নিজস্ব প্রতিবেদক : আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ করার পর এর নেতাকর্মীরাই নতুন একটি সংগঠনের নামে আত্মপ্রকাশ করে। এই সংগঠনের নাম আনসার আল ইসলাম। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে আত্মপ্রকাশ করা এই সংগঠনটি আদর্শগতভাবে আল-কায়েদার অনুসারী। নতুনভাবে গড়ে ওঠা এই আনসার আল ইসলাম সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক ব্লগার হত্যায় জড়িত। এসব অভিযোগে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের মতো আল ইসলামও নিষিদ্ধ হচ্ছে। গতকাল কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম এ কথা জানান।
তিনি বলেন, আনসার আল ইসলামকে নিষিদ্ধ করতে খুব শিগগিরই পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর একটি প্রতিবেদন পাঠানো হবে। বর্তমান আমাদের অভিযানের কারণে সংগঠনটির কার্যক্রম বিপর্যস্ত। সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে তাদের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি দেয়ার প্রক্রিয়াটি সহজ হবে। একইসঙ্গে এই সংগঠনের নেতাকর্মীদের মনোবলও দুর্বল হয়ে পড়বে। এ ছাড়া তাদের নতুন করে সদস্য সংগ্রহ বন্ধ করা সহজ হবে এবং এই সংগঠনের নেতাকর্মীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়কারীরা বিরত থাকবেন।
মনিরুল ইসলাম জানান, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম মূলত একটি ব্লগের আওয়তায় লেখালেখি করতো। ব্লগটা যারা ফলো করতো তারাই এর সঙ্গে ছিল। তখন তাদের সুনির্দিষ্ট কোনো সাংগঠনিক কাঠামো ছিল না। পরে তারা সংগঠন হিসেবে আনসার আল ইসলাম নামে আত্মপ্রকাশ করে। সংগঠন হিসেবেই তারা কার্যক্রম শুরু করে। তাদের সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে। আনরুল্লাহ বাংলা টিম এবং আনসার আল ইসলামের আদর্শ একই বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা। তবে এদের সঙ্গে নব্য জেএমবি’র কার্যক্রমে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কিছু কিছু সদস্য বা সংগঠক নব্য জেএমবিতেও চলে গেছে। সাংগঠনিক কাঠামোতে আনসার আল ইসলামের প্রধান সমন্বয়কের পর তিনটি বিভাগ রয়েছে। একটি হলো ‘দাওয়া’ বিভাগ। যাদের কাজ হলো সংগঠনে নতুন সদস্য সংগ্রহ করা। এরা মেধাবী প্রকৃতির হয়।
এ ছাড়া সংগঠনের নেতাকর্মীদের বাসা ভাড়া করে দেওয়াসহ বিভিন্ন রকম লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে থাকে। অপর বিভাগটি হলো ‘আশকারি’ বিভাগ। এটি হলো ওই সংগঠনের সামরিক বিভাগ। মূলত এই বিভাগের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেন পলাতক সেই জিয়া। এ ছাড়া মিডিয়া ও আইটি নামে আরেকটি বিভাগ রয়েছে। যাদের কাজ হলো নিজেদের মতাদর্শ প্রচার ও পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে নানা রকম অ্যাপসসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে বাঁচার নানারকম কৌশল নিয়ে কাজ করে। আশকারি বিভাগটির অনেকগুলি উপ-বিভাগ রয়েছে। এর মধ্যে ‘হাদী’ নামে একজন গ্রুপ কমান্ডার থাকেন। এর নিচে স্লিপার সেলের দায়িত্বে থাকেন একজন ‘মাসুল’। আর স্লিপার সেলের সদস্য হয়ে যারা সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় তাদের বলা হয় ‘মামুর’।
কোনো টার্গেটের ওপর হামলা চালানোর আগে এই সংগঠনের নেতাকর্মীরা নতুন একটি ‘সেফ হাউসে’ ওঠে। জঙ্গিদের ভাষায় এই বাসাটিকে ‘মারকাজ’ বলা হয়। মাসুলের দায়িত্বে থাকা তরুণরা এই মারকাজ ভাড়া নেয়া থেকে শুরু করে অপারেশনের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে। ঢাকার কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্র জানিয়েছে, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আনসার আল ইসলাম তাদের সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করে। যার প্রধান সমন্বক ঢাকার একটি মাদরাসার সুপারিন্টেনডেন্ট ছিলেন। বছর তিনেক ধরে তিনি আত্মগোপনে থেকে সংগঠনটি পরিচালনা করে আসছেন। এই সংগঠনের সামরিক কমান্ডার হিসেবে কাজ করছে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ মো. জিয়াউল হক। এ ছাড়া এই সংগঠনের আরেক আধ্যাত্মিক নেতা জসিমউদ্দিন রাহমানী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ২৫শে মে পুলিশ সদর দপ্তরের এক সুপারিশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। সে সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক অধিশাখা থেকে জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, ২০১৩ সালে ১৫ই ফেব্রুয়ারি ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যার পর আলোচনায় আসে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। এরপর একাধিক ব্লগার হত্যাকাণ্ডের তদন্তে উঠে আসে এই টিমের নাম। মূলত একটি ব্লগকেন্দ্রিক গোষ্ঠী নিজেদের আনসারুল্লাহ বাংলা টিম হিসেবে দাবি করে আসছিল। তবে তাদের কোনো সাংগঠনিক কাঠামো ছিল না।
উল্লেখ্য, জঙ্গি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আগে আরো ৬টি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মনিরুল ইসলাম বলেন, আমরা মনে করি না বা বিশ্বাসও করি না যে, শুধু নিষিদ্ধ করলেই একটি দলের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এমনটি হয়নি। নিষিদ্ধ করাটা অনেকগুলো পদক্ষেপের একটি পদক্ষেপ মাত্র। যেহেতু সংগঠনটা একটা আইডিলজি বা ড্রগমা বেইজড তাই এটি নির্মূল করতে হলে একটি এটা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি একটি কাজ করতে হয়, সংগঠিতভাবে কাজ করতে হয়। অতীতের থেকে আমরা শিক্ষা নিয়েছি। এটা কাজে লাগিয়ে আশা করি এটা নিয়ন্ত্রণ করতে এবং এক সময় নির্মূল করতে সফল হবো বলে উল্লেখ করেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান। -মানবজমিন
২৫ আগস্ট ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস