শফিউল আলম দোলন : দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিতে চলছে অগোছালো অবস্থা। পরিস্থিতিকে খোদ দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারাই বলছেন 'ভয়াবহ'। তাদের ভাষ্যমতে, মাজার স্টাইলে চলছে একসময়ের ক্ষমতাসীন এ দলটি। ইচ্ছা করলে, যে কেউই গুলশান কার্যালয়ের কতিপয় কর্মকর্তার তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে যে কোনো সময় দলীয় প্রধান পর্যন্তও চলে যেতে পারেন। প্রয়োজনীয় বিনিময়ের মাধ্যমে বাগিয়েও নিতে পারেন দল বা অঙ্গসংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদ।
অন্যদিকে, দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সদস্যসহ ২০ দলীয় জোটের শরিক দলের শীর্ষ নেতারা দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও সহজে দেখা পান না জোটের শীর্ষ নেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসনের। আর তখন গোপনে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরবেই গুলশান কার্যালয় ছাড়েন তারা। খালেদা জিয়া ইচ্ছা করলেও দল পুনর্গঠন থেকে শুরু করে এখন আর যে কোনো সিদ্ধান্তও সহজে নিতে পারেন না কতিপয় কর্মকর্তার কারণে। তারা অক্টোপাসের মতো খালেদা জিয়াকে ঘিরে আছেন। দলীয় প্রধানকে দিয়ে বার বার জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানানো হলেও দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে রাখারও চেষ্টা করছেন এদের কেউ কেউ।
এ সম্পর্কে বিএনপি চেয়ারপারসনের একটি বিশেষ উইংয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা একজন কর্মকর্তার মন্তব্য হলো, "বিএনপি হলো একটা মাজারের। এখানে নানা মতের ও নানা কিসিমের লোকজন তাদের নিজ নিজ মানত নিয়ে আসেন। আবার কাজ শেষে চলে যান। কারও ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দলটি গঠনই করেছিলেন দলমত, ধর্ম-বর্ণ ও শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সব মানুষকে একটি 'আমব্রেলা'র নিচে সমবেত করার জন্য।
তবে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ প্রতিবেদককে বলেন, বড় দল থাকলে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতভিন্নতা থাকতেই পারে। তবে দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেগম খালেদা জিয়ার জাতীয় ঐক্যের ডাক অত্যন্ত সময়োপযোগী।
বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, দলের বিভিন্ন স্তরের কমিটি গঠন-পুনর্গঠনসহ সম্প্রতি দল বা চেয়ারপারসনের নামে বিবৃতি প্রদান থেকে শুরু করে ২০-দলীয় জোটের কর্মসূচি প্রণয়ন ও ঘোষণা পর্যন্ত গাছাড়া ভাব রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের অজান্তে তার নামে জয়পুরহাট বিএনপি সভাপতির মুক্তি দাবি করে ২৭ আগস্ট একটি বিবৃতি দেওয়া হয় গণমাধ্যমে। অথচ সেদিনই সরকার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিলেও সে সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।
অতঃপর একই দিন মাঝরাতে সেই বিবৃতি প্রত্যাহার করে নিয়ে পর দিন ২৮ আগস্ট আবারও তা পাঠানো হয় প্রকাশের জন্য। অতঃপর ২ সেপ্টেম্বর দিনের বেলায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে ৫ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করার পর হিন্দুধর্মাবলম্বীদের জন্মাষ্টমী উপলক্ষে রাতের বেলায় তা পরিবর্তন করে ৬ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করা হয়। এসব ঘটনার সিংহভাগই নজরেও আসে না খালেদা জিয়ার। তবে কয়েকটি ঘটনায় খালেদা জিয়া ভীষণ ক্ষুব্ধ বলে জানিয়েছেন একাধিক নেতা।
জানা গেছে, দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের ক্ষেত্রেই যত সমস্যা। তারা যেন কতিপয় কর্মকর্তার চক্ষুশূল। তবে বণিক ও শিল্পপতি শ্রেণির লোকজন এসব কর্মকর্তার কাছে অধিক প্রিয়। এ প্রসঙ্গে বিএনপির একজন প্রভাবশালী ভাইস চেয়ারম্যান দলের নয়াপল্টন কার্যালয়কে ঠাট্টা করে 'জাতীয়তাবাদী মিসকিনখানা' বলে অভিহিত করেন। অন্যদিকে, গুলশান কার্যালয়ের অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে 'বড় ব্যবসায়ী' বলে আখ্যায়িত করেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য, মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সহচর এবং বর্তমানে এলডিপি চেয়ারম্যান কর্নেল অলি আহমদ (অব.) এ প্রসঙ্গে পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, বিএনপি চালাতে হলে বেগম খালেদা জিয়াকে সবার আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, 'তিনি কি কর্মচারীদের নিয়ে দল চালাবেন, নাকি দলীয় নেতাদের নিয়ে চালাবেন?' এর আগে খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনের এক অনুষ্ঠানে সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছিলেন, 'জিয়ার আদর্শে আর বিএনপি নেই। আর এটাই বোধ হয় বিএনপির কোনো অনুষ্ঠানে আমার শেষ বক্তব্য। কারণ আমি জানি, আমার এ বক্তব্য অনেকেই ভালোভাবে নিতে পারবেন না।' যেই কথা সেই কাজ- তার সেই বক্তব্য সেদিন ভালোভাবে নিতে পারেননি কতিপয় ব্যক্তি। এখন সেটি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন বিএনপির এই প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব।
অবশ্য এর সঙ্গে জোটের একটি শরিক দলেরও পরোক্ষ ইন্ধন আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গুলশান কার্যালয় ও তার বাইরের ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি সিন্ডিকেটের বলয় বিএনপি চেয়ারপারসনকে অক্টোপাসের মতো এমনভাবে ঘিরে রেখেছে যে, বাকি জীবদ্দশায় তিনি আর এ থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন কি না, তা নিয়ে বিএনপির সাধারণ নেতা-কর্মীরা তো আছেই, (একজন ছাড়া) খোদ স্থায়ী কমিটির সদস্যরাও সন্দিহান। বিষয়টি কৌতূহলী ও হাস্যকর হলেও গুলশান কার্যালয়ের অনেক কর্মচারীরই ধারণা, উলি্লখিত বিতর্কিত কর্মকর্তারা বেগম খালেদা জিয়াকে একা পেয়ে 'জাদু-টোনায়' আবদ্ধ করে ফেলেছেন; যা থেকে তিনি আর সহজে বের হয়ে আসতে পারছেন না।
অন্যথায় দল ও জিয়া পরিবারের জন্য একের পর এক আত্দঘাতী সব সিদ্ধান্তই তারা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে, আর খালেদা জিয়া নিজেও সেসবে অকপটে সম্মতি দিয়ে যাচ্ছেন। পত্রপত্রিকাসহ সমগ্র মিডিয়ায় বহুদিন ধরেই এসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের খবর প্রকাশিত হওয়ার পরও এমন কী বাধা রয়েছে যে, সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে নূ্যনতম কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না একসময়ের 'আপসহীন নেত্রী' খালেদা জিয়া। উপরন্তু কোনো পত্রিকায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে কোনো সংবাদ প্রকাশিত হলে তারা নিজেরা 'ভালো সাজতে' সেই রিপোর্টের কাটিং বিএনপি চেয়ারপারসনের সামনে নিয়ে উপস্থাপন করে বলেন যে, তাদের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকার ষড়যন্ত্র করে এসব সংবাদ প্রকাশ করিয়েছে।
জানা গেছে, দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কোনো ত্যাগী নেতা বা শুভাকাঙ্ক্ষী কেউ যদি নিজের থেকে দলের জন্য ইতিবাচক কিছু করতে চান সে ক্ষেত্রে দেখা দেয় আরও বড় সমস্যা। একটি কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার শঙ্কিত মস্তিষ্ক তখনই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। অনেক সময় হিতাহিত জ্ঞান হারানোরও উপক্রম হয়ে যায় তাদের কারও কারও। এদের কারণেই দলের ভিতরে এখন নেই কোনো সমন্বয়-শৃঙ্খলা।
পরিকল্পিতভাবেই পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসে সংকট তৈরি করে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। সিনিয়র নেতাদের মধ্যে ফাটল ধরিয়ে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন তারা। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর দৌরাত্দ্যে নেতা-কর্মীদের এখন ত্রাহি অবস্থা। দলীয় নেতা-কর্মী তো বটেই, শরিক দলের নেতারাও চরম অতিষ্ঠ এসব কর্মকর্তার কর্মকাণ্ডে। এদের কারণেই মূলত সৌদি আরব ও লন্ডন সফরসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছে বিএনপি হাইকমান্ডকে।
মিডিয়ায় এত লেখালেখির পরও কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। অতিসম্প্রতি সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর দল ও জোট পুনর্গঠনসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছে বিএনপি হাইকমান্ডকে। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন নেতা দীর্ঘ প্রচেষ্টা ও অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে এ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেছিলেন। কিন্তু এখন তা ভেস্তে যাওয়ার পথে। গুলশান কার্যলয়ের বেশির ভাগ কর্মকর্তা ও কর্মচারীই এ ব্যাপারে অবগত। এমনকি কতিপয় বিতর্কিত কর্মকর্তা ও সাবেক আমলা-নেতাদের কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও চরম বিরক্ত ও অতিষ্ঠ। কিন্তু চাকরি যাওয়ার ভয়ে তারা মুখ ফুটে কেউ কিছু বলতে পারছেন না।
এদিকে বার বার জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হলেও নিজের দলের ভিতরের ঐক্যই বিএনপি কতটা ধরে রাখতে পারছে- সেটি বিবেচনা করেই কূল পাচ্ছেন না দলীয় নেতা-কর্মীরা। নির্বাহী কমিটির একাধিক সদস্য বলেন, খালেদা জিয়া আর তৃণমূল নেতা-কর্মীরা ছাড়া দলের জন্য আন্তরিক লোকের ভয়াবহ সংকট এখন বিএনপিতে। নীতিনির্ধারক কিংবা সিনিয়র পর্যায়ের আর যে কয়জন ছিলেন তাদের কেউ অসুস্থ, কেউ জেলে আর কেউ বা নিষ্ক্রিয় হয়ে মামলা-হয়রানির কারণে আত্দগোপনে আছেন। আর একটা ক্ষুদ্র অংশ রয়েছেন বিদেশে। তবে এর মধ্যেও বেশ আশাবাদী প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ।
তিনি জানালেন, খালেদা জিয়ার চলতি মাসেই লন্ডন যাওয়ার কথা রয়েছে। তিনি দেশে ফেরার পরপরই দল পুনর্গঠনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন। বিশেষ করে অধ্যাপক বি. চৌধুরী ও কর্নেল অলি আহমদ (অব.)সহ অন্যান্য দল থেকে যেসব পুরনো নেতা দলে ফেরার কথা রয়েছে তাদের ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি এবং চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন এ প্রক্রিয়াটি ইতিমধ্যেই অনেক দূর এগিয়েও নিয়েছেন।
অন্যদিকে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ কয়েক দিন ধরেই নতুন জাতীয় নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে বলছেন, নির্বাচন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।-বিডিপ্রতিদিন
১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে