মাসুদ করিম : সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরীকে দেশে আনার প্রক্রিয়া জোরদার হচ্ছে।
সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতার আওতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে খুনি রাশেদকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। কানাডায় পালিয়ে থাকা খুনি নূর চৌধুরীকে ফেরাতে আইনি লড়াই জোরদার করা হচ্ছে। পলাতক অপর চার খুনির অবস্থান শনাক্তে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। পলাতক খুনিদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বর্তমানে বাংলাদেশের সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা চলছে। এর আওতায় খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ, অ্যাটর্নি জেনারেল, জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদসহ রাজনৈতিক পর্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আসন্ন নিরাপত্তা সংলাপেও সরকার এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে পারে। সেখানে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দিলে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতায় মাইলফলক হবে সে বিষয়টি উল্লেখ করা হতে পারে।
বক্তব্যের প্রসঙ্গে যুক্তি দেখানো হবে সে আত্মস্বীকৃত সন্ত্রাসী। মিথ্যা তথ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছে। তাকে ফেরত দিলে দু’দেশের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে। এর আগে বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি মহিউদ্দিন আহমদকে যুক্তরাষ্ট্র ফেরত পাঠিয়েছিল সে বিষয়ও উল্লেখ করার সম্ভাবনা আছে। ২ অক্টোবর ঢাকায় দু’দেশের মধ্যে পঞ্চম নিরাপত্তা সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র শনিবার এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক শনিবার বলেন, ‘এ ব্যাপারে কাজ চলছে। খুনিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অগ্রগতি কতটুকু জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘এটা নিয়ে কাজ চলছে। এ ব্যাপারে কিছু আইনি প্রক্রিয়া আছে। এখন সেই প্রক্রিয়া সম্পাদন করা হচ্ছে।’
এদিকে, বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি সাবেক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এইচ নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছেন। সে কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিল। কিন্তু দেশটির সরকার তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়নি।
এরপর সে দেশটির আদালতে এ মর্মে আবেদন করে যে, বাংলাদেশের আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশে ফেরত পাঠালে তার ফাঁসি নিশ্চিত। কানাডায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। ফলে তারা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত কোনো ব্যক্তিকে ফেরত পাঠায় না। একারণে তাকে তৃতীয় দেশে স্থানান্তরের জন্যও বাংলাদেশ অনুরোধ জানিয়েছে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ কানাডায় আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। অপর চার পলাতক খুনি দ্রুত তাদের অবস্থান পাল্টাচ্ছে। ফলে তাদের অবস্থান চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
বঙ্গবন্ধুর খুনি রিসালদার মুসলেহউদ্দিনকে অনেক আগে একবার জার্মানিতে দেখা গিয়েছিল। এছাড়া সাবেক ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ, কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল শরিফুল হক ডালিম কোথায় আছেন সে সম্পর্কে সরকারের কাছে নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই। এ পরিস্থিতিতে খুনিদের ফিরিয়ে আনা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ছয়জন বর্তমানে পলাতক আছেন। পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। আরেক খুনি আজিজ পাশা জিম্বাবুয়েতে মারা গেছেন। তার ডেথ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিশ্চিত হয়েছেন যে, তিনি মারা গেছেন।
বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনতে আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত টাস্কফোর্স কাজ করে যাচ্ছে। এতে সদস্য হিসেবে আছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
এই টাস্কফোর্স বিভিন্ন সময়ে বৈঠক করে বিষয়টি নিয়ে অগ্রগতি পর্যালোচনা করে থাকে। পলাতক খুনিদের নামে থাকা স্থাবর ও অস্থাবর সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিষয়টি চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। এ সংক্রান্ত কাজ শেষ হলেই তাদের নামে ঢাকায় ও গ্রামের বাড়িতে থাকা সম্পত্তি এবং ব্যাংকে স্বনামে ও বেনামে যেসব অর্থ গচ্ছিত আছে সেগুলো বাজেয়াপ্ত করা হবে।
তবে টাস্কফোর্সের সর্বশেষ বৈঠকে খুনিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। এ সময় বলা হয় কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে আইনি লড়াই চালানোর জন্য নিয়োগ দেয়া আইনি ফার্মকেও খুব বেশি তথ্য দেয়া হচ্ছে না। এদিকে, পুলিশ বলছে, পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা নেয়া হচ্ছে। ইন্টারপোলের কাছে খুনিদের ছবি পাঠানো হয়েছে। তাদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেছে ইন্টারপোল।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শনিবার বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনার ইস্যুটি আগের অবস্থাতেই আছে। নতুন কোনো তথ্য আমার কাছে নেই।’ রিসালদার মুসলেহউদ্দিন জার্মানিতে আছেন বলে সম্প্রতি মন্ত্রীর বক্তব্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা এটা শুনেছি। অসমর্থিত সূত্র থেকে শুনেছি।’
সূত্র মতে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট গত বছর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে আলাপকালে জানান, রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন। তবে সম্প্রতি মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফেরত পাঠানো একটি জটিল বিষয়। এই ইস্যুটি তার দেশের বিচার মন্ত্রণালয় দেখাশোনা করে থাকে। বার্নিকাট এবার খানিকটা সংশয়ের সুরে বলেন, পলাতক খুনিরা যুক্তরাষ্ট্রে আছেন কিনা সে কথা তিনি নিশ্চিত করতে পারছেন না। রাষ্ট্রদূত অবশ্য এ কথা বলেন যে, এই ইস্যুটি দু’দেশের মধ্যে চলমান আলোচনার অন্যতম ইস্যু।
পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচার ও রায় বাস্তবায়ন জাতির একটি দায়মুক্তির প্রক্রিয়া চলছে। পলাতকদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় আছেন। বাকিদের অবস্থান সম্পর্কে আমরা একশভাগ নিশ্চিত নই। যেসব দেশে তাদের থাকার সম্ভাবনা আছে সেসব দেশের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ অব্যাহত আছে। আমরা আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। এটি আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার অ্যাসাইনমেন্টের অন্যতম।’
পলাতক খুনিদের মধ্যে রিসালদার মুসলেহউদ্দিনকে প্রবাসী বাংলাদেশীরা একবার জার্মানিতে দেখেছিলেন বলে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন। তবে তার সুনির্দিষ্ট অবস্থান সম্পর্কে তিনি কিছু বলেননি।
এ ব্যাপারে টেলিফোনে জানতে চাইলে জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আলী সরকার শনিবার বলেন, ‘সম্ভবত অনেক আগে কেউ তাকে জার্মানিতে দেখে থাকতে পারেন। কিন্তু সাম্প্রতিককালে তাকে কেউ দেখেছেন বলে আমার জানা নেই। খুনিরা দ্রুত অবস্থান বদল করে থাকে। ফলে কেউ তাকে কোথাও দেখলে আর তা জানাজানি হলে তিনি কি এখানে থাকবেন! তার দ্রুত স্থান বদল করাই স্বাভাবিক।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ দিয়ে বিচার বন্ধ করা হয়। আত্মস্বীকৃত এই ১২ খুনিকে বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন মিশনে চাকরি দিয়ে পুনর্বাসন করা হয়। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর ১২ নভেম্বর ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করার পথ সুগম করে। তারপর বিচারের আয়োজন করা হয়। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
যেসব খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে তারা হল, সাবেক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান, মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), শাহরিয়ার রশিদ খান এবং একেএম মহিউদ্দিন আহম্মেদ (ল্যান্সার) ও সাবেক মেজর বজলুল হুদা।
ঢাকা ও ব্যাংককের মধ্যে বন্দি বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরের পর বজলুল হুদাকে থাইল্যান্ড থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তবে বন্দি বিনিময় চুক্তি না থাকলেও সেনা সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বরখাস্তকৃত লেফটেন্যান্ট কর্নেল একেএম মহিউদ্দিন আহমেদকে যুক্তরাষ্ট্র ফিরিয়ে দেয়। - যুগান্তর
১৪ আগস্ট ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস