হাবীব রহমান : রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পক্ষে শক্ত অবস্থান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ না হলে ‘রাজনীতির গতিপথ পাল্টে যেতে পারে’- বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের এমন বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উনি আসুক। পারলে রাজনীতির গতিপথ পরিবর্তন করুক। বাইরের দালালি করে দেশের ক্ষতি করা বের হয়ে যাবে।
সোমবার বিকেলে ৪টা ২০ মিনিট থেকে প্রায় ঘণ্টাখানেক কেন্দ্রীয় ১৪ দলের একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে। প্রায় এক ঘণ্টার সাক্ষাৎ ও বিকেলের নাস্তা পর্বে প্রধানমন্ত্রী জোট নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন। ১৪ দলের একটি প্রতিনিধি দল গতকাল মঙ্গলবার সকালে চীনের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছে। ১৩ সদস্যের এ দলের নেতৃত্বে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এ সফরে যাওয়ার আগেই সোমবার প্রতিনিধি দলের সদস্যরা এবং ১৪ দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জোটের কয়েক নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে এ প্রতিবেদকের আলাপ হয়েছে।
জোটের নেতাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করি না। আমাদের এখানেও কারো কোনো হস্তক্ষেপ আমরা মেনে নেব না। এটা জাতির জনকের দেয়া আমাদের পররাষ্ট্র নীতির অংশ- সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব; কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়।
জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল রামপাল পরিদর্শন করেছে। সে বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিপু প্রতিনিধি দলকে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে গেছে। হেলিকপ্টার থেকে সঠিক চিত্র প্রতিনিধি দল দেখতে পায়নি। সুন্দরবন থেকে প্রকল্পের জায়গা ৬৫ কিলোমিটার দূরে। তাদের বাসে নিয়ে গেলে তারা সঠিক চিত্র দেখতে পেতেন।
শনিবার সিপিবি ও বাসদ, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেয়। সেখানে সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, প্রধানমন্ত্রী আপনি জেনে রাখবেন, রাজনীতিতে পরিবর্তন এনে হলেও আমরা সুন্দরবনকে রক্ষা করার সংগ্রাম অব্যাহত রাখব। আর বাসদের একাংশের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, এই প্রকল্প থেকে সরে আসেন। তা না হলে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। বৃহত্তর আন্দোলনে রাজনৈতিক অবস্থার গতি পরিবর্তনও ঘটে যেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী তাদের একহাত নিয়ে তাদের বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেন। সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কার দালালি করছেন? বাইরের দালালি করে দেশের ক্ষতি করা বের হয়ে যাবে। দালালদের কিভাবে সোজা করতে হয় আমরা জানি।
১৪ দলের নেতাদের সবাই রামপাল বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন। তবে জাসদ (ইনু) সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার আন্দোলনকারীদের দাবির বিষয়টি জানিয়ে বলেন, আর ১৫ কিলোমিটার দূরে প্রকল্পটি করলে আন্দোলনকারীরা দাবি মেনে নিতে পারে। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটার ফিজিবিলিটি স্টাডি হয়েছে। সুন্দরবনের যেন কোনো ক্ষতি না হয়; সেজন্য ৬৫ কিলোমিটার দূরে এ প্রকল্প করা হয়েছে। চারদিকের পরিবেশ ও নদীপথের বিভিন্ন হিসাব করেই জায়গাটি নির্ধারণ করা হয়েছে।
এদিন প্রধানমন্ত্রী বিএনপি, যুদ্ধাপরাধের বিচার, বিভিন্ন বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের মুখে পড়া ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা নিয়ে কথা বলেন দীর্ঘ আন্দোলনের জোটসঙ্গী ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে।
রূপপুর পারমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে জোট নেতাদের সামনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমরা এখন নিউক্লিয়ার ক্লাবের সদস্য। আমরা নিউক্লিয়ার ক্লাবে প্রবেশ করলাম। এটাকে বাংলাদেশের বিরাট অর্জন বলে চিহ্নিত করেন প্রধানমন্ত্রী।
এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প, প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে পাবনার রূপপুরে। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় এক লাখ কোটি টাকার বেশি। দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণ কাজ শুরু হচ্ছে আগামী বছর। রূপপুর প্রকল্পের ‘রেফারেন্স প্রজেক্ট’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে রাশিয়ার নভোভারেনেঝ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে। অভিজ্ঞতা অর্জনের অংশ হিসেবে জুন ও জুলাই মাসে তিন দফায় সরকারের সরকারের কর্তব্যক্তিরা এ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শন করেন।
পদ্মা সেতুর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ প্রকল্প থেকে ফেরাতে আমার পুরো পরিবারকে দুর্নীতিবাজ বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। দেশের দুইজন (ড. ইউনূস ও খালেদা জিয়া) আর আন্তর্জাতিক কিছু শক্তি এ কাজ করেছে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। এ চ্যালেঞ্জ নিয়েছি। আজ পদ্মা সেতু হচ্ছে। না করতে পারলে পিছিয়ে যেতাম। আত্মপরিচয় দুর্বল হয়ে যেত।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টিও সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বলে জোট নেতাদের জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্নভাবে সর্বত্র তারা গেড়ে বসেছিল। তাদের ঐতিহাসিক মিত্র আর অঢেল সম্পদ- এসব কিছু বিচারের পেছনে বড় বাধা ছিল। কিন্তু আমরা জনগণকে দেয়া ওয়াদা রক্ষা করে সে বিচার করেছি। সরকারের বড় অর্জন এটি।
শরিক দলের একাধিক নেতা বলেন, দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের বিভিন্ন অর্জন ও সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রসহ নানা বিষয়ে ঘরোয়াভাবে কথা বলেই যাচ্ছিলেন। এদিকে জন্মাষ্টমি উপলক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নেতারা অপেক্ষা করছিলেন সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য। তখন দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম অনুরোধ করলে প্রধানমন্ত্রী জোট নেতাদের বিদায় দিয়ে পরবর্তী অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ে প্রতিনিধি দলে ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, বিভক্ত জাসদের সাধারণ সম্পাদক মঈনুদ্দিন খান বাদল ও শিরীন আখতার, ন্যাপের এনামুল হক, গণআজাদী লীগের এসকে শিকদার, ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, কমিউনিস্ট কেন্দ্রের অসীত বরণ রায়, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবীর নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অ্যাড. আফজাল হোসেন, কেন্দ্রীয় সদস্য সুজিত রায় নন্দী। - মানবকণ্ঠ
২৪ আগস্ট ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস