জিন্নাতুন নূর : পঁচাত্তরের রক্তাক্ত ১৫ আগস্টের স্মৃতিচারণ করলেন সে সময়ের ডিজিডিএফআই-এর পরিচালক ও বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদের কন্যা আফরোজা জামিল কংকা। এক সাক্ষাৎকারে সেদিনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আমার এবং আমার ছোটবোনের বেডরুম ছিল বাবা-মার বেডরুমের ঠিক পাশেই। সময়টি ছিল একদম ভোর, মাত্র আজান হয়েছে। আমার ঘুম তখন ভেঙে গেল। দেখলাম যে, আমার মা রেড ফোনে কারও সঙ্গে কানেকটেড ছিলেন। আমার মা বললেন যে, ‘আপনি একটু ধরুন, আমি এক্ষুনি ওনাকে দিচ্ছি।’
লক্ষ্য করলাম বাবাও এদিক-ওদিক ফোন করছেন। তখন রেড ফোনটা আমার মা দিলেন বাবাকে আর বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু ফোন করেছেন।’ ফোন ধরে কিছু শোনার পর বাবা বললেন, ‘আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমি এখনি ফোর্স নিয়ে আসছি। আপনি বের হবেন না। যেখানে আছেন সেখানেই থাকবেন।’ আমার মা তখন বাবাকে বললেন, ‘বঙ্গবন্ধুর গলা খুব কাঁপছিল, তিনি কী বললেন?’ বাবা ফোনটা রেখেই মাকে বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু বললেন, জামিল আমি মনে হয় আর বাঁচব না। কে বা কারা ৩২ নম্বরে অ্যাটাক করেছে। তুই আমাকে বাঁচা।’
এ কথা বলেই বাবা যেখানে প্রয়োজন-যেমন আর্মি চিফ, রক্ষী বাহিনী ও পুলিশসহ অন্যান্য জায়গায় ফোন করলেন। আফরোজা জামিল কংকা বলেন, মনে পড়ে সেদিন আর্মি চিফকে বাবা বললেন, ‘সফিউল্লাহ আমি ৩২ নম্বরের দিকে যাচ্ছি, তুমি ফোর্স পাঠাও।’ সিভিল ড্রেসে বাবা দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আমার মাকে বললেন, ‘আমার মেয়েদের দেখে রেখো।’ সেদিন গণভবনে বাবার পদোন্নতি উপলক্ষে একটি নৈশভোজের আয়োজন ছিল। বাবা বললেন, আজ রাতে নৈশভোজ আছে সেখানে দেখা হবে। কিন্তু সে সময়ই আমার মা কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। মা বাবাকে বললেন, ‘তুমি কি যাবে?’ বাবা তখন মায়ের দিকে একটু গম্ভীরভাবে তাকিয়ে বললেন, ‘কী বলছো তুমি? বঙ্গবন্ধুর এত বিপদ আর আমি যাব না!’
আমার বড় বোন তনু বাবাকে পানি এনে দিলেন, অর্ধেক সিগারেট খেয়ে ৩২ নম্বরে যাওয়ার উদ্দেশে ঘর থেকে যাত্রা শুরু করলেন। এত সকালে অফিশিয়াল গাড়ি না থাকায় বাবা তার পাকিস্তান থেকে আনা শখের গাড়ি লাল রঙা নিশান প্রিন্স-এ চেপে বসলেন। গাড়িচালক হিসেবে ছিলেন আইনুদ্দিন। গণভবনের সামনেই ২০০ প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট ছিল। বাবা তাদের সবাইকে প্রস্তুত হতে বললেন। এই রেজিমেন্টের লরি ৩২ নম্বরের দিকে এগিয়ে গেল, তার পেছনেই ছিলেন আমার বাবার গাড়ি। এটিই ছিল বাবাকে শেষবারের মতো দেখা। এরপর আমরা অনেক কিছু শুনছি, রেডিওতে ঘোষণা হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন আসছে। আমার মাও বঙ্গবন্ধুর এডিসির কাছে বাবার খোঁজ জানতে চাইলেন। কিন্তু কেউই কিছু বলছে না। সবাই জানে কিন্তু মাকে কেউ কিছু বলছে না।
জুমার নামাজের পর আর্মি চিফ সফিউল্লাহ আঙ্কেল ফোন করে জানালেন, ‘ভাবী জামিল ভাই আর নেই।’ এটি শুনে আমার মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। এরপর কারফিউ চলাকালেই একটু পর দুজন আর্মি অফিসার এসে আমাদের লালমাটিয়ায় চাচার বাসায় নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে সব রুম খুঁজে বাবাকে পেলাম না। সারাদিন এভাবেই গেল। অবশেষে অনেক চেষ্টার পর আর্মি থেকে রাত সাড়ে ১১টায় বাবার লাশটা দেওয়া হলো। আমার বাবার বন্ধু খোকন কাকু ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ অনেক চেষ্টা করে লাশটা আনলেন। আমার চাচার গাড়ি করেই তার লাশ নিয়ে আসা হলো। আমাদের তখন বাইরে যেতে হবে বলে জানানো হলো। অন্ধকারে একা একা বের হলাম।
বাবার লাশ বহনকারী গাড়িটা ড্রাইভওয়েতে রাখা ছিল। আর গাড়ির পেছনের সিটে বাবাকে শোয়ানো হয়েছিল। তার পা দুটো জানালা দিয়ে বের হয়েছিল। আমি পা দুটো ধরে বাবাকে দেখলাম। আমার আরও বয়স হলে হয়তো অন্যভাবে রিঅ্যাক্ট করতাম। কিন্তু সেই বয়সে ওই অন্ধকারে আর্মি সিপাইদের সামনে আমি দাঁড়িয়ে। সেই সিপাইরা বলেই দিয়েছিল কেউ চিৎকার করতে পারব না। সব মিলিয়ে এক ধরনের ভয় কাজ করছিল। তারপর বাবার লাশ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের বাড়িতেই গোসল করানো হলো। তখন ভিতর থেকে আমাদের ডাকা হলো। বড় বোন ও মা বাবার মাথার কাছে চুপ করে বসেছিলেন। নিজেদের আবেগ তারা কন্ট্রোল করছিলেন। আমার মা চিৎকার করে কাঁদতেও পারেননি। তারপর রাতের অন্ধকারে বনানী কবরস্থানে গিয়ে বাবাকে দাফন করা হলো।
পরে গাড়িচালক আইনুদ্দিনের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি বাবা যখন প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট নিয়ে সেখানে যান তখন হত্যাকারীরা বাবার কাছে আত্মসমর্পণ করে। যখন বাবা সেখানে প্রবেশ করছিলেন তখনই মেজর বজলুল হুদা এসে বাবাকে বলছিলেন, ‘হু ইজ দিস?’ বাবা বললেন, ‘দিস ইজ কর্নেল জামিল।’ তখন হুদা তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক সিপাইকে বললেন ‘শুট হিম’। কিন্তু সে গুলি করতে রাজি না হওয়ায় হুদা নিজেই স্টেনগান নিয়ে ব্রাশফায়ার করলেন। পরে সোবহানবাগ মসজিদের প্রত্যক্ষদর্শী ইমাম সাহেবের কাছ থেকে শুনেছি কালেমা তাইয়েবা পড়েই নাকি বাবার প্রাণ চলে গিয়েছিল। মনে পড়ে এর আগে ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে আমরা লাহোর থেকে যখন বাংলাদেশে ল্যান্ড করলাম বাবা তখন সরাসরি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চলে যান। কারণ বঙ্গবন্ধু বলেই রেখেছিলেন ‘এই অফিসারটিকে আমি দেখতে চাই’। আব্বা, সেদিন অনেক পরে প্রায় সন্ধ্যায় আমাদের কাছে ফিরলেন। প্রথম দেখাতেই বঙ্গবন্ধু বাবাকে বলেন, ‘জামিল আমি চাই তুই আমার কাছে থাকবি।’ আব্বা কোর অফ সিগন্যালসে ছিলেন এবং আর্মি ইনটেলিজেন্সের সব কোর্স তিনি করেছিলেন। সঙ্গত কারণেই তিনি বঙ্গবন্ধুর সিকিউরিটি কমান্ডেন্টের দায়িত্ব পেলেন।
আবার বঙ্গবন্ধু যখন প্রেসিডেন্ট হলেন আমার বাবা তখন প্রেসিডেন্টের মিলিটারি সেক্রেটারি বা সামরিক সচিব হলেন। এ জন্য আব্বাকে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা তার সঙ্গে থাকতে হতো। আমরা গণভবনের ভিতরে একটি বাসায় থাকতাম। জাতীয় সংসদ ভবনের স্থপতি লুই আইকান গণভবনে যে বাড়িটিতে থাকতেন আমরা সেই বাড়িটিতেই থাকতাম। অফিস সেখানেই হতো। আমার বাবাকে বঙ্গবন্ধু একদিন বলেছিলেন, ‘জামিল তুই আমার নয়নের মণি।’ আর সুসম্পর্কের খাতিরে আমার বাবা আমাদের পরিবারের সদস্যদের সামনে বঙ্গবন্ধুকে ‘বুড়া’ বলে এড্রেস করতেন। তিনি আমার মাকে বলতেন, ‘বুড়া একদম কথা শুনছে না... তার চারপাশে নিরাপত্তা আরও বাড়াতে হবে।’ দায়িত্ব নেওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা অনেক বাড়িয়েছিলেন তিনি। কারণ এর আগে যে কেউ তার সঙ্গে দেখা করার জন্য ঢুকে যেতেন, যে কেউ বঙ্গবন্ধুর অফিসে ঢুকে যেত। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা জোরদার করায় অনেকের আক্ষেপ ছিল।
অনেকে অভিযোগের সুরে আমার বাবা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে বলতেন, ‘স্যার আপনি কাকে আনলেন, কর্নেল সাহেব তো সরাসরি আমাকে আপনার কাছে আসার অনুমতি দেয় না।’ এর উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘ও আমার ভালোর জন্য যা প্রয়োজন মনে করছে তাই করছে।’ শেষের দিকে বাবা আমার মাকে বলেছিলেন, ‘জানো, আমার ভয় হয়, বঙ্গবন্ধু নিরাপত্তার বিষয়টি মানছেন না, আশঙ্কা করছি এর ফলে একটি গুলি আমার দিকে আর আরেকটি বঙ্গবন্ধুর দিকে লাগবে।’ ১৫ আগস্টের কিছু আগে বাবার পদোন্নতি হয়। তিনি ডিজিডিএফআই-এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পান। কর্নেল জামিলের মেয়ে বলেন, আর্মি আমার বাবাকে সত্যিকার অর্থে প্রকৃত মর্যাদা কোনো দিনই দেয়নি। এ নিয়ে মায়ের খুব ক্ষোভ ছিল। আর্মি থেকে তাকে কোনো গান স্যালুট দেওয়া হয়নি এবং এখনো পর্যন্ত তার প্রতি সেই সম্মানটাও দেখানো হয়নি। আজ পর্যন্ত কোনো আর্মি চিফ ১৫ আগস্টে বাবার কবরে ফুল দিতে যাননি। তাহলে প্রশ্ন থাকতে পারে আমার বাবা যে আর্মিকে ও দেশকে কলঙ্কমুক্ত করেছেন তার কি কোনো পাওনা নেই? তবে হাসিনা আপা বাবাকে বীরউত্তম খেতাব দিয়েছেন। ডিজিডিএফআই থেকেও যথেষ্ট সহযোগিতা করা হয়। আমার মা আঞ্জুমান আরা জামিল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সে সময় প্রথম একটি সাক্ষাৎকার দেন এবং সেই সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী।’ বিডি প্রতিদিন
১৫ আগস্ট ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস