হাবিবুর রহমান খান ও নজরুল ইসলাম : বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে এবার উত্তরাধিকারদের জয়জয়কার। সদ্য ঘোষিত নির্বাহী কমিটিতে অনেক নেতার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, ছেলের বউ, ভাই এমনকি দূর সম্পর্কের আত্মীয়দেরও স্থান দেয়া হয়েছে।
দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের ছেলে, আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজ, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি, সার্টিফিকেট জালিয়াতেরও জায়গা হয়েছে নতুন কমিটিতে। যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক উত্তরাধিকার সূত্রে এরা এখন বিএনপির নেতা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জাতীয় বা বৃহত্তর ঐক্যের জন্য জামায়াতকে জোট থেকে ছেড়ে দেয়ার দাবি জোরালো হলেও কমিটিতে এর প্রতিফলন নেই। ঘোষিত কমিটিতে জামায়াতের যোগসূত্র রক্ষার প্রবণতা লক্ষণীয় বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা। তাদের মতে, কমিটি থেকে জামায়াতপন্থীদের বাদ না দিয়ে তাদের এবং আত্মীয়দের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হয়েছে।
দলের সিনিয়র নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান এবং মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম জামায়াতবিরোধী বলে পরিচিত। তাদের স্থায়ী কমিটিতে জায়গা দেয়া হয়নি। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের মতো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে দেয়া হয়নি গুরুত্বপূর্ণ পদ। অথচ জামায়াতপন্থী বলে পরিচিত এদের জুনিয়র একাধিক নেতাকে স্থায়ী কমিটিতে পদ দেয়া হয়েছে। সদ্য ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ কমিটি পর্যালোচনা করে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।
এ প্রসঙ্গে স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, কমিটি যে শতভাগ ভালো হয়েছে সেটা বলব না। যোগ্যতার ভিত্তিতে সবাই পদ পাওয়ার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা হয়নি। এছাড়া জ্যেষ্ঠতা লংঘনসহ বেশ কিছু অসঙ্গতি আছে। এসব অসঙ্গতি দূর করতে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, যুদ্ধাপরাধী বা জামায়াতপন্থী হিসেবে পরিচিত নেতা ও তাদের পরিবারকে পদ দেয়ায় নিশ্চয় সমালোচনায় পড়তে হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধার হাতে গড়া দলে জামায়াতপন্থী বা যুদ্ধাপরাধীদের পদ দেয়া মানায় না। তাদের পদ না দিলেও দলের কোনো ক্ষতিই হতো না।
সদ্য ঘোষিত কমিটিতে উত্তরাধিকার সূত্রে পদ পেয়েছেন ৩৩ জন। এদের মধ্যে ১০ নেতার স্ত্রী, ১১ নেতার পুত্র, ৫ নেতার মেয়ে, ৫ নেতার ভাই, ১ নেতার বোন, ১ নেতার মেয়ের জামাই আছে। এছাড়া ছয় মৃত নেতার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনকে পদ দেয়া হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী পরিবারের ৩ জন ও দণ্ডিত ৪ নেতাও নতুন কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন। কমিটিতে পলাতক থেকেও পদ পেয়েছেন ৬ জন।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি কার্যকর হওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী ও তার ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, যুদ্ধাপরাধে আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত মৃত আবদুল আলীমের ছেলে ফয়সাল আলীমকে কমিটিতে পদ দেয়া হয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি তাজউদ্দিন আহমেদের ভাই আবদুস সালাম পিন্টুকেও কমিটিতে জায়গা দেয়া হয়। একদিকে জঙ্গিবিরোধী ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে অন্যদিকে জঙ্গির পরিবারকে কমিটিতে জায়গা দেয়াকে স্ববিরোধী অবস্থান বলে মনে করছেন অনেকে। বিগত চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকতে নানা কারণে বিতর্কিত ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর। ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলাসহ কয়েকটি মামলায় তিনি নিু আদালতে দণ্ডিত। তাকেও পদ দেয়া হয়েছে।
উত্তরাধিকারদের পদ পাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির নতুন সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যারা পদ পেয়েছেন তারা নিজের যোগ্যতাই পেয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরেই তারা দলের জন্য কাজ করছেন। কারও দয়ায় নয়, তাদের নিজ নিজ যোগ্যতা বিবেচনা করেই পদ দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই।
ঘোষিত কমিটিতে নানা অসঙ্গতি দূর করতে দ্রুতই কাজ শুরু করবে বলে জানা গেছে। একই নাম নিয়ে সৃষ্ট বিভ্রান্তি দূর করতে এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। শিগগিরই জ্যেষ্ঠতা লংঘনের বিষয়টিও সমাধান করা হবে।
উত্তরাধিকারসহ অযোগ্যরা কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ায় অনেক ত্যাগী ও যোগ্য নেতাকর্মীর মাঝে তৈরি হয়েছে চরম হতাশা। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিরাজ করছে এ ক্ষোভ এবং হতাশা। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে কমিটি ঘোষণার পরপরই দু’জন পদত্যাগ করেন। সবমিলিয়ে পদত্যাগের তালিকা আরও বাড়তে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে শুরু করেছেন। কমিটি ঘোষণার পর অনেকেই দলীয় কার্যালয়ে কিংবা কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রয়েছেন। তবে ক্ষুব্ধ হলেও কেউ কেউ দলের চেয়ারপারসনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথাও বলতে শুরু করেছেন। এরই মধ্যে নতুন কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, প্রচার সম্পাদক শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, আগের কমিটির বিশেষ সম্পাদক ও নতুন কমিটির সদস্য নাদিম মোস্তফা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। কমিটি ঘোষণার পর সৃষ্ট নানা ক্ষোভ ও হতাশা নিয়ে খালেদা জিয়া তাদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় খালেদা জিয়া তাদের আশ্বস্ত করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন বলেন, নতুন কমিটি ঘোষণায় চেয়ারপারসনকে অভিনন্দন জানিয়েছি। আমি দেখা করায় ম্যাডাম খুব খুশি হয়েছেন। তাকে বলেছি যতদিন শারীরিকভাবে সুস্থ থাকব ততদিন বিএনপির সঙ্গে থাকব। রাজনীতি থেকে অবসর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুর্দিনেও বিএনপিকে ছেড়ে যাব না। যতদিন রাজনীতিতে আছি, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে রাজনীতি করে যাব। আর এখন অবসর নেয়ারও কোনো প্রশ্ন আসে না।
উত্তরাধিকার ও মৃত নেতাদের সন্তানদের জয়জয়কার : বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও বর্তমান চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানকে প্রথমে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব করায় অনেকেই উত্তরাধিকার বিষয়টি সামনে আনেন। এবার সেই সমালোচকদের মধ্যে অনেকের ছেলেমেয়ে, ভাই, স্ত্রীসহ নিকট আত্মীয় নতুন কমিটিতে জায়গা পেয়েছে। এর মধ্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ছোট ভাই মির্জা ফয়সল আমিনও রয়েছেন।
স্থায়ী কমিটির অনেকেই তাদের আত্মীয়দের কমিটিতে জায়গা করে দিয়েছেন। এ তালিকায় আছেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছোট ছেলে খন্দকার মারুফ হোসেন, ব্যারিস্টার মুহাম্মদ জমিরউদ্দিন সরকারের ছেলে ব্যারিস্টার নওশাদ জমির, মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস, মির্জা আব্বাসের ছোট ভাই মির্জা খোকন, তরিকুল ইসলামের ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মেয়ে অপর্ণা রায়, নিতাই রায় চৌধুরীর মেয়ে নিপুণ রায় চৌধুরী, স্থায়ী কমিটির নতুন সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ, এম ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার স্ত্রী ড. শাহিদা রফিক, সাবেক মন্ত্রী হারুনার রশিদ খান মুন্নুর মেয়ে আফরোজা খান রীতা, এমএ মান্নানের মেয়ের জামাই ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম।
এম শামসুল ইসলাম খানের ছেলে মইনুল ইসলাম শান্ত, শাজাহান সিরাজের স্ত্রী রাবেয়া সিরাজ, আলমগীর কবিরের ভাই আনোয়ার হোসেন বুলু, মীর নাছির উদ্দিনের ছেলে মীর হেলাল উদ্দিন, অলি আহাদের মেয়ে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনের স্ত্রী শিরীন সুলতানা, যুগ্ম মহাসচিব হারুন অর রশিদের স্ত্রী সৈয়দা আশিফা আশরাফি পাপিয়া। আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়াল, টিএইচ খানের ছেলে আফজাল এইচ খান, নতুন কমিটির উপদেষ্টা শাহজাদা মিয়ার স্ত্রী ইয়াসমিন আরা হক, হেলালুজ্জামান তালুকদার লালুর বোন অধ্যাপিকা তাসমেরি এস ইসলাম, দুই ভাই মীর সরাফত আলী সপু ও মীর নেওয়াজ আলী নেওয়াজও জায়গা পেয়েছেন নতুন কমিটিতে।
মৃত নেতাদের মধ্যে নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টুর স্ত্রী নাসিমা আখতার কল্পনা, সাবেক মহাসচিব প্রয়াত কেএম ওবায়দুর রহমানের মেয়ে শামা ওবায়েদ, সাবেক হুইপ প্রয়াত জাহেদ আলী চৌধুরীর ছেলে ফাহিম চৌধুরী, সাবেক মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ছেলে খোন্দকার আবদুল হামিদ ডাবলু।
বিতর্কিত ও আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজরাও কমিটিতে : শুধু উত্তরাধিকার নয়, নানা সময়ে বিতর্কিত এবং আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদেরও জায়গা হয়েছে নতুন কমিটিতে। সার্টিফিকেট জালিয়াতকারীকে নির্বাহী কমিটির সদস্য করা হয়েছে। ওয়ান ইলেভেনের সময় ট্রুথ কমিশনে দুর্নীতির দায় স্বীকার করা সাবেক এক মেজরকে করা হয়েছে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়নকে কেন্দ্র করে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল তারাও জায়গা পেয়েছেন।
কমিটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে আছেন ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, আবদুস সালাম পিন্টু, লুৎফুজ্জামান বাবর, জিকে গউছসহ আরও কয়েকজন। যদিও বিএনপির দাবি তাদের রাজনৈতিকভাবে সাজা দেয়া হয়েছে। এছাড়া বহিষ্কৃত নেতা আলমগীর মাহফুজউল্লাহ ফরিদকেও নতুন কমিটিতে জায়গা দেয়া হয়েছে। পলাতক কয়েক নেতাকেও গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হয়েছে। এই তালিকায় আছেন প্রায় ৫ জন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ১৯৯৬ সালে মহিলা দলের মধ্য দিয়ে রাজনীতির আমার মেয়ের হাতেখড়ি। সে মহিলা দলের কেন্দ্রীয় কমিটি এবং সর্বশেষ বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিল। এখানে তো আমার পরিচয়ে সে পদ পায়নি। তার যোগ্যতাই সে পদ পেয়েছে। যোগ্যতা থাকার পর কারও সন্তান বা আত্মীয় কমিটিতে জায়গা পাওয়া তো দোষের কিছু নয়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নতুন কমিটিতে যেসব অসঙ্গতি রয়েছে তা দূর করতে দ্রুত উদ্যোগ নেয়া হবে। কমিটি ঘোষণার পর সৃষ্ট অসঙ্গতি দূর করা গেলে ক্ষোভ ও হতাশা অনেক কমে যাবে বলে আশা করেন এই নীতিনির্ধারক। - যুগান্তর
১৩ আগস্ট ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস