শনিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৬, ০৩:২৮:২১

বিএনপি : ফিনিক্স পাখি না উট পাখি

বিএনপি : ফিনিক্স পাখি না উট পাখি

মহিউদ্দিন খান মোহন : ফিনিক্স পাখি বলতে পৃথিবীতে কোনো পাখি আদৌ ছিল কিনা সেটা নিশ্চিত করে হয়তো কেউ-ই বলতে পারবেন না। তারপরও মানুষ প্রসঙ্গক্রমে ফিনিক্স পাখির উদাহরণ দিয়ে থাকে। গ্রিক পুরাণ বা উপকথায় ফিনিক্স পাখির উল্লেখ আছে।

সেখানে বলা হয়েছে— এটি এমন একটি পাখি যা তার পূর্বসূরির ভস্ম বা ছাই থেকে নব জন্মলাভ করে।  এ জন্যই কখনো কোনো কিছু ধ্বংসের মুখোমুখি হলে আশান্বিতরা জোর গলায় বলে থাকেন— ‘এটি ফিনিক্স পাখির মতো ধ্বংসস্তূপ থেকে আবার উত্থিত হবে।’

না, ফিনিক্স পাখি নিয়ে গবেষণায় প্রবৃত্ত হওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। বিষয়টি এখানে উল্লখ করা হলো এ জন্য যে, দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিলের প্রাক্কালে দলটির মহাসচিব সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন— ‘এ সম্মেলনের মধ্যদিয়ে বিএনপি ফিনিক্স পাখির ন্যায় আবার উঠে দাঁড়াবে।’

কেউ কেউ তখনই প্রশ্ন তুলেছিলেন, ফিনিক্স পাখি ধ্বংসস্তূপ থেকে পুনর্জন্ম লাভ করে। তাহলে কি বিএনপি ধ্বংস হয়ে গেছে যে, ফিনিক্স পাখির মতো তার পুনরুত্থান বা পুনর্জন্ম হবে? বর্তমান সময়ে বিএনপি যে, সবচেয়ে দুর্বল এবং অগোছালো অবস্থায় আছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাংগঠনিক শক্তির দিক দিয়ে অত্যন্ত দুর্বল বিধায় শাসকগোষ্ঠী একে মাথা তুলে দাঁড়াতেই দিচ্ছে না। তাই বলে ফিনিক্স পাখির মতো ধ্বংসস্তূপ থেকে পুনরায় জন্মলাভের পর্যায়ে বিএনপি এখনো যায়নি বোধ হয়।

যা হোক, অনেকেই আশা করেছিলেন যে, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বিএনপি এবার তার কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি সতর্কতার সঙ্গেই গঠন করবে। যারা চান বিএনপি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে পুনরায় দেশের রাজনীতির মাঠে ফিরে আসুক, তারা ভেবেছিলেন জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে দলটি আগের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি করবে না। কিন্তু গত ৬ আগস্ট মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৫০২ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি, ১৭ সদস্যের স্থায়ী কমিটি এবং ৭৩ সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি ঘোষণার পর সবার ভুল ভেঙে গেছে।

দেখা গেল ৫৯২ সদস্যের যে কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে ব্যাপক ভুলত্রুটি রয়ে গেছে। আগে বিএনপি নেতারা বলেছিলেন, বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে যারা মাঠে ছিলেন, দলের জন্য যার যার অবস্থান থেকে অবদান রেখেছেন তারাই জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে ঠাঁই পাবেন। দলটির পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছিল যে, বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে যারা নিষ্ক্রিয় ছিল, অর্পিত দায়িত্ব পালন করেনি তাদের বাদ দেওয়া হবে।

ফলে বিএনপির নেতা-কর্মী ও শুভানুধ্যায়ীরা আশা করেছিলেন যে, এবার হয়তো ত্যাগী, দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ নেতাদের স্থান হবে জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে। কিন্তু কমিটি ঘোষণার পর নেতা-কর্মীদের প্রতিক্রিয়া এবং গণমাধ্যমের সংবাদ-রিপোর্ট সে ধারণাকে পাল্টে দিয়েছে। বিএনপির পাঁচটি কাউন্সিলে অতীতে যা ঘটেনি, এবার তাই ঘটেছে। অতীতের বিভিন্ন কাউন্সিলে, বিশেষ করে পঞ্চম কাউন্সিলের পর গঠিত কমিটি নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ-হতাশা দেখা দিলেও তা প্রকাশ্য রূপ নেয়নি। এবার তা শুধু প্রকাশ্য রূপই নেয়নি, কয়েকজন নেতার পদত্যাগের ঘটনাও ঘটেছে।

গত ৬ আগস্ট যে কমিটি বিএনপি মহাসচিব ঘোষণা করেছেন তা নিয়ে নানা বিতর্ক দেখা দিয়েছে। তন্মধ্যে এ কমিটি বিএনপির গঠনতন্ত্র মোতাবেক হয়েছে কিনা সে প্রশ্ন বেশ জোরেশোরেই উঠেছে। পঞ্চম কাউন্সিলে দলের সংশোধিত গঠনতন্ত্রে জাতীয় নির্বাহী কমিটির মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৮৬। এবার তা হয়েছে ৫০২। প্রশ্ন উঠেছে বিএনপির গঠনতন্ত্রে জাতীয় নির্বাহী কমিটির আকার সংশোধন করা হয়েছে কিনা। বলাই বাহুল্য, ষষ্ঠ কাউন্সিল থেকে গঠনতন্ত্রে বেশ কিছু পরিবর্তন/সংশোধনের কথা বলা হলেও জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি সংক্রান্ত কোনো ঘোষণা এ পর্যন্ত শোনা যায়নি। সুতরাং যদি বলা হয় এবারের জাতীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণার দ্বারা বিএনপির গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করা হয়েছে তাহলে কি তা অযৌক্তিক হবে?

আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। সাধারণ এ ধরনের কমিটি ঘোষণার পর দলের বিভিন্ন স্তর থেকে অভিনন্দন শুভেচ্ছা জানানোর হিড়িক পড়ে যায়। কিন্তু এবার বিচ্ছিন্নভাবে কোথাও কোথাও ব্যক্তিবিশেষের পদ লাভজনিত আনন্দ মিছিল ছাড়া গোটা কমিটিকে স্বাগত জানিয়ে সে ধরনের কোনো মিছিল-শোভাযাত্রা দেখা যায়নি কিংবা গণমাধ্যমে বিবৃতি আসেনি। এত বড় একটি পর্বত সাইজ কমিটিও কেন নেতা-কর্মীদের মনে আনন্দের জোয়ার সৃষ্টি করতে পারল না সেটা অবশ্যই ভেবে দেখা দরকার। উল্টা কমিটি ঘোষণার পরদিন থেকে নেতা-কর্মীদের অসন্তোষ, কমিটি ‘নির্মাতাদের’ দোষারোপ করে বিষোদগার এবং পদত্যাগ ও দল ছাড়ার হুমকিই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।

কমিটি ঘোষণার পর পত্র-পত্রিকায় এ সংক্রান্ত যেসব খবরাখবর বেরিয়েছে, তার দিকে একটু দৃকপাত করলেই দলটির অভ্যন্তরের অগোছালো অবস্থার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। কমিটি ঘোষণার পরদিন প্রায় প্রতিটি দৈনিক নেতিবাচক শিরোনাম দিয়ে খবরটি প্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন শিরোনাম ছিল— ‘মিশ্র প্রতিক্রিয়ার কমিটি’, কালের কণ্ঠের শিরোনাম ছিল— ‘বহু প্রতীক্ষিত কমিটি বয়ে আনল ক্ষোভ হতাশা’, আমাদের সময়ের শিরোনাম ছিল— ‘পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে বিএনপিতে ক্ষোভ’, যুগান্তরের শিরোনাম ছিল— ‘গুরুত্বপূর্ণ পদে নেই অনেক ত্যাগী ও সক্রিয় নেতা।’ উদাহরণ আর লম্বা করতে চাই না। কেউ কেউ বলতে পারেন— সংবাদপত্রগুলো নেতিবাচক শিরোনাম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে করেছে। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে যে, ঘোষিত কমিটি নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের প্রতিক্রিয়ার কারণেই যে সংবাদপত্রগুলো ওই ধরনের শিরোনাম করেছে, সংবাদগুলো পাঠ করলেই তা সম্যক উপলব্ধি করা সম্ভব।

কাউন্সিলের দীর্ঘ সাড়ে চার মাস পর বিএনপি যে কমিটি ঘোষণা করেছে, তা নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করা তো দূরের কথা আরও বেশি হতাশ ও মনমরা করে তুলেছে। কমিটি গঠনের পরদিন দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পরিবেশ নিয়ে কয়েকটি দৈনিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওইসব খবরে বলা হয়েছে, নতুন কমিটি ঘোষণার পর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যে ধরনের উৎসবমুখর পরিবেশ থাকার কথা সেদিন তা ছিল একেবারেই অনুপস্থিত।

বাংলাদেশ প্রতিদিন ‘নয়াপল্টন কার্যালয় ছিল নেতাশূন্য, নিস্তব্ধ’ শীর্ষক রিপোর্টে লিখেছে— ‘ঢাউস আকৃতির কমিটি ঘোষণার পরও কোনো আনন্দমুখর পরিবেশ ছিল না কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। নতুন কমিটিতে যারা পদ পেয়েছেন তারাও গতকাল নয়াপল্টনে যাননি। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রায় জনশূন্য ছিল কার্যালয়টি (৮, আগস্ট-২০১৬)।’ একই রকম রিপোর্ট করেছে আমাদের সময় ‘নেতা-কর্মীশূন্য বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়’ শিরোনামে।

এদিকে কমিটি ঘোষণার প্রায় দুই সপ্তাহ অতিক্রান্ত হতে চললেও তা নিয়ে বিতর্ক থামেনি। পদবঞ্চিত এবং প্রত্যাশিত পদ না পাওয়া নেতারা তাদের ক্ষোভ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ করে চলেছেন। তাদের ক্ষোভ অসন্তোষের কথা সংবাদ মাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে। কমিটি ঘোষণার পরপরই পদত্যাগ করেছেন ভাইস চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক আলী ফালু, সহ-প্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম। এরপর পদত্যাগ করেছেন সাবেক সংসদ সদস্য বিএনপির অন্যতম ডোনার হিসেবে পরিচিত কাজী সলিমুল হক কামাল। ভাইস চেয়ারম্যান পদে থেকে রাজনীতি করতে অনাগ্রহের কথা জানিয়েছেন প্রবীণ রাজনীতিক আবদুল্লাহ আল নোমান।

তিনি এবার জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হতে আগ্রহী ছিলেন, নেতা-কর্মীদের প্রত্যাশাও ছিল সে রকমই। এ ছাড়া অনেক নেতা দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে সরে দাঁড়ানোর, কেউ কেউ দলের সঙ্গে সব ধরনের ‘সাংগঠনিক সম্পর্ক’ ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে দীর্ঘ সোয়া ছয় বছর পর অনুষ্ঠিত কাউন্সিল এবং তারও সাড়ে চার মাস পর ঘোষিত নতুন কমিটি দলের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টির পরিবর্তে এক ধরনের স্থবিরতাই এনে দিয়েছে। নেতা-কর্মীরা কমিটি গঠন নিয়ে নানা অভিযোগ করেছেন সংবাদ মাধ্যমে। সঙ্গত কারণেই তারা নাম প্রকাশ করতে চাননি। তবে, তারা কমিটি গঠন নিয়ে যেসব অভিযোগ করেছেন সেসবের যথার্থতা নিয়ে সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ কম।

নেতা-কর্মীদের অসন্তোষ-অভিযোগ প্রতিভাত হতে উঠেছে নতুন কমিটি নিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে। ৮ আগস্ট বাংলাদেশ প্রতিদিন ‘বিএনপির কমিটি নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে লিখেছে— ‘স্থায়ী কমিটি থেকে শুরু করে নির্বাহী কমিটির সদস্য পর্যন্ত অনেক নেতাই মর্যাদাহীনতায় ভুগছেন। দক্ষ হাতে কমিটি হয়নি বলেও মন্তব্য করেন কেউ কেউ। কাঁচা হাতে কমিটি হওয়ায় শ্রেণি বিন্যাসে অসংখ্য ত্রুটি পাওয়া গেছে।’ ৭ আগস্ট ‘কালের কণ্ঠ’ ঘোষিত কমিটিকে ‘রিজভী-শিমুল’ কমিটি আখ্যা দিয়ে লিখেছে— ঘোষিত কমিটি নিয়ে বেশির ভাগ নেতা-কর্মী অভিযোগের আঙ্গুল তুলছে খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদের দিকে।

কারণ সাম্প্রতিককালে এ দুজনই খালেদা জিয়ার কাছাকাছি ছিলেন। অন্য কোনো নেতা, এমনকি বিএনপির মহাসচিবও কমিটি গঠনের কাজে অংশ নিতে পারেননি।’ পত্রিকাটি লিখেছে— ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বাসায় সার্বক্ষণিক বসবাসকারী তার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস ও বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদের পছন্দের লোকজনই ঘোষিত কমিটিতে প্রাধান্য পেয়েছে।’

এদিকে ৯ আগস্টের বেশ কয়েকটি দৈনিক কমিটি ঘোষণা পরবর্তী বিএনপির অভ্যন্তরীণ অবস্থা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ প্রতিদিন ‘বিএনপির কমিটি নিয়ে ক্ষুব্ধ তারেক রহমান’ শীর্ষক প্রতিবেদনে লিখেছে— ‘ঘোষিত কমিটিতে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মতামত গুরুত্ব পায়নি। এতে তিনি চরম ক্ষুব্ধ। এ নিয়ে তারেক রহমান মা খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাও বলেছেন।’ একই দিনের দৈনিক যুগান্তর ‘টালমাটাল অবস্থা বিএনপির’ শীর্ষক প্রতিবেদনে লিখেছে— ‘গেল মার্চে বিএনপির কাউন্সিল অধিবেশন শুরুর প্রাক্কালে বিএনপির তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব (বর্তমানে মহাসচিব) মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘কাউন্সিলের পর বিএনপি ফিনিক্স পাখির মতো ঘুড়ে দাঁড়াবে’।

কিন্তু মহাসচিবের বিপুল প্রত্যাশা তৈরির সে বক্তব্য এখন অনেকটা স্বপ্নবিলাসে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল অনেকটা তেমনি মনে করেন। একই পত্রিকা ৮ আগস্ট— ‘নেতারা কি পথে নামবেন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিকের অভিমত তুলে ধরেছে। তারা বিএনপির নতুন কমিটি নিয়ে আশাবাদী হতে পারেননি বলে মন্তব্য করেছেন। এ কমিটি আগামী দিনে আন্দোলন কিংবা নির্বাচনে জয়ের ফসল দলটির ঘরে তুলতে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে কিনা তা নিয়ে তারা সংশয় প্রকাশ করেছেন।

অপরদিকে ১২ আগস্টের কয়েকটি দৈনিক এ মর্মে সংবাদ প্রকাশ করেছে যে, কমিটিতে ঠাঁই না পাওয়া ১/১১ এর সংস্কারপন্থিরা বিকল্প কিছু করার চিন্তাভাবনা করছে। খবরে বলা হয়েছে— দলকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে উল্লিখিত সংস্কারপন্থিদের অন্তর্ভুক্ত করার আশ্বাস দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের স্থান হয়নি। প্রায় অর্ধশত সাবেক সংসদ সদস্যসহ শতাধিক নেতা এ বিষয়ে চেয়ারপারসনকে চিঠি দেবেন। চেয়ারপারসনের ইতিবাচক সাড়া না পেলে তারা বিকল্প চিন্তাভাবনা করবেন বলে পত্রিকাগুলো উল্লেখ করেছে।

এমনি সময়ে অনেকটাই খোলামেলা কথা বলছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ১/১১ এর দুঃসময়ে বেগম জিয়ার পক্ষে সাহসী ভূমিকা পালনকারী নেতা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আ স ম হান্নান শাহ (অব.)। ১৩ আগস্ট ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘বিগত দিনে যারা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে গালাগাল করেছে, বিএনপি ভাঙার ষড়যন্ত্র করেছে, মান্নান ভূঁইয়ার আশপাশে ঘুর ঘুর করেছে, তারাই নতুন কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন।’

ঘোষিত কমিটি সম্পর্কে নেতা-কর্মীদের আরেকটি গুরুতর অভিযোগ হলো— শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পুত্রবধূ, মেয়ের জামাতার জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে স্থান লাভ। তাদের কেউ সম্পাদক, সহ-সম্পাদক আবার কেউ সদস্য পদ পেয়েছেন। দুয়েকজনের স্বল্প রাজনৈতিক পরিচিতি থাকলেও বাকিদের পিতা, শ্বশুর, স্বামীর পরিচয় ছাড়া আর কোনো যোগ্যতাই নেই। এ প্রসঙ্গে ক্ষুব্ধ একজন সাবেক ছাত্রনেতা বললেন যে, সম্ভব হলে তিনি পিতার পরিচয় বদল করতে চান।

স্থায়ী কমিটি বা শীর্ষ পর্যায়ের কোনো এক নেতাকে এফিডেভিটের মাধ্যমে পিতা হিসেবে গ্রহণ করে ওই পিতার পরিচয়ে হলেও যদি দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে একটি পদ পাওয়া যায়! অভিযোগ আরও আছে। ষষ্ঠ কাউন্সিলে দলটির গঠনতন্ত্রে যেসব সংশোধনী পাস হয়েছিল, তন্মধ্যে ‘এক নেতা এক পদ’ বিধান অন্যতম। বলা হয়েছিল— এক নেতা একাধিক পদে থাকতে পারবেন না। সে মতে মহাসচিব নির্বাচিত হওয়ার পর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপি এবং জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ছেড়ে দেন যুবদলের সভাপতি ও দলের যুববিষয়ক সম্পাদকের পদ। কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ দফতর সম্পাদকের পদটি নিজ দখলে রেখেছেন। নেতা-কর্মীরা প্রশ্ন তুলেছেন— বিএনপিতে কি রিজভী আহমেদ ছাড়া দফতর চালানোর যোগ্য আর কেউ নেই? কেন গঠনতান্ত্রিক বিধান লঙ্ঘন করে রিজভী আহমেদ দুই পদ দখলে রাখলেন? এখন তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে কোনো জেলা বা উপজেলার কোনো নেতা যদি একাধিক পদ দখলে রাখে তাহলে রিজভী আহমেদ তাকে ‘শোকজ’ বা তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন কোন নৈতিকতার জোরে?

লক্ষণীয় বিষয় হলো— কমিটি গঠন-পরবর্তী সময়ে বিএনপি অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতা প্রকটভাবেই প্রকাশ হয়ে পড়েছে। ৮ আগস্ট মহাসচিব মির্জা আলমগীর গণমাধ্যম কর্মীদের সামনে বললেন যে, যদি কেউ মনে করেন তিনি বঞ্চিত হয়েছেন, তাহলে তার উচিত হবে পরবর্তী কাউন্সিল পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা। অথচ ওইদিন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন— ঘোষিত কমিটিতে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে চেয়ারপারসন তা সংশোধন করবেন। তাছাড়া সংবাদ মাধ্যমে এ খবরও এসেছে যে, ঘোষিত কমিটি দেখে চেয়ারপারসন ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং এ জন্য তার একজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও একজন নেতাকে তিরস্কার করেছেন।

তিনি ওই কর্মকর্তাদের ‘বঞ্চিত’ যোগ্য নেতাদের একটি তালিকা করারও নাকি নির্দেশ দিয়েছেন। এ থেকে বোঝা যায় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্বন্ধেই জ্ঞাত নন। কমিটি গঠনে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা যে ছিল না সেটা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। এখন কমিটির ভুল-ত্রুটি সংশোধনের যে চিন্তাভাবনা চলছে সে সম্পর্কেও তিনি কিছু জানেন না। জানলে বঞ্চিতদের পরবর্তী কাউন্সিল পর্যন্ত (কবে হবে কেউ জানে না) অপেক্ষা করতে বলতেন না। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা নিয়ে এ পর্যন্ত যেসব খবরাখবর গণমাধ্যমে এসেছে তাতে এটা স্পষ্ট যে, দলটি শক্তিশালী হয়ে মাঠে দাঁড়ানোর পরিবর্তে আরও স্থবির হয়ে পড়তে পারে।

নেতা-কর্মীদের যে ধরনের উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে গত ১৯ মার্চ দলটির ষষ্ঠ কাউন্সিল হয়েছিল, নবগঠিত জাতীয় নির্বাহী কমিটি তাদের ততটাই হতাশ করছে। তারা একরকম প্রকাশ্যেই বলছেন যে, ঘোষিত কমিটি বিএনপিকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে আরও দুর্বল করবে। কারণ বিগত আন্দোলনে যারা নিষ্ক্রিয় ছিল, দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, নানা যোগাযোগ ও লেনদেনের মাধ্যমে তারাই কমিটিতে স্থান পেয়েছে। ফলে এরা আগামী দিনে আন্দোলন-সংগ্রামে কোনো ভূমিকা পালন করবে— এমনটি বিশ্বাস করতে পারছেন না কেউ-ই।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল বিস্মিত এ জন্য যে, বিএনপির মতো একটি অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দল বা এর শীর্ষ নেতৃত্ব এখনো পর্যন্ত বাস্তব পরিস্থিতি উপলব্ধি এবং তেপ্রক্ষিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। যে মুহূর্তে বিএনপির জন্য প্রয়োজন ছিল দক্ষ, যোগ্য এবং অভিজ্ঞ নেতাদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় নির্বাহী কমিটি, সে সময়ে তরুণদের সামনে আনার নামে গঠিত হলো এমন একটি কমিটি যা নিয়ে শুরুতেই বিতর্ক, সন্দেহ ও সংশয় দেখা দিয়েছে। ২০০৯ এর কাউন্সিলের পর যে কমিটি গঠিত হয়েছিল সেটা নিয়েও বিতর্ক হয়েছিল, অভিযোগ উঠেছিল।

অনেকেরই ধারণা ছিল, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠনে চেয়ারপারসন অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল— এবারও তিনি যাদের ওপর ভরসা করলেন, যাদের বিশ্বাস করে দায়িত্ব দিলেন, তারা তারই নাম ভাঙিয়ে নিজেরা ফায়দা লুটল, আর দলকে সর্বনাশের পথে আরেক সিঁড়ি নিচের দিকে ঠেলে দিল। এ কথা নিশ্চয়ই রাজনীতিসচেতন কেউ বলবেন না যে, বিএনপির নতুন কমিটি কোনো আশার আলো দেখাতে পারছে।

বরং সামনের দিনগুলোতে দলটি আরও অন্ধকারময় পথে ধাবিত হওয়ারই আশঙ্কা বেশি। ‘কাউন্সিলের পর বিএনপি ফিনিক্স পাখির মতো উঠে দাঁড়বে’— মহাসচিবের এ আত্মপ্রসাদীয় মন্তব্য এখন সবার কাছেই বাস্তবতাবিবর্জিত বলে মনে হচ্ছে।   বরং রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, ফিনিক্স পাখি নয় বিএনপি এখন মরুভূমির উট পাখিতে পরিণত হয়েছে, যে পাখি উড়তে জানে না, আর মরুঝড়ের কবল থেকে রক্ষা পেতে বালুতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

২৭ আগস্ট ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস‌‌‌‌

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে