ঢাকা : ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে রাজধানীর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সংগঠিত হয়ে রাজপথে নামার পরিকল্পনা নিয়েছে। ভ্যাট দিবো না গুলি কর! এই পরিকল্পনা অনুযায়ী বৃহস্পতিবার সকাল থেকে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পৃথকভাবে একত্র হয়ে সড়কে অবস্থান কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের কাছ থেকে ‘ভ্যাট প্রত্যাহারের’ আশ্বাস ছাড়া তারা আন্দোলন থেকে পিছু হটবে না।
বুধবার রাতে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবরোধ সাময়িক প্রত্যাহার শেষে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বৈঠক সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
এর আগে রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধের আন্দোলনে যোগ দিয়ে একাত্মতা ঘোষণা করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, নর্দান ইউনিভার্সিটি ও ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী অভি বলেন, আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার বিষয় একমত হয়েছি। ভ্যাট প্রত্যাহর না হওয়া পর্যন্ত আমরা সড়ক অবরোধ করব। তিনি বলেন, আমরা বৃহস্পতিবার সকাল ৯ টা থেকে ফের সড়কে অবস্থান কর্মসূচি পালন করব।
এর আগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফির ওপর আরোপিত সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনরত ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষে গতকাল বুধবার রাজধানীর রামপুরা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রারসহ আহত হয়েছেন ৩০ জন। বিশ্ববিদ্যালয় আজ বৃহস্পতিবার বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল রাত সোয়া ৯টার দিকে অবরোধ প্রত্যাহার করেন শিক্ষার্থীরা। তবে দুপুর ১টা থেকে রাত সোয়া ৯টা পর্যন্ত প্রধান সড়ক দফায় দফায় অন্তত সাড়ে ছয় ঘণ্টা বন্ধ থাকায় আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। ভোগান্তিতে পড়েন হাজার হাজার নগরবাসী। আজ সকাল ১০টা থেকে একই দাবিতে আবারও অবস্থান কর্মসূচি পালনের কথা জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
রামপুরা এলাকায় বাড্ডার আফতাবনগরে দুই দফায় সংঘর্ষে পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার মাশফিকুর রহমানসহ অন্তত ছয়জন গুলিবিদ্ধ হন। এ ছাড়া পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাসে আরও অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন। শিক্ষার্থীরা পুলিশ ফাঁড়ি ভাংচুর করেছে। আহত শিক্ষার্থীদের স্থানীয় বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
ইস্ট ওয়েস্টের উপাচার্য আহমদ শফী রাতে প্রতিবেদককে বলেন, এটি ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনের একটি অংশ। শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হতেই পারে। গুরুত্বপূর্ণ সড়ক বন্ধ করে শিক্ষার্থীরা জনগণের ভোগান্তির কারণ হোক, সেটা তারা চাননি। শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে ক্যাম্পাসে নেওয়া হয়। তখনই বিনা উসকানিতে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে। অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এ ছাড়া আরও কয়েকজন ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়। এটা পুলিশের বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়।
এ ব্যাপারে বাড্ডা থানার ওসি এম এ জলিল এই প্রতিবেদককে বলেন, শিক্ষার্থীরা পুলিশকে আক্রমণ করে এবং আফতাবনগরে পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা-ভাংচুর চালায়। এতে তিনিসহ সাত-আট পুলিশ সদস্য আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। তখন শিক্ষার্থীদের কয়েকজন আহত হয়ে থাকতে পারেন।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করে সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গত ৪ জুলাই এ-সংক্রান্ত আদেশ জারির পর থেকেই এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন। গতকালই বড় ধরনের সংঘর্ষ হলো। সরকারের পক্ষ থেকে আগেই বলা হয়েছে, এই ভ্যাট প্রত্যাহার করা হবে না।
ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এক ছাত্রী প্রতিবেদককে বলেন, ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন কর্মসূচি ছিল শিক্ষার্থীদের। এতে শিক্ষকদেরও সমর্থন ছিল। তিন শতাধিক শিক্ষার্থী দুপুরে ক্যাম্পাসসংলগ্ন রামপুরা সড়কে মানববন্ধন করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। এতে দুই পক্ষের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তারা পুলিশ কর্মকর্তাদের বলেন, শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করবে, তাদের যেন আঘাত না করা হয়। একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা এবং পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোস্তাক আহমেদ তাদের সরে যেতে অনুরোধ করেন। এ সময় পুলিশের একটি রায়টকার ও দুটি জলকামান ঘটনাস্থলে আসে। উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার চলে যাওয়ার পরপরই পুলিশ মারমুখী হয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। পুলিশ গুলি ছুড়লে বেশ কয়েকজন আহত হন।
শিক্ষার্থীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেটে আহত হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার মাশফিকুর রহমান, শিক্ষার্থী মুনি্ন, রাশেদ, শামীম, সানি ও ইয়াসির। এ ছাড়া সংঘর্ষে আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে গুরুতর আহত মাশফিক এলাহী চৌধুরীকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যদের বনশ্রীর ফরাজী হাসপাতালসহ স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
ফরাজী হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গুলিবিদ্ধসহ আহত ১৭-১৮ শিক্ষক-শিক্ষার্থী তাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। আহতদের মধ্যে তানজিবুল ইসলামকে রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার শরীরে ছররা গুলির চিহ্ন রয়েছে।
ইস্ট ওয়েস্টের জনসংযোগ কর্মকর্তা এস এম মহিউদ্দিন এই প্রতিবেদককে বলেন, এই ক্যাম্পাসে তাদের মোট ১০ হাজার ছাত্রছাত্রী রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার ব্যয় বহন করছে। প্রাথমিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে অনেককে চিকিৎসা দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকবে। সংঘর্ষের পর এক জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর শিক্ষার্থী রায়হান ও সিএসইর শিক্ষার্থী জাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কর্মসূচিতে পুলিশ গুলি ছুড়েছে এবং লাঠিপেটা করেছে।
পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মোশতাক আহমেদ দাবি করেন, পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে আন্দোলনকারীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছে, তবে গুলি ছোড়া হয়নি।
আন্দোলনরতরা জানান, মূলত দুপুর ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা জড়ো হন। এর পর ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে তারা রামপুরা ব্রিজ এলাকায় মানববন্ধন করেন। এ সময় তারা নানা রকম স্লোগান দেন। তাদের হাতে 'ভ্যাট দেব না, গুলি করো', 'গুলি করো, মেরে ফেলো, ভ্যাট দেব না ভ্যাট দেব না', 'নো ভ্যাট, গুলি করো এসব স্লোগান লেখা পোস্টার দেখা যায়। একপর্যায়ে দুপুর ২টার দিকে পুলিশ পেঁৗছে তাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা সরকারের পক্ষ থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা ছাড়া আন্দোলন থেকে পিছু হটতে রাজি ছিলেন না। এ নিয়ে বাকবিতণ্ডা থেকেই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এর জের ধরে প্রায় দেড় ঘণ্টা রামপুরা সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকে। পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং রাবার বুলেট ছুড়ে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দিলে ফের যান চলাচল শুরু হয়। তবে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে শিক্ষার্থীরা ফের সড়কে অবস্থান নেন। এতে ওই সড়কে আবারও যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে বাড্ডা, লিংক রোড, মালিবাগ, রামপুরা, কুড়িল বিশ্বরোড, হাতিরঝিলসহ আশপাশের সব সড়কে তীব্র যানজট দেখা দেয়।
এদিকে পুলিশের দাবি, শিক্ষার্থীদের হামলা-ভাংচুরের কারণেই অ্যাকশনে যেতে বাধ্য হয় তারা। বাড্ডা থানার ওসি বলেন, দুপুরে তারা রাস্তা অবরোধের চেষ্টা করলে প্রথমে তাদের বুঝিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়। এতে কাজ হয়নি। পরে পুলিশের ওপর আক্রমণ করা হলে তাদের ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা পুলিশের আফতাবনগর এলাকার ক্যাম্পে হামলা চালায় ও ইটপাটকেল ছোড়ে। রামপুরা থানার অপারেশন অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান প্রতিবেদককে বলেন, ঘটনাস্থল রামপুরা থানা এলাকার সীমান্তবর্তী হওয়ায় শুরু থেকেই সেখানে বাড়তি পুলিশ রাখা হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে জলকামানও।
১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে