সোমবার, ২২ আগস্ট, ২০১৬, ০২:০০:২৮

স্বামীর প্ররোচনায় জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়ালেন যেসব স্ত্রীরা

স্বামীর প্ররোচনায় জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়ালেন যেসব স্ত্রীরা

নিউজ ডেস্ক : সিরাজগঞ্জে আটক চার নারী তাদের স্বামীদের প্ররোচনায় জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিল। তাদের স্বামীরা ছাড়াও পরিবারের কোনও না কোনও সদস্য আগে থেকেই জঙ্গি তৎপড়তার সঙ্গে জড়িত। বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। গত ২৪ জুলাই সিরাজগঞ্জ শহরের মাছিমপুর এলাকা থেকে এই চার নারীকে জেএমবি সন্দেহে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় তাদের আস্তানা থেকে  জিহাদি বই, ককটেল ও গ্রেনেড তৈরির উপকরণ জব্দ করা হয়। বর্তমানে  তারা কারাগারে রয়েছে। আমাদের বগুড়া,গাইবান্ধা ও সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধির পাঠানো প্রতিবেদন:

হাবিবা নিহত জঙ্গি জুয়েলের আত্মীয়, সাত মাস যোগাযোগ নেই রুমানার

বগুড়া প্রতিনিধি নাজমুল হুদা নাসিম জানান, সিরাজগঞ্জে বোমা, জিহাদি বই ও গ্রেনেড তৈরির সরঞ্জামসহ গ্রেফতার জেএমবির চার নারী জঙ্গির মধ্যে হাবিবা আকতার ও রুমানা আকতারের বাবার বাড়ি বগুড়ার শাজাহানপুরে। এরা স্থানীয় নগর আজিরন রাবেয়া মহিলা আলিম মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছে। হাবিবা আকতার বগুড়ার শেরপুরে গ্রেনেড বিস্ফোরণে নিহত জঙ্গি তরিকুল ইসলাম জুয়েলের আত্মীয়। হাবিবার ভাই মতিউর রহমানও অনেকদিন ধরে এলাকায় আসেন না। পরিবারের অধিকাংশই জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে জড়িত ধারণা এলাকাবাসীর। এদিকে, সাত মাসেরও বেশি সময় ধরে  মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ নেই রুমানা আকতারের।

হাবিবা আকতার বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার আমরুল ইউনিয়নের প্রত্যন্ত ক্ষুদ্র ফুলকোট গ্রামের কৃষক দবির উদ্দিনের মেয়ে এবং রুমানা আকতার একই ইউনিয়নের পরানবাড়িয়া গ্রামের দরিদ্র রং মিস্ত্রী রফিকুল ইসলাম তোতার মেয়ে।

হাবিবার ভাই রাশেদুল ইসলাম ওরফে বাবলু ওরফে মতিয়ারের (২৭)বিরুদ্ধে নাশকতা  জঙ্গির হামলার সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে পুলিশের কাছে।বর্তমানে সে পলাতক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৩ এপ্রিল রাতে বগুড়ার শেরপুরের জুয়ানপুর কুঠিরভিটা গ্রামে ভাড়া বাসায় গ্রেনেড তৈরির সময় বিস্ফোরণে চট্টগ্রাম অঞ্চলের জেএমবির সামরিক শাখা প্রধান ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার জোড়াবড়িয়া গ্রামের নুরুল ইসলাম খানের ছেলে রাইসুল ইসলাম খান ওরফে ফারদিন ও সিরাজগঞ্জ সদরের জামুয়া গ্রামের মাওলানা আবু বক্কর সিদ্দিকের ছেলে কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী জেএমবির সদস্য তরিকুল ইসলাম জুয়েল নিহত হয়। নিহত জঙ্গি জুয়েল গত ২৩ জুলাই রাতে সিরাজগঞ্জের মাছুমপুর এলাকায় হুকুম আলীর বাসা থেকে গ্রেফতার নারী জঙ্গি হাবিবা আকতারের বোন শাহনাজের মামা শ্বশুর। শাহনাজের স্বামী রায়হানকে শেরপুর থানা পুলিশ কিছুদিন আগে ওই ঘটনায় গ্রেফতার করেছে।

প্রতিবেশিরা জানায়, জঙ্গি হাবিবার ভাই মতিউর রহমান অনেকদিন ধরে এলাকায় আসে না। সে নিজে বোনদের বিয়ে দিয়ে আবারও চলে যায়। জামাইরা কখন আসতো কখন যেত তা কেউ দেখেনি। এ পরিবারের সবাই জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে জানায় তারা।

জঙ্গি রুমানা আকতারের মা শাহনাজ বেগম জানান, স্বামী রং মিস্ত্রি ও তিনি সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালান। মেয়ে রুমানা স্থানীয় নগর আজিরন রাবেয়া মহিলা আলিম মহিলা মাদ্রাসা থেকে আলিম পাস করেছে। সেলাইয়ের কাজের বোতাম, ফিতা আনতে শেরপুর উপজেলা শহরের মুজাহিদের সুতার দোকানে যেত। সেখানে পরিচয় হয় কর্মচারী সুজনের সঙ্গে। একপর্যায়ে শেরপুরে জনৈক সালমার বাড়িতে সুজনের সঙ্গে রুমানার বিয়ে হয়। সেখানে কিছুদিন ভাড়া বাড়িতে থাকতো তারা। সুজন নিজেকে এতিম দাবি করে এবং বাড়ি ঢাকার গাজীপুর জেলায় বলেছিল। তবে তিনি (মা) কোনোদিন মেয়ের বাড়িতে যাননি। গত প্রায় ৮ মাস মেয়ে বা জামাই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি।

আবদুল্লাহ নামে এক প্রতিবেশি ও কয়েকজন নারী জানান, জামাই সুজন মাঝে মাঝে আসলেও কারও সঙ্গে মিশতো না। স্ত্রী রুমানাকে অতিরিক্ত পর্দার মধ্যে রাখতো। দোকান মালিক মুজাহিদ পরবর্তীতে জেএমবির সদস্য হিসেবে গ্রেফতার হয়।

নগর আজিরন রাবেয়া মহিলা আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাহমুদুল হাসান জানান, হাবিবা ২০১৪ সালে দাখিল ও রুমানা একই বছর আলিম পাস করে। শিক্ষার্থী অবস্থায় তারা জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল কিনা তা জানা নেই।

বগুড়ার ডিবি ইন্সপেক্টর আমিরুল ইসলাম জানান, সিরাজগঞ্জে গ্রেফতার দুই নারী জঙ্গি রুমানা ও হাবিবা তাদের তালিকাভুক্ত নয়। এমনকি হাবিবার ভাই মতিউর রহমানের নামও তালিকায় নেই।

শাজাহানপুর উপজেলার আমরুল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান জানান, ওই দুটি পরিবার সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না। দুইজনেই স্বামীর বাড়িতে গিয়ে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়ে পড়েছে।

শাজাহানপুর থানার ওসি আবদুল্লাহ আল মাসউদ চৌধুরী জানান, দুটি পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়ার কাজ চলছে।

অপরাধ করলে আমার মেয়ের বিচার হোক: রুনার মা

গাইবান্ধা প্রতিনিধি তাজুল ইসলাম রেজা জানান, সিরাজগঞ্জ থেকে জঙ্গি সন্দেহে গ্রেফতার চার নারীর একজন রুনা বেগমের (১৯) মা হামিদা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রশাসনের লোক বাড়িতে আসার পর আমরা জানতে পারি, আমাদের মেয়ে গ্রেফতার হয়েছে। আমার মেয়ে কোনও অপরাধ করলে তার বিচার হোক, এটাই আমরা চাই।’     

রুনা বেগমের (১৯)বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের বোচাদহ গ্রামে। সে ওই গ্রামের দিনমজুর আমিরুল ইসলামের (৫৫) মেয়ে। ছয় ভাইবোনের মধ্যে রুনা বেগম পঞ্চম।তার ভাইয়েরা দিনমজুরের কাজ করেন। গ্রেফতার হওয়া রুনা বেগমের সঙ্গে তিনবছর আগে একই গ্রামের জহুরুল সর্দারের ছেলে মামুরুল ইসলাম সর্দার ওরফে মামুনের (৩০) বিয়ে হয়। এই দম্পতির সুমাইয়া নামে একটি মেয়ে রয়েছে। স্বামী মামুরুল ইসলাম সর্দার ওরফে মামুন আগে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালাতো।

মামুনের বাবা জহুরুল সর্দারও দিনমজুরের কাজ করেন। পাশাপাশি তিনি একটি মসজিদের ইমাম।

গত শনিবার দুপুরে বোচাদহ গ্রামে রুনা বেগমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়,বাড়িতে ছোট একটি টিনসেডের ঘরে থাকে তার বাবার পরিবার। বাবা আমিরুল ইসলাম দিনমজুরের কাজে গেছেন। মা হামিদা বেগম (৪৭) এবং দাদি ফজর বিবি (৯০) দুজনই রুনার জন্য কাঁদছেন।

রুনার মা হামিদা কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন, ‘গত বোরো ধান কাটা মৌসুমে মেয়েটা তার ছোট বাচ্চা নিয়ে বাড়িতে এসেছিল। জামাই আসেনি। পরে কাজের কথা বলে মেয়ে ঢাকায় গেছে। ওখানে কী করেছে সেটা আমরা জানি না।’

রুনা বেগমের বাবার বাড়ি থেকে ৫০০ গজ দূরে স্বামী মামুনের বাড়ি। সে বাড়িতেও দুটি মাত্র কুড়ে ঘর। রুনার শ্বাশুড়ি লিলি বেগম বলেন, ‘আটমাস আগে আমার ছেলে মামুরুল তার নামে একটি ঘর লিখে চেয়েছিল। আমি দিইনি। তখন সে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে রাগ করে ঢাকায় যাবার কথা বলে বাড়ি থেকে চলে যায়। যাবার সময় বলে যায়, নিজে ঘরের টাকা কামাই (উপার্জন) করা না পর্যন্ত বাড়ি ফিরবে না।সেই  থেকে ছেলের সাথে যোগাযোগ হয় না। ছেলে কাজের কথা বলে ঢাকায় গেছে। তার বউ কী করছে আমরা জানি না।

বোচাদহের স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রুনা বেগম ও তার স্বামী উভয়ই গরিব পরিবারের সন্তান।রুনা গ্রেফতার হওয়ার পর তারা জানতে পারেন যে, সে জেএমবির সদস্য।

গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসি মোজাম্মেল হক সিরাজগঞ্জ থেকে গ্রেফতার রুনা বেগম সম্পর্কে জানান, এই নারী ও তার স্বামী মামুরুল ইসলাম সর্দার ওরফে মামুনের নামে থানায় কোনও মামলা নেই।তারা কোনও জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় জড়িত কিনা তা খতিয়ে করে দেখা হচ্ছে।

‘জামাই রানীকে জেএমবি বানাইবো আগে জানলে ছাড়াইয়া নিতাম’

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি আমিনুল ইসলাম রানা জানান,  ‘বাবারে আর কত তথ্য নেবেন। এত কষ্ট কইরা মেয়েডারে লেখাপড়া শিখাইয়া বিয়ে দিলাম। ভাবছিলাম স্বামী ছোয়াল-পোয়াল নিইয়া সুখেই থাইকবো। কিন্ত হেডা আর হইলো না। আগে কি জানতাম জামাই তাকে জেএমবি বানাইবো। জানলে আগে ভাগেই ছাড়াইয়া নিতাম। কথাগুলো বলছিলেন সিরাজগঞ্জে ডিবি পুলিশের হাতে আটক উল্লাপাড়ার সলঙ্গা থানার বাদুল্লাপুর গ্রামের মৃত সুজাবত আলীর মেয়ে তাবাসুম রানীর (৩০)মা খালেদা বেওয়া। শনিবার বিকেলে রানীর গ্রামের বাড়িতে গেলে তার মা এ প্রতিনিধির কাছে এ ধরনের আকুতি জানান।

তিনি বলেন, বাবারে টেলিভিশনে খবর শুনে জানতে পারলাম যে, আমার মাইয়া রানীসহ ৪ জন ধরা পইড়ছে। জানতামও না রানী সিরাজগঞ্জ থাকে। আমরা জানি রানী গোবিন্দগঞ্জের পার্বতিপুরে স্বামীর বাড়িতে থাকে। আর তার স্বামী মাহবুব ঢাকায় হারবাল কোম্পানিতে চাকরি করে। বাবারে এহুন আমরা মুখ দেখাইতে পারতাছি না।

রানীর ভাবী নাসরিন বেগম বলেন, আমার শশুড়ের ৬ মেয়ে ও ২ ছেলে। রানী সকলের ছোট। বাবা ফুড অফিসের পিয়ন ছিলেন। গত ৬ বছর আগে শশুড় মইরা গেছেন। মরনের আগে হে নিজেই রানীর সাথে মাহবুবের বিয়ে দেন। হেই খোঁজ-খবর নিয়ে বিয়ে দিছিলেন। আমরা তেমন কিছু জানি না। রানীর দুইডা মাইয়া। হেরাও এহুন রানীর সাথে জেলে। এতবড় কলঙ্ক। গ্রামের মানুষের কাছে আমরা মুখ দেখাইতে পারতাছি না।

গত ২৪ জুলাই সিরাজগঞ্জ জেলা শহরের মাছিমপুর মহল্লার হুকুম আলীর বাড়ি থেকে জেএমবির ওই ৪ সন্দেহভাজন নারীকে আটক করে ডিবি। এদের মধ্যে নাদিরা তাবাসুম রানীর বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার সলঙ্গা থানার বাদুল্লাপুর গ্রামে। তারা বাবা মৃত সুজাবত আলী। রানী স্থানীয় ফুলজোড় ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করার পর  ৬ বছর আগে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার পাবর্তীপুর গ্রামের মাহবুবুর রহমানের সাথে বিয়ে হয়। মাহবুব হারবাল ওষধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি ছিলেন। রানীর সাড়ে ৩ এবং দেড় বছরের দুকন্যা সন্তান। জেলা কারাগারে রানীর সাথেই রয়েছে শিশুদুটি।

জেএমবির এই চার নারী সদস্য বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলা কারাগারে রয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশও বলছে,নিজ নিজ স্বামী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই মূলত এরা জেএমবির কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। তারা কি কারণে সিরাজগঞ্জে ঘাঁটি গড়েছিল, সে বিষয়টিও এখনও পুলশের পুলিশের অস্পষ্ট।

সিরাজগঞ্জের গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি ওয়াহেদুজ্জামান বলেন, এরা মূলত তাদের স্বামীদের অনুসারী। কিন্তু চার জনার স্বামীকেই কাউকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এদের একজনের বাড়ি সিরাজগঞ্জ হলেও স্বামীর বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ। সে স্বামীর প্ররোচণায় সে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। অন্য তিনজনের বাড়ি গাইবন্ধা ও বগুড়া জেলায়। আমরা তৎপর হলেও ওই দুই জেলা থেকে সেভাবে সহযোগিতা পাচ্ছি না।

সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, এ মামলাটি খুবই স্পর্শকাতর, খুব চিন্তাভাবনা করে তদন্ত করা হচ্ছে।গ্রেফতার নারীরা জেএমবির সক্রিয় সদস্য এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তারা সিরাজগঞ্জে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে যে এসেছিল, তা স্পষ্ট। সিরাজগঞ্জে এসে তারা কাদেরকে সদস্য করেছে, সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। -বাংলা ট্রিবিউন
২২ আগস্ট, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে