শুক্রবার, ১২ আগস্ট, ২০১৬, ০৭:৫৩:০৪

বিএনপিতে ক্ষোভ না মিটতেই জাতীয় ঐক্য নিয়ে প্রশ্ন

বিএনপিতে ক্ষোভ না মিটতেই জাতীয় ঐক্য নিয়ে প্রশ্ন

সেলিম জাহিদ : কমিটি নিয়ে বিএনপির নেতাদের একটা অংশের ক্ষোভ-অসন্তোষ এখনো চলছে। এর প্রভাব পড়েছে বিএনপির জঙ্গিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগেও। এর মধ্যে এ উদ্যোগে যেসব দলকে টানার চেষ্টা চলছে, তাদের নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে জোটের শরিক কয়েকটি দল। ভেতরে ভেতরে বিএনপির নেতাদের একটা অংশও একই প্রশ্ন তুলেছে।

দলীয় সূত্রগুলো বলছে, এ অবস্থায় একদিকে কমিটি নিয়ে অসন্তোষ, অন্যদিকে জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগ নিয়ে জোটের ভেতরে বিতর্ক ওঠায় নতুন করে চাপে পড়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জঙ্গিবাদবিরোধী ঐক্যপ্রক্রিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত বিএনপির নেতাদের একজন আবদুল্লাহ আল নোমান কিছুটা নিষ্ক্রিয় আছেন। এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত দলের দুই শুভাকাঙ্ক্ষী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জামায়াতে ইসলামী-সম্পর্কিত একটি মন্তব্যের পর বিএনপির ভেতরের প্রতিক্রিয়ায় আশাহত হয়েছেন।

এ বিষয়ে গতকাল জানতে চাইলে এমাজউদ্দীন আহমদ কিছু বলতে রাজি হননি। জাফরুল্লাহ চৌধুরীবলেন, ঐক্যপ্রক্রিয়ার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। বিএনপি এখন নিজেদের কমিটি নিয়েই ঝামেলায় আছে।

আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ঐক্যপ্রক্রিয়ার প্রথম বাধা সরকার, দলের মধ্য থেকেও বাধা আছে। বিভিন্নভাবে প্রশ্ন তুলে এটাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা আছে। ২০-দলেও সবাই আন্তরিক নয়। কিন্তু মানুষের প্রত্যাশা হচ্ছে ঐক্য হোক।

এরই মধ্যে জঙ্গিবিরোধী ঐক্যপ্রক্রিয়ার নেপথ্যে অন্য কিছু আছে কি না, তা নিয়েও বিএনপিসহ ২০-দলীয় জোটের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়েছে। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বিকল্পধারা বাংলাদেশ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলসহ (জেএসডি) আরও কয়েকটি দলকে ঐক্যপ্রক্রিয়ায় নেওয়ার উদ্যোগ নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলেছে জোটের শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি) ও লেবার পার্টি।

এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ গতকাল বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এ সিদ্ধান্তটা আরও ভেবেচিন্তে নেওয়া উচিত ছিল। কারণ, বাইরে থাকা দলগুলো আগেও বহুবার খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছে এবং প্রকাশ্যে বলেছে, বিভিন্ন কারণে তারা ২০ দলের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী নয়। তাদের মধ্যে অনেকের অতীত রেকর্ড ভালো না, কেউ কেউ ধান্দাবাজ-দুর্নীতিবাজ।’

এরই মধ্যে সম্প্রতি খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে এসে কাদের সিদ্দিকীর দেওয়া বক্তব্য নিয়ে বিএনপি এবং জোটে প্রতিক্রিয়া আছে। কাদের সিদ্দিকী সংবাদ সম্মেলন করে ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়াকে জন্মদিন উদ্যাপন এবং জামায়াতের সঙ্গে রাজনীতি করা নিয়ে তাঁর অবস্থান তুলে ধরেছিলেন।

এ বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, কাদের সিদ্দিকীর বক্তব্যে ঐক্যের পথ প্রশস্ত হওয়ার বদলে আরও সংকীর্ণ হয়ে গেছে। তবে তিনি এ-ও মনে করেন, যারা ঐক্যপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তারা হয়তো খালেদা জিয়ার জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগের অন্তর্নিহিত বক্তব্য তাঁর কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারেননি।

এলডিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে এসে কাদের সিদ্দিকী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে আমরা অস্বস্তি বোধ করছি। আমরা মনে করি, এটা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত।’

আর এনডিপির চেয়ারম্যান গোলাম মোর্ত্তুজা বলেন, কাদের সিদ্দিকীরা এর আগে কয়েকটি দল নিয়ে ঐক্য করেছিলেন, কিন্তু তা টেকেনি। তিনি ও তার দল ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নিলেও পরবর্তী সময়ে উপনির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। তাঁর অবস্থান পরিষ্কার নয়।

বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের কেউ কেউ বাম ঘরানার কয়েকটি দল নিয়ে বৃহত্তর ঐক্যের উদ্যোগকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। তাদের ভাষ্য, ঐক্যপ্রক্রিয়ার নেপথ্যে আগামী নির্বাচনকে ঘিরে একটি ছক আছে। খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির মামলায় সাজা দিয়ে সরকার আগামী সংসদ নির্বাচন করবে বলে গুঞ্জন আছে। তা সত্য হলে, খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে বিএনপিকে ওই নির্বাচনে নিতে ভেতর থেকে চাপ তৈরির একটা দুরভিসন্ধি থাকতে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মো. শাহজাহান বলেন, ‘সরকারের যে অবস্থান, তাতে আগামীতেও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো আলামত দেখছি না। তবে এবার হয়তো সরকার নিজেকে গ্রহণযোগ্য করতে ২০১৪ সালের ব্যতিক্রম কিছু করবে। আগের নির্বাচন বর্জনকারী কিছু দল হতাশা থেকে, আবার কিছু দল সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নির্বাচনে যেতে পারে।’

অসন্তোষ কাটেনি: দলীয় সূত্রগুলো জানায়, পদ-পদবি নিয়ে ছয় দিন ধরে নেতাদের একাংশের মধ্যে অসন্তোষ এখনো রয়েছে। এর গতি-প্রকৃতি বিএনপির উচ্চপর্যায় থেকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তবে কমিটিতে পদ, পদোন্নতি ও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন নিয়ে যে বিতর্ক উঠেছে, তা সংশোধন করা হবে কি না, এ বিষয়ে কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি।

গত শনিবার ৫০২ সদস্যের নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করে বিএনপি। এতে দলের অন্তত দুই ডজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন বলে তাঁরা মনে করেন। ওই নেতারা এখন বোঝার চেষ্টা করেছেন, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে বা দলীয় প্রধানের ইচ্ছায় হয়েছে, নাকি কমিটি তালিকা প্রস্তুতকালে করণিক ভুল হয়েছে। একাধিক নেতা বলেন, তারা মনে করছেন, দলীয় প্রধানের ইচ্ছায় জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন হলে এর মধ্যে ভিন্ন বার্তা আছে। তাই এটা জেনে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে চাইছেন তারা।

প্রসঙ্গত, কমিটি ঘোষণার পরপরই নিজ নিজ পদ থেকে অব্যাহতি চেয়ে চিঠি দিয়েছেন ভাইস চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক আলী, সহপ্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান ও নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী সালিমুল হক। এ ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টার পদ পাওয়া গোলাম আকবর খোন্দকার পদত্যাগের চিন্তা করছেন বলে খবর বের হয়।

অবশ্য আবদুল্লাহ আল নোমান গতকাল বলেন, কিছু গণমাধ্যম তাকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করেছে। তিনি বলেন, ‘আমি বলেছিলাম, আমার আর ওই পদে (ভাইস চেয়ারম্যান) থাকার আগ্রহ নেই। পদত্যাগ করব, এমন কথা বলিনি।’

জানা গেছে, কমিটি ঘোষণার পর অনেকে তাৎক্ষণিকভাবে আবেগে পদত্যাগের চিন্তা করলেও এখন মত বদলাচ্ছেন। তারা আশা করছেন, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তাদের প্রতিক্রিয়া এবং দলের প্রতি আনুগত্যের মূল্য দেবেন। গোলাম আকবর খোন্দকার গতকাল বলেন, ‘দল আমার প্রতি সুবিচার করেনি। কিন্তু আমি তো এই দুঃসময়ে দলকে পরিত্যাগ করতে পারি না। জাগো দল থেকে বিএনপির রাজনীতি করছি। এত ত্যাগের পর এ বয়সে এখন আর কোথায় যাব।’

দলীয় সূত্র জানায়, কমিটি নিয়ে বিএনপিতে দুটি পক্ষের সৃষ্টি হয়েছে। এক পক্ষের দাবি, কমিটি অগোছালো এবং কয়েকজন ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থকেন্দ্রিক হয়েছে। জ্যেষ্ঠতার ক্ষেত্রে ওলটপালট করা হয়েছে। এত বড় কমিটির আদ্যোপান্ত একা চেয়ারপারসনের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। তিনি যাদের নিয়ে কাজটি করেছেন, তাঁরা চেয়ারপারসনকে সঠিক তথ্য দেননি।

আরেক পক্ষ কমিটি নিয়ে মোটামুটি সন্তুষ্ট। তারা বলছে, কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, তা সংশোধনযোগ্য। এমন একাধিক নেতা বলেন, ভবিষ্যতে আন্দোলনে ঝুঁকি নেওয়া এবং দলে তারেক রহমানের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের চিন্তা মাথায় রেখে কমিটি হয়েছে। কমিটিতে প্রায় ২৫ ভাগ তরুণ নেতৃত্ব আনা হয়েছে। নারীনেত্রীর সংখ্যা বাড়িয়ে ১৩ ভাগ করা হয়েছে। সাংস্কৃতিক কর্মী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং শিক্ষক ও চিকিৎসকদের বড় সংখ্যায় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির নতুন সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বহুমাত্রিক শ্রেণি-পেশার মানুষের মিশ্রণে একটি ইনক্লুসিভ কমিটি হয়েছে এই প্রথম। এটাকে স্বাগত জানালে খুশি হতাম। কমিটিতে ছোটখাটো ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে পারে, সেগুলো সংশোধনযোগ্য।’ - প্রথম আলো

১২ আগস্ট ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস‌‌‌‌

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে