এনাম আবেদীন : পদবঞ্চিত নেতাদের ক্ষোভ প্রশমনে বিভিন্ন কৌশলে এগোচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আর এ কাজে তাঁকে সহায়তা করছেন তাঁর বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। এদিকে সিনিয়র নেতাদের শান্ত করতে স্থায়ী কমিটিতে পদ বাড়ানোর জন্য খালেদা জিয়ার ওপর চাপ বাড়ছে বলে নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র মতে, সিনিয়র নেতাদের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া ঠেকাতেই স্থায়ী কমিটির তালিকার ১৭ ও ১৮ নম্বর পদ খালি রাখা হয়েছে। উদ্দেশ্য হলো, ওই পদ লাভে আগ্রহী নেতারা যাতে শূন্য ওই পদ পাওয়ার আশায় থাকেন, বিদ্রোহ না করেন। আর এ কারণেই সহসা ওই পদ পূরণের সম্ভাবনাও কম বলে জানা গেছে।
সূত্র মতে, গত মঙ্গলবার রাতে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে গিয়েছিলেন পদবঞ্চিত নেতা মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ। আলাপকালে খালেদা তাঁকেও বলেছেন, স্থায়ী কমিটির দুটি পদ এখনো শূন্য আছে; দেখা যাক কী হয়। অন্যদিকে স্থায়ী কমিটির পদ লাভে আগ্রহী অন্য নেতাদেরও ওই দুটি পদ পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে বলছেন তাঁদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা।
সদ্য ঘোষিত কমিটিতে তালিকার ১৪ নম্বর ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়েছে মেজর (অব.) হাফিজকে। গত ১৭ বছর ধরে তিনি ওই একই পদে আছেন। আলাপকালে খালেদা জিয়াকে তিনি বলেন, বর্তমান স্থায়ী কমিটিতে মাত্র চারজন তাঁর সিনিয়র। গত ২৫ বছর ধরে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত। সম্মান না থাকলে অন্য কোনো দলে যাবেন না; প্রয়োজনে রাজনীতিই ছেড়ে দেবেন।
সূত্র মতে, খালেদা জিয়া ও হাফিজের আলাপের একপর্যায়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও যোগ দেন। ওই আলোচনার সূত্র ধরে তিনিও স্থায়ী কমিটির সদস্যসংখ্যা বাড়ানোর পক্ষে মত দেন বলে জানা যায়। জানতে চাইলে হাফিজউদ্দিন আহমেদ অবশ্য এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘চেয়ারপারসনের সঙ্গে এমনিই আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম।’ পদ বঞ্চনার বিষয়ে কোনো কথা হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।
কাউন্সিলের আগে ও পরে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতার পাশাপাশি তারেক রহমানও সবাইকে ‘সম্পৃক্ত’ করতে স্থায়ী কমিটিতে পদের সংখ্যা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানা যায়। এমনকি গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটির বৈঠকেও এ ধরনের প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু খালেদা জিয়া সম্মত না হওয়ায় গঠনতন্ত্রে তা অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অথচ এখন অন্তত ছয়জন নেতাকে অন্তর্ভুক্ত করা না হলে বিএনপিতে বড় ধরনের বিদ্রোহ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আর তা ঠেকাতে শূন্য দুটি পদের প্রলোভন (নেতাদের মতে মূলা) সবার সামনে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
এদিকে ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা গুলশান কার্যালয়ে গিয়ে যাতে উত্তেজনা ছড়াতে না পারে সে জন্য বেশ কয়েকজন নেতাকে সেখানে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁদের কাজ হলো বড় ধরনের ঘটনা ঘটার আগে বিশেষ করে চেয়ারপারসনের সামনে পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আগে বঞ্চিত নেতাকর্মীদের ‘ব্রিফ’ করে শান্ত করা। আর পরিস্থিতি যাতে জটিল না হয় সে জন্য প্রতিদিন নয়াপল্টনে ব্রিফ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সদ্য যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পাওয়া মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে।
সূত্র মতে, গত দুই দিনে গুলশান কার্যালয়ে তৎপর দুজন নেতার নাম জানা গেছে। তাঁরা হলেন বিএনপির সদ্য ঘোষিত কমিটিতে উপদেষ্টার পদ পাওয়া আবুল খায়ের ভূঁইয়া। দ্বিতীয়জন হলেন প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি। তবে এ্যানির চেয়ে খায়ের ভূঁইয়া গত মঙ্গলবার ছাত্রদলের বিক্ষুব্ধ নেতাদের ক্ষোভ থামাতে বেশি ব্যস্ত ছিলেন। এ ভূমিকা দেখে তাঁর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত সাবেক ছাত্রনেতাদের বড় একটি অংশের ধারণা, মহানগরী বিএনপিতে সম্ভবত বড় কোনো পদ দেওয়ার ‘টোপ’ দিয়ে খায়ের ভূঁইয়াকে গুলশান কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, এ্যানি ও খায়ের দুজনই যুগ্ম মহাসচিব হওয়ার দাবিদার ছিলেন। ভালো ইমেজের সাবেক ছাত্রনেতা এ্যানিকে কমপক্ষে দপ্তর সম্পাদক করা হবে বলে গুঞ্জন ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত পদ না পেয়ে তাঁরা ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু কৌশল করে বুঝিয়ে-শুনিয়ে তাঁদের গুলশান কার্যালয়ে নিয়ে গেছেন খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস।
সূত্র মতে, শিমুলের পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী কয়েক দিন খালেদা জিয়ার কর্মসূচি হলো, ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন পেশাজীবীদের সঙ্গে মত বিনিময় করা, যাতে প্রতিদিনই তাঁরা বলতে পারেন, ‘ম্যাডাম, ঘোষিত কমিটি খুব ভালো হয়েছে।’ গুলশান কার্যালয়ে দলের কোনো নেতা এখন শিমুলের অনুমতি ছাড়া দোতলায় গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে পারেন না। অনেকের মতে, এক হাতে গুলশান কার্যালয় চালাচ্ছেন শিমুল। বেশির ভাগ সময় খালেদা জিয়া তাঁরই পরামর্শে চলছেন বলে বিএনপির প্রায় সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে। ফলে ক্ষোভ প্রশমনের উদ্যোগও শিমুলের পরামর্শেই নেওয়া হয়েছে বলে তাদের বিশ্বাস।
সূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার পদবঞ্চিত নেতা ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন গুলশান কার্যালয়ে গেলে তাঁকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে খালেদা জিয়ার সামনে নিয়ে যান খায়ের ভূঁইয়া। খোকন অবশ্য চেয়ারপারসনের সামনেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তিনি দলের ছাত্র বিষয়ক সম্পাদকের পদে পাওয়ার দাবিদার। তাঁকে ওই পদ দিতে হবে। ওই পদ অবশ্য এখনো শূন্য আছে জানিয়ে খালেদা জিয়া তাঁকে অপেক্ষা করতে বলেন। এর আগে খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুলসহ ওই দুই নেতা খোকনকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে গণশিক্ষা বিষয়ক সহসম্পাদকের পদ প্রকৃতপক্ষে তাঁকেই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঘোষিত কমিটিতে ভুলবশত ‘আনিসুজ্জামান খোকন’ ছাপা হয়েছে। নামের এই বানান ভুল পরে ঠিক করে দেওয়া হবে বলে খোকনকে আশ্বাসও দেন শিমুল। তবে চটে গিয়ে শিমুলের উদ্দেশে খোকন বলেন, ‘কে আপনার কাছে পদ চেয়েছে?’ শিমুল তখন নামের বানান প্রসঙ্গ আবার তুললে খায়ের শান্ত করার চেষ্টা করেন খোকনকে। এরপর তিনি খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে চলে যান। সঙ্গে খায়েরও ওই কক্ষে যান।
জানতে চাইলে আনিসুর রহমান তালুকদার জানান, প্রকৃতপক্ষে তাঁকে শান্ত করার জন্য শিমুল নামের ওই বানান প্রসঙ্গ তুলেছেন। আসলে যাঁকে সহসম্পাদক করা হয়েছে তিনি হলেন কিশোরগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য আখতারুজ্জামানের ভাই আনিসুজ্জামান খোকন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাবেক ছাত্রনেতা আমানউল্লাহ আমানের ঘনিষ্ঠ বলেই খোকনকে বঞ্চিত করেন কমিটি গঠনের সঙ্গে যুক্ত নেতারা।
বিএনপি ছাড়লেন সালিমুল হক কামাল : ১৯৯৪ সালের বিতর্কিত মাগুরা উপনির্বাচনে বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া ব্যবসায়ী কাজী সালিমুল হক কামাল দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। বিতর্কিতদের স্থায়ী কমিটি ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে স্থান দেওয়ার অভিযোগ এনে পদত্যাগ করা বিএনপির সদ্যঘোষিত কার্যনির্বাহী কমিটির এই সদস্য ‘ইকোনো কামাল’ হিসেবে পরিচিত।
নিজের স্বাক্ষরে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে পাঠানো পদত্যাগপত্রের কপি গতকাল মাগুরায় কর্মরত সাংবাদিকদের কাছে পাঠান জেলা বিএনপির সাবেক এই সভাপতি। পদত্যাগপত্রে কাজী কামাল কারও নাম উল্লেখ না করে বলেন, ওয়ান ইলেভেনের সময় বিতর্কিত ব্যক্তিকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়েছে, যিনি গ্রুপিং সৃষ্টি করে মাগুরা জেলা বিএনপিকে দ্বিধাবিভক্ত করেছেন। তিনি লিখেছেন, স্থায়ী কমিটিতে এমন ব্যক্তিদের স্থান দেওয়া হয়েছে, যাঁদের সঙ্গে নিজের মানসম্মান ক্ষুণ্ন করে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। তাই তিনি সদ্য ঘোষিত বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটি থেকে পদত্যাগ করে সরে দাঁড়াচ্ছেন। -কালের কণ্ঠ
১১ আগস্ট, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম