জয়শ্রী জামান : যারা একসময় আত্মহত্যার কথা ভেবেছিল, তাদের বেশির ভাগই বেঁচে আছে বলে আজ খুশি৷ তারা বলে থাকে, তারা জীবনটাকে শেষ করে দিতে চায়নি, শুধু যন্ত্রণাটা দূর করতে চেয়েছিল৷ তার মানে, আত্মহত্যা কোনো কষ্ট-যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায় নয়। এটা কোনো নেতিবাচক বিষয়ের সমাধান দেয় না। বরং সমস্যাকে আরও জটিল করে।
এসব আমার কথা নয়। মনোচিকিৎসকদের কাছ থেকেই আমি এসব জানছি। তাদের উদ্বেগ, বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়লেও এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির কাজটি সেভাবে হচ্ছে না। এই মনোবিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কাউন্সেলিং এবং যথাযথ মানসিক চিকিৎসাই আত্মহত্যা প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর পন্থা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, আত্মহত্যার ঘটনার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। ২০১১ সালেও আমাদের অবস্থান ছিল ৩৮তম। আজকের এই লেখার মূল কারণটি এ থেকেই স্পষ্ট। আমাদের জনগোষ্ঠীকে, আমাদের প্রতিটি পরিবারকে আত্মহত্যার বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
সাংবাদিকদের প্রায় সব বিষয় নিয়েই লেখার প্রস্তুতি থাকতে হয়। তবে আজকের এই লেখাটি সাংবাদিক হিসেবে লিখছি না। অথবা মাত্র তিন বছরে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থার অবনতির কারণেও লিখছি না। সত্যি বলতে, নিজের একমাত্র সম্বল দুই ছেলেমেয়ে আত্মহত্যার পরই আমি এই বিশেষ বিষয়ে আগ্রহী হই, পড়ালেখা করতে বাধ্য হই। সেখান থেকে আমি বন্ধু-শুভাকাঙ্খীদের নিয়ে একটা কাজেও হাত দিয়েছি। তা হলো আত্মহত্যা প্রতিরোধের লক্ষেয সচেতনতা তৈরি। এর জন্য ‘ব্রাইটার টুমরো’ নামে একটি সংগঠনও করেছি। যেকোনো পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকতে উৎসাহিত করা এবং জীবনকে ভালোবাসার কথা বলতেই আমরা এ উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা চাই, আর কারও যেন আমার মতো এমন করুণ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে না হয়।
আজ ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। এই দিনটি আমাদের জীবনে বহুবার এসেছে, গেছে। কিন্তু আজ বিশেষ দিন। এই দিনকে ঘিরে এখন আমিও নানা কর্মপরিকল্পনা করি। জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম চলে সারা বিশ্বে।
কেউ কেউ আকস্মিক বা আবেগপ্রবণ হয়ে হুট করে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই ঝোঁকের বশে মৃত্যুর চেষ্টা করে। আবার কেউবা দীর্ঘ সময় ধরে আত্মহত্যার পরিকল্পনা করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা আছে, তাদের ব্যক্তিত্ব ও আচরণে কোনো না কোনোভাবে সেটা প্রকাশ পায়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে আত্মহত্যার কারণও ভিন্ন। পশ্চিমা বিশ্বে পুরুষ, একাকী এবং মধ্য বা বেশি বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। বাংলাদেশ, চীনসহ প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নারী, বিবাহিত ও তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি।
কম বয়সীদের আত্মহত্যার বিষয়ে বলা হয়, বয়ঃসন্ধিকালে আবেগ বেশি থাকে। ওই সময়ে কোনো অপ্রাপ্তিই তারা সহজে মেনে নিতে পারে না। এ মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরেই আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়। তবে সচেতনতা, যথাযথ চিকিৎসা ও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে আত্মহত্যাপ্রবণ চিন্তা থেকে মানুষকে বের করে আনা সম্ভব।
আমেরিকার সুইসাইড অর্গানাইজেশনের নির্বাহী পরিচালক কেভিন ক্যারুজো আত্মহত্যা প্রতিরোধসংক্রান্ত এক বক্তব্যে বলেন, কেউ যদি তীব্র আবেগ অথবা দৈহিক বেদনাক্রান্ত হয়ে থাকে, তবে বুঝতে হবে তার বিচারবুদ্ধি বেদনায় আচ্ছন্ন রয়েছে, সে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করছে। তাহলে বুঝতে হবে সে কেবল বেদনা অবসানের চেষ্টা করছে। তাকে বোঝাতে হবে অনুগ্রহ করে বিভ্রান্ত না হয়ে বেদনার অবসানের সঙ্গে সঙ্গে জীবনটাকেই শেষ করা হবে সবচেয়ে বড় ভুল। কারণ, এ দুটোর মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। তাদের জানিয়ে দিতে হবে, বাস্তবিক যেসব লোক আত্মহত্যা করতে চেয়েছে এবং বেঁচে গেছে, তারা প্রত্যেকে আনন্দিত যে তারা বেঁচে আছে। তাই তাদের আত্মহত্যার মনোভাব জাগানিয়া ‘আবেগ’ তাড়ানোর চেষ্টা নিতে হবে।
আমাদের দেশে যৌতুক, পারিবারিক কলহ, নির্যাতন, দাম্পত্য সম্পর্কের জটিলতা, উত্ত্যক্ততা, লোকলজ্জার ভয়, জটিল শারীরিক রোগযন্ত্রণা, নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক বিচ্যুতিসহ নানা কারণে অনেকে আত্মহত্যা করে থাকে। কিন্তু এই সব কটি বিষয়েরই প্রতিকার আছে। উন্নয়নশীল ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে আত্মহত্যার প্রবণতা ও সংখ্যা বাড়ছে।
মানসিক রোগের চিকিৎসায় সরকারি উদ্যোগ জরুরি। কিন্তু দেশে মানসিক রোগের চিকিৎসকের সংখ্যা এখন মাত্র ২০০। জেলা পর্যায়ে মানসিক রোগের চিকিৎসা নেই। শুধু ২২টি মেডিকেল কলেজ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও পাবনার হাসপাতালে মানসিক রোগের চিকিৎসা করা হয়। পুরোনো আটটি মেডিকেল কলেজের একটিতেও এ বিষয়ে অধ্যাপক নেই।
বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে আত্মহত্যা প্রতিরোধ সম্ভব। এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। ‘গণস্বাস্থ্য–সংকট’-বিষয়ক তথ্য তুলে ধরতে হবে। কেউ যদি আত্মহত্যার দিকে এগোয়, তাকে সুস্থ করে তোলার লক্ষ্যে সার্বক্ষণিক সহায়তা দিতে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে।
সন্তান আত্মহত্যার কথা বললেই সতর্ক হতে হবে। কেবল মঙ্গল চাইলেই হবে না, তাকে বুঝতে হবে। সমাজ ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জনসচেতনতামূলক শিক্ষা প্রদান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আত্মহত্যার ভয়াবহতা ও প্রতিরোধের নানা দিক নিয়ে সভা-সেমিনার করা প্রয়োজন। আবেগ নিয়ন্ত্রণে স্কুল, কলেজ কিংবা সামাজিক প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা দরকার। তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে, জীবনের চেয়ে কোনো কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিছুই না।-প্রথমআলো
জয়শ্রী জামান: আহ্বায়ক, ব্রাইটার টুমরো সাংবাদিক।
১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে