ দিয়েছে রাজউক। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ইমরুল খান বলেন, ‘আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু হাসপাতালটি সরিয়ে নেওয়ার জন্য এখন পর্যন্ত বাণিজ্যিক এলাকায় কোনো জায়গা আমরা পাইনি। আমাদের আরও কিছু সময় প্রয়োজন।’

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, একটি বিশুদ্ধ আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে উঠলেও এই মুহূর্তের বাস্তবতা হলো ধানমন্ডি একটি মিশ্র এলাকা। এখানে বসবাসরত মানুষের চাহিদার ভিত্তিতে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও এগুলো যতটা সম্ভব সরিয়ে নিতে হবে। ছোট ছোট কয়েকটি স্কুল থাকতে পারে। তবে সেটা ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা ও আশপাশের শিশুদের জন্য। যাতে স্কুলে আসার জন্য গাড়ির প্রয়োজন না হয়। পর্যায়ক্রমে ইউনিভার্সিটি ও হাসপাতালগুলো সরাতে হবে।

এই প্রক্রিয়ায় সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন মন্তব্য করে এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, রাজউকের দায়িত্ব ছিল ভবন নির্মাণের পর সেগুলো কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটা নজরদারিতে রাখা। তারা সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন এসব প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ কিংবা স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় এটাও লক্ষ রাখতে হবে—এটা যেন কোনোভাবে এখানকার মানুষের ওপর বিরূপ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব না ফেলে। - প্রথম আলো

১১ আগস্ট ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস‌‌‌‌

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে