শফিকুল ইসলাম সোহাগ : বর্তমান জাতীয় সংসদে স্বীকৃত প্রধান বিরোধী দল এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিতে চলছে নীরব সাংগঠনিক বিপর্যয়। 'সরকারি দল' না 'বিরোধী দল'-এরকম আত্মপরিচয় সংকটে থাকা দলটিকে সাম্প্রতিককালে রাজনৈতিক নিপীড়ন-নির্যাতন, কিংবা ধরপাকড় সামলাতে না হলেও সাংগঠনিকভাবে নিজকে গোছাতে পারছেন না দলটি। ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। গত জুলাই থেকে প্রতিবেদকের মাধ্যমে দেশের সব জেলায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত ও বামদলসহ সব রাজনৈতিক দলের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে। মৌলভীবাজারে 'মাঠে নেই জাপা' নোয়াখালীতে 'চোখে পড়ে না জাপা' সিরাজগঞ্জে 'নিষ্ক্রিয় জাপা' মানিকগঞ্জে 'অস্তিত্ব সংকটে জাপা' চুয়াডাঙ্গায় 'চুপচাপ জাতীয় পার্টি' লালমনিরহাটে 'সংকটে জাতীয় পার্টি' মাগুরায় 'নাজুক জাতীয় পার্টি' শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
অর্ধশত জেলার সাংগঠনিক অবস্থা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও কোনো জেলায় জাতীয় পার্টির অবস্থা ভালো এমন খবর নেই। কেন জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক এ দশা, নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, সাংগঠনিক কার্যক্রম না থাকা, সরকারি দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক, দলীয় বিশৃঙ্খলা, কথায় কথায় বহিষ্কারসহ নানান ইস্যুতে দলটির এ অবস্থা।
তারা বলেন, অধিকাংশ সাংগঠনিক জেলার কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে অনেক আগেই। সরকারে দলের তিনজন মন্ত্রী রয়েছেন। জাপা সরকারি দল না বিরোধী দল এটাই স্পষ্ট নয়। বঞ্চিত অনেক নেতা-কর্মী দল ছাড়ছেন।
জাপার প্রেসিডিয়ামের কয়েকজন সদস্য ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, সরকারের ভিতরে এক পা এবং বাইরে এক পা রেখে রাজনীতি করছে জাপা। দলটি না সোনার বাটি, না পাথর বাটি। নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার না হওয়ায় দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন। পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের মতবিরোধ অনেকটা প্রকাশ্য।
এরশাদ দল পরিচালনা করছেন। সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য এ বয়সেও তিনি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছেন। তিনি অধিকাংশ মন্ত্রী-এমপিদের পাশে পাচ্ছেন না। মন্ত্রী-এমপিরা রওশন এরশাদের সঙ্গে থাকেন। তাদের দলের কার্যক্রমে খুব একটা দেখা যায় না। তবে পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ দলীয় প্রধানের সঙ্গে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যান।
কারণ হিসেবে জেলা নেতারা বলছেন, আমরা ২২৭ জন বিভিন্ন জেলার নেতা স্যারের নির্দেশে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছি। এখন স্যার আমাদের কোনো খোঁজ নেন না। তাছাড়া ইতিমধ্যে বিভিন্ন জেলায় আমরা যারা নির্বাচন বর্জন করেছিলাম তাদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ৪০ এমপির ৩২ জনই দলের কর্মসূচিতে আসেন না। ৪২ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য।
এর মধ্যে আবার প্রয়াত কাজী জাফর আহমদের সঙ্গে রয়েছেন আটজন। ১৭ জনের উপদেষ্টা পরিষদ, ৪৬ জন ভাইস চেয়ারম্যান, ৩১ জন যুগ্ম মহাসচিব, ২৩ জনের সম্পাদকমণ্ডলী, ৩১ জন যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক, ২৩ জন যুগ্ম সম্পাদক এবং ৯১ জন কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্যকে নিয়ে বৃহৎ আকারের কমিটি রয়েছে। এসব কমিটির হাতেগোনা কয়েকজন নেতা নিয়মিত দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিলেও বাকিরা সাংগঠনিক কর্মসূচি থেকে অনেকটাই দূরে। জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক জেলা ৭৬টি। এর মধ্যে মাত্র ১৯টি জেলায় কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি হয়েছে।
এসব জেলার মধ্যে অন্তত ২৫টি জেলা আহ্বায়ক কমিটি এবং বাকিগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই চলছে। এমন কিছু সাংগঠনিক জেলা আছে, যেগুলোতে এক যুগের বেশি সময়ে কোনো কাউন্সিল হয়নি। গত রবিবার কুমিল্লায় ৩০ বছর পর জাতীয় পার্টির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কুমিল্লা টাউন হল মিলনায়তনে সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এ সময় নেতা-কর্মীদের সরব উপস্থিতি দেখে এরশাদ আপ্লুত হন।
তিনি এও বলেন, '৯০-এর পর প্রথম কুমিল্লা জেলা সম্মেলন হলো। কিন্তু এর আগে রাজশাহী, বরিশালের সম্মেলনে এরশাদের উপস্থিতিতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আবার আগামী ১০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জেলা সম্মেলন জাতীয় পার্টির। সেখানেও বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা রয়েছে। পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সোলায়মান আলম শেঠ জানান, এই সম্মেলনের মাধ্যমে চট্টগ্রামে পার্টির কবর রচনা করা হবে।
এ বিষয়ে জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছোটভাই ও প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক মন্ত্রী গোলাম মুহম্মদ কাদের এই প্রতিবেদকের জানান, জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা ভালো যাচ্ছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। রাজনীতির মতো জাতীয় পার্টিও ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। জাপা আওয়ামী লীগের মন রক্ষা করে চলছে। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড বলে কিছু নেই। রাজধানী থেকে কমিটি করে কেন্দ্রে গিয়ে নাম ঘোষণা করা হচ্ছে। তবে জাতীয় পার্টির সম্ভাবনা আছে। লক্ষ্য ঠিক করতে পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ আছে। সামগ্রিক বিষয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু প্রতিবেদককে বলেন, গত রবিবার কুমিল্লায় সম্মেলন হয়েছে। সেখনে প্রচুর লোক সমাগত হয়েছে।
আগামী ১০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মহানগরে, ১৩ সেপ্টেম্বর যশোর ও ১৪ সেপ্টেম্বর খুলনায় সম্মেলন হবে। ঈদের পর বাকি জেলাগুলোর সম্মেলন শেষে আগামী বছরের জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের টার্গেট রয়েছে।
তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী। আগামী জাতীয় নির্বাচনে ১৫১ আসনের টার্গেট নিয়ে মাঠে নেমেছি। এ লক্ষ্য অর্জনে পার্টির চেয়ারম্যানও মাঠে নেমেছেন। পার্টির চেয়ারম্যানের সরাসরি তত্ত্বাবধানে কেন্দ্র থেকে মাঠপর্যায়ে নতুন করে দলকে সাজানো হচ্ছে।
পার্টির চেয়ারম্যানের সার্বিক নির্দেশনায় সঠিক ও দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে দলকে সারা দেশে শক্তিশালী করার কাজ চলছে। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। সরকারের গণবিরোধী প্রতিটি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আমরা রাজপথে ও সংসদে সোচ্চার আছি। আমরা আগামীতে জনগণের সমর্থন নিয়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হতে চাই। সরকার গঠন করতে চাই। সে লক্ষ্যেই কাজ করছি।-বিডিপ্রতিদিন
১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে