শুক্রবার, ০২ অক্টোবর, ২০১৫, ০৩:০১:৪৪

নজিরবিহীন অব্যবস্থা দুর্ভোগে হাজিরা

নজিরবিহীন অব্যবস্থা দুর্ভোগে হাজিরা

আলতাব হোসেন ও শহিদুল আলম : নজিরবিহীন অব্যবস্থাপনা আর বিড়ম্বনার শিকার হয়েই ফিরছেন হাজিরা। জেদ্দার বিমানবন্দর থেকে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর পর্যন্ত দুর্ভোগের শেষ নেই হাজিদের। সৌদি আরব যেতে যত ভোগান্তি হয়েছে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি হচ্ছে ফিরতে। ১৫ থেকে ২৭ ঘণ্টা বিলম্বিত ফ্লাইটে দেশে ফিরলেও হাজিদের অনেকের লাগেজ আসছে না। পবিত্র ভূমির খেজুর ও জমজমের পানির লাগেজ কবে আসবে, সে ব্যাপারেও স্পষ্ট কোনো জবাব নেই বিমান কর্তৃপক্ষের। ফ্লাইট বিলম্বের যে অজুহাত দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ, তা আদৌ ঠিক নয় বলে জানা গেছে। সবকিছু লেজেগোবরে অবস্থা হয়ে গেছে বলে হাজিদের অভিযোগ।

ভুক্তভোগী হাজিরা জানান, সৌদিতে মিনা ট্র্যাজেডির দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে ফিরতে পারলেও দেশে বিমানবন্দর থেকে লাগেজ পেতে ব্যাপক ভোগান্তি ও বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন তারা। বিমানের হাজি পরিবহনের ইতিহাসে এমন হ-য-ব-র-ল অবস্থা এর আগে হয়নি বলেও মন্তব্য করেন কেউ কেউ।

ফ্লাইট বিলম্বের কারণে জেদ্দা বিমানবন্দরে দীর্ঘ অপেক্ষা করতে করতে বয়স্ক ও নারী হাজিরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। খাবার, টয়লেট ব্যবহারসহ কেনাকাটায় বিড়ম্বনার মুখোমুখি হচ্ছেন। সেখানে তারা বিমান কর্তৃপক্ষের কোনো কর্মীর সহযোগিতা পর্যন্ত পাচ্ছেন না। যারা অশেষ বিড়ম্বনা ভোগ করে দেশে ফিরছেন, তারা অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী লোকদের শাস্তি দাবি করেছেন।

ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পাতবার সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজার হাজি দেশে ফেরার কথা থাকলেও ফ্লাইট বিলম্বের কারণে অর্ধেক হাজিও দেশে ফিরতে পারেননি। এমনকি একটি গ্রুপের ৩০ জন হাজি একসঙ্গে গেলেও ফিরেছেন মাত্র ১০ জন। বাকিরা কবে ফিরবেন, তারও কোনো সদুত্তর নেই কর্তৃপক্ষের কাছে। এ বছর সৌদি আরবে হজ করতে গেছেন এক লাখ সাত হাজার ২৯০ জন বাংলাদেশি। বিমানের সিডিউল বিপর্যয়ের ফলে তাদের সবার দেশে ফিরতে কত দিন লাগবে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করে কোনো তথ্য জানাতে পারছে না বিমান কর্তৃপক্ষ।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, গড়ে প্রায় ১৫ থেকে ২৪ ঘণ্টা বিলম্বে হাজিদের নিয়ে আসা বিভিন্ন ফ্লাইট বিমানবন্দরে অবতরণ করছে। জেদ্দা বিমানবন্দরে বিমানের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে অনেক হাজি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অবর্ণনীয় ঝক্কি-ঝামেলা পোহানোর পর দেশের মাটিতে বিমান থেকে নামলেও দুর্ভোগ পিছু ছাড়ছে না হাজিদের। বিমানবন্দর থেকে শত শত হাজিকে লাগেজ ছাড়াই শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। প্রিয়জনদের জন্য লাগেজে পবিত্র ভূমি থেকে নিয়ে আসা খেজুর, জমজমের পানি ও অন্যান্য উপহারসামগ্রী কবে হাতে পাবেন, তা-ও নিশ্চিত করছে না বিমান কর্তৃপক্ষ। এসব লাগেজ আদৌ হাতে পৌঁছাবে কি-না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন হাজিরা। এ ধরনের বিপর্যয় অতীতে কখনও ঘটেনি।

সৌদি আরবের জেদ্দা বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশে ফিরতি হজ ফ্লাইট ছাড়ার কথা ছিল বুধবার রাত সাড়ে ৩টায়। এ জন্য সৌদি স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৮টায় জেদ্দা বিমানবন্দরে পৌঁছেন মুন্সীগঞ্জের হাফিজুর রহমান। অচেনা-অজানা জায়গার কারণে আগেভাগেই বিমানবন্দরে আসেন হাফিজুর রহমান ও তার সঙ্গী ১১ জন। ফ্লাইট ছাড়ার সাত ঘণ্টা আগে এলেও তার ফ্লাইট নির্ধারিত সময়ের আরও সাড়ে ১৪ ঘণ্টা পরে ছাড়ে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় তারা শুয়ে-বসে সময়টা পার করেন। বৃহস্পাতবার বিকেলে তিনি ঢাকায় পৌঁছান। তবে এ ফ্লাইটে হাজিদের লাগেজ আসেনি। বিমানবন্দরে আরও ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষায় থেকে শূন্য হাতে বাড়ি ফেরেন হাফিজুর রহমান।

বিমানবন্দরের কনভেয়ার বেল্ট এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে লাগেজ না পেয়ে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরছেন হাজিরা। হজ ও বিমান কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনায় চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তারা।

ভুক্তভোগী হাজিরা জানান, বিমানবন্দর থেকে এসব লাগেজ কখন, কীভাবে পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে বিমান কর্তৃপক্ষ তাদের সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিচ্ছে না। কয়েকজন হাজিকে বলা হয়েছে, জেদ্দা বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশি হাজিদের লাগেজ অন্য কোনো দেশের বিমানে চলে গেছে। এসব লাগেজ ফেরত না পাওয়ার আশঙ্কাই বেশি। লাগেজ পাওয়া গেলেও তা মাসখানেক লাগবে বলে জানানো হচ্ছে।

হাজি একলাসুর রহমান (৭০)। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার সুন্দরবন ইউনিয়নের জয়ন্তীপুর গ্রামে তার বাড়ি। হজ পালন শেষে বুধবার রাত সোয়া ৯টার দিকে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি হজ ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। তার সঙ্গে ভাই, ভাতিজা, পাড়া-প্রতিবেশীসহ আরও ২১ জন হাজি রয়েছেন। দেশে ফেরার খবর পেয়ে তার আত্মীয়স্বজন বিমানবন্দরে এসেছেন। হাজি একলাসুর রহমান জানান, রাতে বিমান থেকে নামার পর লাগেজ না পেয়ে বিমানবন্দরের মেঝেতে শুয়ে শুয়ে সময় কাটাচ্ছেন তারা। বৃহস্পাতবার দুপুর পর্যন্ত তাদের ওই লাগেজ মেলেনি। বিমানবন্দরে হাজি একলাসুর রহমানের মতো শত শত হাজি লাগেজ পেতে মহাভোগান্তিতে পড়েছেন।

পটুয়াখালীর নজরুল বলেন, 'দুর্ভোগের কথা কী বলব। আমাদের আজকের ফ্লাইট ছাড়ার কথা ছিল বৃহস্পাতবার সকাল ৮টা ২০ মিনিটে। সেখানে ফ্লাইট ছেড়েছে রাত ২টায়। দুর্ঘটনার স্মৃতি নিয়ে হাজিরা ফিরছেন, তবে দুর্ভোগ পিছু ছাড়ছে না।' চাঁপাইনবাবগঞ্জের লতিফা বলেন, 'বৃহস্পাতবার ভোর থেকে আমরা জেদ্দা বিমানবন্দরে ছিলাম। ওখানে খুব গরম, এর মধ্যে এয়ারপোর্টের সামনের রাস্তায় আমাদের বসে থাকতে হয়েছে। একে তো গরম, তারপর পানি নেই, বিশ্রামের জায়গা নেই। কখন প্লেন আসবে তাও জানি না।' নোয়াখালীর বজলুর রশিদ বিডিনিউজকে বলেন, 'আমরা তো কোনোভাবে কাটিয়ে দিয়েছি। সমস্যা হয়েছে মহিলাদের।

রাস্তায় বসে থাকতে হয়েছে। অন্যান্য দেশের হাজিরা টার্মিনালে ঠিকই বিশ্রামের জায়গা পেয়েছেন। আমরাই পাইনি।' ফ্লাইট দেরির কারণ ব্যাখ্যা করে বুধবার বিমান একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। লাগেজ না পাওয়ার বিষয়ে বিমানের জনসংযোগ কর্মকর্তা তাসনিম আক্তার বিডিনিউজকে বলেন, আসলে মূল সমস্যা হচ্ছে জেদ্দা টার্মিনালে। এমনিতে প্রতি বছর জেদ্দা কর্তৃপক্ষ আমাদের যাত্রীদের চেকিংয়ে বেশি সময় নেয়। এ বছর ক্রেন দুর্ঘটনা ও মিনা ট্র্যাজেডির পর চেকিংয়ের মাত্রা আরও বাড়ানো হয়েছে। লাগেজ লোডও হচ্ছে দেরিতে।' বিষয়টি নিয়ে জেদ্দা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি আশ্বস্ত করেছেন, পরের ফ্লাইটে লাগেজ চলে আসবে।

বৃহস্পাতবার শাহজালাল বিমানবন্দরে হাজিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পবিত্র হজ পালন শেষে বাংলাদেশ বিমান ও সৌদি এয়ারলাইন্সে তারা দেশে ফিরেছেন। সৌদি এয়ারলাইন্সে ফেরত আসা হাজিদের লাগেজ পেতে তেমন একটা সমস্যা না হলেও বাংলাদেশ বিমানে আসা লাগেজ পেতে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। ভুক্তভোগীদের মধ্যে দিনাজপুরের বিরামপুর এলাকার হাজি মোজাম্মেল হক ও তার স্ত্রী সাবেরা বেগম জানান, বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে বিমানবন্দরে অবতরণ করেন তারা। কিন্তু তাদের লাগেজ বিমানবন্দরে পৌঁছায়নি।

এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, জেদ্দা বিমানবন্দরে কড়াকড়ির কারণে ফ্লাইট সিডিউল ঠিক রাখা সম্ভব হচ্ছে না। হাজিদের দুর্ভোগে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, দীর্ঘ সময় বিলম্বে পৌঁছেও তারা লাগেজ পাচ্ছেন না, এটা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক। তিনি বলেন, এসব সমস্যা সমাধানের জন্য বিমানের একজন ডিজিএমকে সৌদি আরবে পাঠানো হয়েছে। লাগেজ সমস্যা দ্রুত সমাধানে বৃহস্পতিবার একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটিও কাজ শুরু করেছে।

জানা গেছে, হাজিদের লাগেজ সমস্যা সমাধানে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় গত বুধবার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবকে (বিমান ও সিএ) সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পরও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি চোখে পড়ছে না।

এ ব্যাপারে বিমানের পরিচালক (গ্রাহকসেবা) ক্যাপ্টেন মোসাদ্দেক হোসেনও দু-একদিনের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। তিনি আরও বলেন, জেদ্দা বিমানবন্দরে কড়াকড়ি ও তল্লাশির কারণে বিমানে লাগেজ লোড করতে সমস্যা হচ্ছে।

বিমানবন্দর হজ কন্ট্রোল রুম সূত্র জানায়, বৃহস্পাতবার পর্যন্ত বিভিন্ন ফ্লাইটে প্রায় ১২ হাজার হাজি দেশে ফিরেছেন। এর মধ্যে বিমানের আটটি এবং সৌদি এয়ারলাইন্সের ১৬টি ফ্লাইটে এসব হাজি দেশে ফেরেন। হজের আনুষ্ঠানিকতা চলাকালে গত বৃহস্পতিবার মক্কা নগরীর মিনায় 'শয়তানের স্তম্ভে' পাথর ছুড়ে ফেরার পথে পদদলিত হয়ে ৭৬৯ জন নিহত ও ৯৩৪ জন আহত হন। নিহতদের মধ্যে ৪১ জন বাংলাদেশিকে শনাক্ত করার কথা জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।-সমকাল
২ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে