রফিকুল ইসলাম রনি : দেশের রাজনীতি এককভাবেই নিয়ন্ত্রণ করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। রাজপথে মিছিল-সমাবেশ নেই। নেই হরতাল-অবরোধের মতো কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি। জাতীয় সংসদের বিরোধী দলও সরকারি দলের ভূমিকা পালন করছে। আওয়ামী লীগের অনেক এমপি, মন্ত্রী ও নেতা মাঝেমধ্যে ইস্যু তৈরি করে দিলেও তা নিয়ে রাজপথে সরকারবিরোধী আন্দোলন জমাতে পারছে না বিরোধীরা। বিএনপি কর্মসূচি ঘোষণা করলেও রাজপথে নামছে না। হাতে গোনা কয়েকটি বাম দল মাঝেমধ্যে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে প্রেসক্লাবের সামনে মিছিল-মিটিং করলেও অন্য বাম দলগুলো সরকারের বন্দনায় ব্যস্ত।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হেফাজতে ইসলাম বেকায়দায় থাকলেও এখন অনেকটাই সরকারের বশে। সরকারের মন্দ কাজেও রাজপথে বিরোধিতা করার মতো কোনো শক্তি নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় একরকম ফাঁকা মাঠেই ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে শাসক দল। সবই একক নিয়ন্ত্রণে আওয়ামী লীগের।
দশম সংসদ নির্বাচনের আগে মুখে হাসি, কপালে ঘাম দেখা দেয় আওয়ামী লীগের এমপি, মন্ত্রী ও নেতা-কর্মীদের। নির্বাচন হবে কি হবে না তা নিয়ে ছিল সংশয়ে। অনেক এমপি-মন্ত্রী এলাকায় যাওয়া-আসা ছেড়ে দিয়েছিলেন। এমনকি কেউ কেউ হেলিকপ্টারে গিয়ে দলীয় নমিনেশন পেপার জমা দিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এলাকা ছেড়ে আবার ঢাকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকানোর ঘোষণা দিলে ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাই বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তার কারণে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে এক বছর নির্বিঘ্নে পার করলেও চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিএনপি সরকারের পতনের এক দফা দাবিতে টানা হরতাল-অবরোধের ডাক দেয়। তিন মাস টানা হরতাল-অবরোধ দিয়ে জ্বালাও-পোড়াও ও নিরীহ মানুষ হত্যা করে দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে লেজ গুটিয়ে ঘরে ফিরে যায় বিএনপি।
তাদের এ কর্মসূচি থেকে সরে আসাকে দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা হিসেবেই মনে করছেন ক্ষমতাসীনরা। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে সরকার যা যা করা দরকার তাই করবে। রাজপথে সরকারবিরোধীদের নামার সুযোগ দেওয়া হবে না। কেউ নতুন কোনো ইস্যু যেন সৃষ্টি করতে না পারে সে ব্যাপারে রয়েছে কড়া সতর্কতা। যে কারণে দলীয় নেতা-কর্মীদেরও কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।
নিজ দলীয় নেতা-কর্মীদের জন্য কঠোর নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। অপকর্ম করলেই শাস্তি পেতে হবে। কোনো নেতা যদি কোনো অপরাধীর পক্ষে অবস্থান নেন কিংবা সুপারিশ করেন তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিরোধী পক্ষ অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াত যাতে কোনো প্রকার ষড়যন্ত্র না করতে পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। তারা যাতে কোনো ইস্যু তৈরি করে মাঠে নামতে না পারে সে জন্য সরকারের সব দফতর কড়া নজর রাখছে।
সম্প্রতি গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং গোপনে ওয়াসার পানির দাম বৃদ্ধি করা হলেও রাজপথে শক্তিশালী আন্দোলনের দেখা মেলেনি। গত রবিবার দেশব্যাপী বিএনপি মিছিল-সমাবেশের ডাক দিলেও খোদ রাজধানীতেই নেতা-কর্মীর দেখা মেলেনি। বিএনপির তৃণমূল নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, বিএনপির শীর্ষ নেতারা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে এবং গা বাঁচাতে সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে চলেন। তৃণমূলেও কিছু কিছু জায়গায় রাতে বিএনপি-দিনে আওয়ামী লীগ করছেন বিএনপির নেতারা।
সরকার যে এজেন্ডা বেঁধে দেয়, বিএনপি নেতারা সেই এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করেন। গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধিতে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি গত সপ্তাহে সংসদ থেকে ওয়াকআউট করে। এর প্রতিবাদে তারা একটি প্রতিবাদ সমাবেশের ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত সমাবেশ করেনি। দলের মধ্যেই বলাবলি হচ্ছে, সরকারের ইচ্ছায় জাতীয় পার্টি প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে সরে আসে। সংসদে জাতীয় পার্টির এমপি ও মন্ত্রীদের সরকারবন্দনা দেখে আওয়ামী লীগের এমপিরাও হাসিঠাট্টা করেন।
সিপিবি-বাসদসহ কয়েকটি বাম দল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তোপাখানা রোডে প্রতিবাদ-মিছিল সমাবেশ করলেও অন্য বাম দলগুলো নীরব। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টি প্রতিবাদ জানালেও জোটের অন্য বাম দলগুলোর জোরালো ভূমিকা চোখে পড়েনি। কিছু দিন আগেও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন করার চাপ থাকলেও এখন তা নেই। আওয়ামী লীগের পক্ষে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর ফলে এখন এ নিয়ে তারা আর কথা বলছেন না।
এ প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মীজানুর রহমান এই প্রতিবেদককে বলেন, এখন সরকারের যে উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে তা দেশের মানুষের কাছে আর স্বপ্ন নয়, তা বাস্তবতা। আর বিগত দিনে বিএনপির আন্দোলনে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল তাতে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়েছিল। মানুষ চায় রুজি-রোজগার। সরকারের অর্থনৈতিক সফলতার কারণে মানুষের রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা হয়েছে।
এ জন্য মানুষ রাজনীতি নয় নিজের আয় নিয়ে ব্যস্ত। এভাবেই মানুষ যখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকে, তখন রাজনৈতিক দলগুলো মিছিল-মিটিংয়ের জন্য লোক খুঁজে পায় না। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নবনির্বাচিত সদস্য সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট স ম রেজাউল করিম প্রতিবেদককে বলেন, বিএনপির ধ্বংসাত্দক কর্মসূচির ফলে তাদের কাছ থেকে দেশের মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে পর্যায়ক্রমে জনমুখী হয়ে উঠছে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে পারলে আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতে আরও বেশি জনপ্রিয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ প্রতিবেদককে বলেন, এখনো আগস্ট মাসের ৪০ দিনব্যাপী আমাদের কর্মসূচি শেষ হয়নি। এ কর্মসূচি শেষ হলে যে কয়েকটি সাংগঠনিক জেলার সম্মেলন হয়নি, সেগুলো সম্পন্ন করা, সহযোগী সংগঠনের সম্মেলন শেষ করা হবে।
তিনি বলেন, ফাঁকা মাঠে আমরা এখন দল গোছানোর কাজে মনোযোগী হব। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের একজন মন্ত্রী এই প্রতিবেদককে বলেন, দেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ। এ দলের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী জোট আছে। এটা আমাদের আদর্শিক জোট।
অন্যদিকে, বিএনপির নেতৃত্বে একটি জোট থাকলেও তাদের মধ্যে 'পরাজিত শক্তি একত্রিত হওয়ায়' ছাড়া কোনো আদর্শ নেই। যে কারণেই খালেদা জিয়া সিদ্ধান্ত নিলেও জোটের বা দলের নেতারা মাঠে নামেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঠিক নেতৃত্বে এখন সবকিছুই আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে।-বাংলাদেশপ্রতিদিন
১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে