রবিবার, ২১ আগস্ট, ২০১৬, ০৬:৩৫:০৯

‌‘মনে হয় ১২ সেকেন্ড আগের ঘটনা’

 ‌‘মনে হয় ১২ সেকেন্ড আগের ঘটনা’

উম্মে রাজিয়া কাজল : দেখতে দেখতে ১২ বছর পার হয়ে গেল। কিন্তু মনে হয় মাত্র ১২ সেকেন্ড আগের ঘটনা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার সেই দিনটির কথা এখনও স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। সেদিন জঙ্গিবিরোধী শান্তি সমাবেশে হঠাৎ করে গ্রেনেডের ছোবল অশান্তি বইয়ে এনেছিল আমার মতো অনেকের জীবনে। এক গ্রেনেড হামলা সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে।

সেদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সমাবেশস্থলের ট্রাকমঞ্চের খুব কাছাকাছি জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাদের সামনেই বসা ছিলেন সেদিনের ঘটনায় নিহত আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ অন্য নেতারা।

বিকেল ৫টা ২১ মিনিটে নেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়া মাত্রই বিকট শব্দে প্রথম গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটল। সেই গ্রেনেডের স্পিল্গন্টার বৃষ্টির মতো ছিটকে এসে আমার বাঁ পায়ে আঘাত করল।

এতে পায়ের পাতা ও আঙুলগুলো কুঁকড়ে গেল। প্রচণ্ড ব্যথার সঙ্গে প্রথমে পা ও পরে হাত দিয়ে চেষ্টা করছিলাম কুঁকড়ে যাওয়া পায়ের পাতা সোজা করতে।

এর পরই একটার পর একটা গ্রেনেডের বিস্ফোরণ। সেই সঙ্গে বিকট শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছিলাম। গ্রেনেডগুলোর স্পিল্গন্টার আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করছিল।

দেখতে না দেখতেই চারদিক ঘন ধোঁয়ায় ঢেকে গেল। চারপাশে মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচি আর আর্তনাদে এক বীভৎস পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো।

সেই অবস্থায়ই দেখার চেষ্টা করছিলাম, নেত্রী কোথায়। দেখলাম তিনি নিচু হয়ে বসে আছেন। আর আওয়ামী লীগের নেতারা অনেকটা মানবঢালের মতো হয়ে তার চারপাশ ঘিরে রেখেছেন।

এ সময় কীভাবে জানি না পিছিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পাশের বাটার দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলাম।

এক সময় পেছন থেকে গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। ভীষণ মাথা ঘুরতে শুরু করে। বারবার বাবা-মা আর বাসায় রেখে আসা মেয়ে, ছোট ছেলে আর ছোট চাচাতো ভাইয়ের কথা মনে পড়ছিল। আমার মৃত্যুর আগে যেন ওদের দেখে যেতে পারি- আল্লাহর কাছে সেই প্রার্থনাই করছিলাম।

এরপর আর কিছু মনে নেই। অজ্ঞান হয়ে পড়ি। পরে শুনেছি কার্যালয়ের প্রবেশপথে পড়া অবস্থায় আমাকে পাওয়া যায়। স্বেচ্ছাসেবক লীগের তৎকালীন আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সাইমুম সরওয়ার কমলসহ কয়েক নেতাকর্মী আমাকে উদ্ধার করে ট্যাক্সিক্যাবে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।

সেখানে অনেক আহত মানুষকে নিয়ে আসা হয়েছিল। তাই জায়গা না পেয়ে প্রথমে লাশের স্তূপের কাছে রাখা হয়। পরে কোনো ডাক্তার-নার্স না পাওয়ায় বাইরে এনে একটি ভ্যানে শুইয়ে রাখা হয়।

ওই ভ্যানে করেই আমাকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রাত ৯টা পর্যন্ত চিকিৎসার পর নেতারা আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে ও লুকিয়ে ট্রমা সেন্টারে নিয়ে যান।

কেননা প্রকাশ্যে নিয়ে গেলে পুলিশের হয়রানির ভয় ছিল। ৪ সেপ্টেম্বর কলকাতায় গিয়ে এক মাস চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরি।

এরপর গত ১২ বছরে দেশ-বিদেশে বহুবার চিকিৎসা নিয়েছি। এসব চিকিৎসার পর এখনও তিনশ'র বেশি স্পিল্গন্টার রয়ে গেছে শরীরে। অনেক স্পিল্গন্টার শিরার মধ্যেও ঢুকে গেছে।

এগুলোর কারণে এখনও শরীরে সব সময় তীব্র জ্বালাপোড়া, কামড়ানো ও যন্ত্রণা হয়। স্বাভাবিক কাজকর্ম তো করতে পারিই না, রাতে ঘুমানোটাও কষ্টকর হয়ে পড়ে অনেক সময়। বাম পায়ের কার্যক্ষমতা প্রায় লোপ পাওয়ায় ডান পায়ের ওপর ভরসা করেই চলতে হয়।

তার পরও একটিই চাওয়া জীবনে- যারা এই ঘৃণ্য ও নৃশংস ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের বিচার এবং শাস্তি হিসেবে ফাঁসি দেওয়া হোক। ১২ বছর হয়ে গেলেও এখনও আশা ছাড়িনি।

কেননা এদেশে দীর্ঘ সময় পরও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তাদের ফাঁসির রায়ও কার্যকর হচ্ছে। তাই যত সময়ই লাগুক না কেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাকারীদের বিচার করবেনই। এই বিশ্বাস নিয়ে এখনও বেঁচে রয়েছি। -সমকাল

লেখক : অ্যাডভোকেট উম্মে রাজিয়া কাজল এমপি, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহত স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহিলা সম্পাদক।
২১ আগস্ট,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে