রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৬, ০১:৪০:৪৯

‘এখানে এসে শুনছি হাজারো কণ্ঠের আর্তনাদ’

‘এখানে এসে শুনছি হাজারো কণ্ঠের আর্তনাদ’

সাঈদুর রহমান রিমন : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার প্রতিবাদ জানাতে মুক্তিযোদ্ধা বিশ্বজিৎ নন্দী হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র। শুরু করেছিলেন সশস্ত্র প্রতিবাদ। পুলিশ, বিডিআর ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে নেমেছিলেন বারবার।

আরও বড় রকমের অভিযান চালানোর প্রস্তুতিকালে পাঁচ সহযোদ্ধাসহ বিশ্বজিৎকে ঘিরে ফেলে সেনাবাহিনী। শুরু হয় বন্দুকযুদ্ধ। টানা আট ঘণ্টার সশস্ত্র যুদ্ধে সহযোদ্ধা জুবেদ আলী, সুবোধ ধর, দীপাল দাস, মফিজ উদ্দিন ও নিখিল  নিহত হন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেফতার হন বিশ্বজিৎ।

এরপর প্রায় পাঁচ মাস টানা সেনা হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের নামে অন্ধকার কুঠুরিতে রেখে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা তার ওপর চালায় নির্মম নির্যাতন। সত্তরের দশকের উত্তাল রাজনীতিতে আকৃষ্ট বিশ্বজিৎ নন্দী স্কুল জীবনেই বঙ্গবন্ধুর অনড় ভক্ত হয়ে ওঠেন। তিনি অংশ নেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীন দেশে যখন আবার নিশ্চিন্ত মনে লেখাপড়ায় মনোযোগী হয়েছেন, ঠিক তখনই সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যা তাকে বিচলিত করে তোলে।

বিশ্বজিৎ বলেন, ‘আমরা মুজিবভক্তরা কোনোভাবেই এ নৃশংস হত্যা মেনে নিতে পারছিলাম না। সন্তানের সামনে বাবার রক্তাক্ত লাশ—আমার জীবনের সবকিছু যেন উল্টেপাল্টে দিল।’ তিনি জানান, এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মুজিবভক্তরা অস্ত্র হাতে তুলে নেন। গঠন করেন জাতীয় মুক্তিবাহিনী নামের সংগঠন। ময়মনসিংহের সীমান্ত এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে শুরু হয় সশস্ত্র আন্দোলন। সেখানে কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম-এর তত্ত্বাবধানে সক্রিয় যুদ্ধে অংশ নেন বিশ্বজিৎ নন্দী।

১৯৭৬ সালের ১৪ আগস্ট মুক্তাগাছা এলাকায় সশস্ত্র অভিযানে গিয়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটকের পর ১৯৭৭ সালের ১৮ মে সামরিক আদালত ১৯ বছর বয়সী গেরিলাযোদ্ধা বিশ্বজিৎকে ফাঁসির দণ্ড ঘোষণা করে। তাকে রাখা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে। এ ফাঁসির সেলের বিভিন্ন কক্ষে বিশ্বজিৎ নন্দীর কাটে সাত বছরের দুর্বিষহ জীবন। সামরিক আদালতের রায়ের ব্যাপারে তখন আপিল বা রিভিউর সুযোগ ছিল না। বিশ্বজিৎ নন্দীর বাবা রাষ্ট্রপতির কাছে ছেলের প্রাণভিক্ষা চাইলেও তা ঝুলে থাকে।

এ কারণে নিশ্চিত মৃত্যুর প্রতীক্ষা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না এই যোদ্ধার। চার দফা তার ফাঁসি কার্যকরের চূড়ান্ত উদ্যোগ নিয়েও তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হস্তক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর জোরালো প্রতিবাদের কারণে বেঁচে থাকেন বিশ্বজিৎ। ১৯৮৪ সালে বিশ্বজিৎ নন্দীর ফাঁসির রায় মওকুফ করে রাষ্ট্রপতির নির্দেশে আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন। কনডেম সেল থেকে তখন তাকে স্থানান্তর করা হয় অন্য সেলে। এরপর সব আইনি প্রক্রিয়া সমাপ্ত করে ১৯৮৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর কারাগার থেকে মুক্ত হন তিনি।

বিশ্বজিৎ নন্দীর জন্ম ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার প্রত্যন্ত গ্রাম গোবিন্দপুরে ১৯৫৬ সালে। বাবা সুধারঞ্জন নন্দী। মা সুভাষিণী নন্দী। বিশ্বজিৎ নন্দী দীর্ঘ কারাভোগের সময়ও লেখাপড়া চালিয়ে যান। জেল থেকেই পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাস করেন তিনি। পরে টাঙ্গাইলের করটিয়া সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। স্ত্রী চিত্রা নন্দী স্কুলশিক্ষিকা। মেয়ে সহিষ্ণুতা নন্দী এখন নবম শ্রেণির ছাত্রী। ছেলে দেবজিত নন্দী পড়ছে তৃতীয় শ্রেণিতে। তাদের নিয়ে বিশ্বজিৎ নন্দী বসবাস করছেন টাঙ্গাইল শহরে প্যারীদাস রোডের ভাড়া বাড়িতে।

বিশ্বজিৎ নন্দী যৌবনের পুরোভাগ জেলের প্রকোষ্ঠে কাটিয়ে পুরোদস্তুর কর্মজীবনে ফিরতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক, মুজিবভক্ত হিসেবে জীবনবাজি রাখা বিশ্বজিৎ নন্দীর জীবন কাটছে আজ সীমাহীন অবহেলায়, চরম কষ্টে। ফাঁসি থেকে প্রাণ বাঁচলেও তার জীবনচাকা আর যেন ঘুরছে না। এক ছেলে, এক মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে গড়ে তোলা ছোট্ট পরিবারে অভাব-যন্ত্রণার চাপা আর্তনাদ থাকলেও বিশ্বজিৎ নন্দী মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখার চেষ্টা করেন বরাবর।

একগাল হেসেই বলে ওঠেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় কার্যকর হওয়ার পর থেকেই আনন্দে আছি। আমৃত্যু আমার হাসি বন্ধ করতে পারবে না কেউ।’ তার স্মৃতিতে আজও সমুজ্জ্বল হয়ে আছে ১৯৮৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর দিনটি। ‘সেদিন জেলমুক্ত হতেই শেখ হাসিনা আমাকে ফুলের মালা দিয়ে তার সঙ্গেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানেই আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।’

তবে ১৯৯৪ সালের পর থেকে আর শেখ হাসিনার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়নি বিশ্বজিৎ নন্দীর। বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ তার খোঁজও নেননি। বললেন, ‘এ জীবনে আমি তৃপ্ত। দেশ ও জাতির জন্য আমার যতটুকু দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল, দিতে পেরেছি। প্রতিদান চাই না। হয়তো সামাজিক ও আর্থিকভাবে আমার অবস্থান উঁচুতে নয়। তবু ভালো আছি। আমি যা পেয়েছি, তা তো অন্যরা পাবে না।’

সব হারানো শেখর হাগিদক : বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করায় ফাঁসির দণ্ড মাথায় নিয়ে ২৩ বছর মেঘালয়ে পালিয়ে ছিলেন শেখর হাগিদক। গারো পরিবারের সন্তান শেখর তার দণ্ড মওকুফের ঘটনায় তিন বছর আগে দেশে ফিরলেও সীমাহীন অভাব-যন্ত্রণায় নুয়ে পড়েছেন। তার স্ত্রী সূচনা ম্রংও ছিলেন প্রতিরোধযোদ্ধা।

ভবানীপুর পাহাড়ি সীমান্তে গড়ে তোলা ‘কাদের সিদ্দিকীর ক্যান্টনমেন্টে’ নার্স ছিলেন তিনি। উভয়ে ২৩ বছরের নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছেন তারা মেঘালয়ের গহিন বন আর পাহাড়ে। সেখানে পঁচাত্তরের প্রতিরোধযোদ্ধা-কমান্ডারদের আরও বেশ কয়েকজন এখনো কাটাচ্ছেন দুর্বিষহ জীবন।

শেখর হাগিদক বলেন, ‘পঁচাত্তরে আদর্শের পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করল কতিপয় সেনাসন্ত্রাসী। আইন থাকল নির্বাক হয়ে। তখন বাবা হত্যার বদলা নিতে ছেলের আর কী করার থাকতে পারে। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে যদি আমরা মিছিল করতে পারতাম, যদি মুখফুটে গালাগাল দিতে পারতাম, যদি খুনিদের জুতাপেটা করতে পারতাম, তাহলে হয়তো অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার দরকার পড়ত না। কিন্তু সে সময় সেনাদাপটে সবকিছু যখন রুদ্ধ হয়ে গেল, তখন একজন সন্তান হিসেবে খুনের বদলা নিতে অস্ত্র তুলে নিয়েছি। বিশ্ববাসীকে জানানোর চেষ্টা করেছি, তোমরা দেখ, আমার পিতাকে কী জঘন্যভাবে খুন করেছে ঘাতকরা!’

শেখর হাগিদক বলেন, ‘আমরা কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে অস্ত্র হাতে নিয়ে আরেকটি দেশের স্বাধীনতা দাবি করিনি। আমরা মন্ত্রিত্ব চাইনি। সরকার পরিচালনায় শেয়ার চাইনি। আমরা শুধু বাবা হত্যার প্রতিবাদ করেছি। ন্যায্য বিচার চেয়েছি। ৩৪ বছর পর আদালত সেই খুনিদের ফাঁসির দণ্ড দেওয়ায় প্রমাণিত হয়েছে, আমাদের প্রতিবাদ ছিল যৌক্তিক। আমাদের দাবি ছিল ন্যায্য।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিরোধযুদ্ধে যাওয়ার সময় আমাদের আড়াইশ’ একর জমি ছিল। ছিল ঘর গেরস্থালি সব। আমি ও আমার ভাই শংকর হাগিদক প্রতিরোধযুদ্ধে যাওয়ার অপরাধে আমাদের সবকিছু কেড়ে নেওয়া হয়। জমি বিক্রি করে করে প্রতি সপ্তাহে থানা পুলিশ আর বিডিআরকে টাকা দেওয়ার কারণে আজ আমরা ভূমিহীন হয়ে আছি। অন্যের ভিটায় একচালা টিনের ঘর তুলে কোনোরকমে জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে আমাদের।’

একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা ও পঁচাত্তরের বীর গেরিলাযোদ্ধা শেখর হাগিদক এখন স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে অন্যের জমিতে পাইট খেটে বাধ্য হচ্ছেন কঠিন জীবনযাপনে। তিনি বলেন, ‘দেশে ফেরার পর কাদের সিদ্দিকী কমবেশি খোঁজখবর রাখলেও আর কারও কাছ থেকে আমরা বিন্দুমাত্র সহায়তা পাইনি। আমার মতো আরও কয়েক হাজার প্রতিরোধযোদ্ধা আজ অবহেলিত, অতি কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। যারা বঙ্গবন্ধুর জন্য জীবন দিয়েছেন, সর্বস্ব হারিয়েছেন, তাদের খোঁজ কেউ রাখে না।’ শেখর হাগিদক বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিরোধযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে ভবানীপুর এলাকায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য শেখ হাসিনার প্রতি জোর দাবি জানান।

আবার পালাতে চান জিতেন্দ্র : লজ্জা, কষ্ট আর যন্ত্রণায় ৩৭টি বছর নির্বাসনে থাকলেন জিতেন্দ্র ভৌমিক। তার অনুপস্থিতিতে প্রশাসনিক নির্যাতনে ক্যান্সারে আক্রান্ত অবস্থায় মারা যান বাবা গজেন্দ্র ভৌমিক। পক্ষাঘাতগ্রস্ত মা চিত্রা ভৌমিক এখনো বেঁচে আছেন। ক্ষোভে-দুঃখে তিনিও চলে গিয়েছিলেন বড় ছেলে নৃপেন্দ্র ভৌমিকের শিলিগুড়ি এলাকায়। ছোটভাই ডা. সুশীল ভৌমিক নির্যাতিত হয়েছেন বারবার।

জিতেন্দ্র ভৌমিক বলেন. ‘পুরো পরিবার ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। আজও সে লজ্জায় কোনো ভাই-বোনের সামনে দাঁড়াতে পারি না। ৩৭ বছর পর দেশে ফিরে এখন সহযোদ্ধাদের হাজারো প্রশ্নের মুখে আছি। নিজ হাতে তিন সহস্রাধিক যোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নামিয়ে এনেছি দেশে। নিয়ে গেছি সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে। আজ তারা যেন আর কাউকে চিনতে-জানতে চান না। তারা বলেন, অভাব, কষ্ট, যন্ত্রণায় আর তো বাঁচি না দাদা। একটু এগিয়ে যান, আমাদের কথা বলেন প্রধানমন্ত্রীকে।’

জিতেন্দ্র ভৌমিক দুচোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘আমি সেই সব সন্তানতুল্য সহযোদ্ধাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিই। বলি, কাল যাব ঢাকায়, পরশু যাব ঢাকায়। সব জানাব নেত্রীকে। একটা কিছু করবই, একটা কিছু হবেই হবে। যাই মন্ত্রী দীপংকর তালুকদারের কাছে। তিনি তো আমাদেরই একজন সহযোদ্ধা কমান্ডার। তিনিও সুনির্দিষ্ট কিছু আশ্বাস দিতে পারেন না। তখন বড়ই হতাশ হয়ে পড়ি। অনাহারী সহযোদ্ধাদের কাতর অভিব্যক্তি আমাকে চরমভাবে মর্মপীড়া দেয়। ভাবছি আবার রাতের আঁধারে পালিয়ে যাব। সেখানে শুধু আমার পরিবারের কান্না শুনি। এখানে এসে শুনছি হাজারো কণ্ঠের আর্তনাদ।’
১৪ আগস্ট ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস‌‌‌‌

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে