শুক্রবার, ০২ অক্টোবর, ২০১৫, ০৩:৩৭:৩২

‘বলপ্রয়োগ কোনো সমাধান নয়’

‘বলপ্রয়োগ কোনো সমাধান নয়’

আনিসুল হক : তারা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে চায়। ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে—এই অভিযোগ তুলে তারা আন্দোলন করছে। আমাদের এই ছেলেমেয়েদের পুলিশ মারধর করেছে। পত্রপত্রিকায় সেই ছবি দেখছি। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দেখছি, উদ্যত বুটের নিচে আমাদের তরুণ-তরুণীদের নাজুক, কিন্তু প্রতিবাদী অবয়ব। নারী পুলিশের একজন সদস্য রোষিত ভঙ্গিমায় ছুটে যাচ্ছেন একজন তরুণীর দিকে। কাগজে পড়লাম, এই প্রতিবাদকারীদের কাউকে কাউকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল থানায়। তারপর তাদের মারধর করা হয়েছে। কীভাবে মারা হয়েছে, তার উপন্যাসোচিত বর্ণনা ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। আমি সেসব সইতে পারছি না।

আমি কি এই প্রশ্ন করতে পারি, আমাদের বাচ্চাগুলোকে মারা হচ্ছে কেন? কারণ, তারা বিক্ষোভ করছে, প্রতিবাদ করছে, রাস্তা বন্ধ করে মানুষের চলাচলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে, নাগরিকদের শান্তি নষ্ট করছে। বটে! সেটা তো হতে দেয়া আমাদের উচিত নয়। কিন্তু কেন তারা পথে নেমেছে? যদি ধোঁয়া থাকে, তাহলে আগুন অবশ্যই আছে। কারণ ছাড়া কেউ বিক্ষুব্ধ হয়? নির্মলেন্দু গুণের একটা কবিতা আছে, আমরা এখানে কেন?

তাতে তিনি বলেছেন, রাজপথ কোনো সুখস্থান নয়। তাহলে ওই বাচ্চাগুলো কেন রাজপথে গেল? কারণ, তারা মনে করছে, এবার মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম সোচ্চার। চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের খবরে আমি দেখেছি, একজন পরীক্ষার্থী বলছে, সে পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র পেয়েছে, এবং সেটা মিলে গেছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করছে। পত্রিকায় একটা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছেন ‘পরিচালক, চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন’। তাতে বলা হয়েছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি, এটা সম্পূর্ণ গুজব।

তিনি মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছেন যে, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় যারা ভালো করেনি, এই রকম ছেলেমেয়ে ভর্তি পরীক্ষাতেও ভালো করেনি, এবং যেসব কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বলে গুজব রটেছে, সেখানকার পরীক্ষার্থীরা অস্বাভাবিক রকমের ভালো করেনি। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাদের আটক করেছে, তাদের কাছে যে প্রশ্নপত্র পাওয়া গেছে, সেগুলো ভুয়া, তারা ভুয়া প্রশ্নপত্র বিক্রি করে পয়সা কামানোর অপচেষ্টা করছিল।

আমি কোনো পক্ষ নেব না। চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের খবরের ভিডিওটি আমি দেখেছি, একজন শিক্ষার্থীর উক্তি আমি নিজ কানে শুনেছি। তারপরেও আমি কোনো পক্ষ নেব না। কিন্তু পরিচালক, চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন-এর বিজ্ঞপ্তির চেয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের বক্তব্য আমার তুলনামূলকভাবে পছন্দ হয়েছে। মন্ত্রী বলেছেন, প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে যেসব শিক্ষক জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এর আগে আমরা দেখেছি, সরকারের মধ্যে একটা প্রবণতা হলো সরাসরি অস্বীকার করা: না, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি, সব গুজব। মাদকাসক্তদের বেলায় এটাকে বলা হয় ডিনায়াল সিনড্রোম, তারা সব সময় অস্বীকার করে, তারা মাদকে আসক্ত নয়। আমরা দেখেছি, কর্তৃপক্ষ সব সময় তাদের এজেন্সি ও প্রশাসনের দেয়া তথ্যকেই বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে করে, এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত অভিযোগ, নাগরিকদের তোলা আওয়াজকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়। এসব অভিযোগকে কেবল তারা মিথ্যাই মনে করে না, মনে করে, উদ্দেশ্যমূলক, দুরভিসন্ধিময়, সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। সন্দেহবাতিকগ্রস্ততাও একটা অসুখ। এটাকে বলে প্যারানোয়া। সব সরকারই এই অসুখে ভোগে—সবাই শুধু আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রই করছে।

যেকোনো সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ হলো সমস্যাটাকে আমলে নেয়া। সমস্যাটা যে আছে, সেটা স্বীকার করা। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অসুখটা থেকে আমরা যে মুক্তি পাচ্ছি না, তার এক নম্বর কারণ, কর্তৃপক্ষ মনেই করে না যে আদৌ প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। তারা বিবৃতি দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে বলে ভাবে। এর সঙ্গে থাকে লাঠ্যৌষধি। যে বলবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, তাকেই ধর। রাস্তায় নামলে তো কথাই নেই, দাও মার। শিক্ষামন্ত্রীর কথায় খানিকটা সান্ত্বনা পাওয়া গেল, যাক, তাহলে তিনি ভাবছেন, হয়তো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে থাকতেও পারে। আর তার সঙ্গে শিক্ষকেরাও জড়িত থাকতে পারেন।

মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরা যাদের ধরেছেন, তাদের সামাজিক অবস্থান ও পেশা দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। সরকারি কর্মকমিশনের চাকুরে আর ডাক্তার। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেজিস্ট্রার। কোচিং সেন্টারের লোকেরা তো আছেনই।

অপরাধীদের কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই হতে পারে প্রশ্নপত্র ফাঁসের পুনরাবৃত্তি রোধের বড় পদক্ষেপ। শাস্তি দিতে হবে, এবং তা মানুষকে জানাতে হবে।

আর গোড়াতেই ফাঁকফোকর বন্ধ করে দিতে হবে। আমরা খুব অস্থির সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে টাকা হয়ে উঠেছে সবচেয়ে প্রণম্য, সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত। টাকা থাকলে সব পাওয়া যায়, ফুলের মালা, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং যা খুশি তা-ই করার ক্ষমতা। দুর্নীতি সব দেশে সব সময়ই ছিল, কিন্তু দুর্নীতিবাজ সম্মানীয়, সেটা এই দেশে এখনকার মতো আর কখনো ছিল না।

ডাস্টবিনের পচাগলা আবর্জনার মধ্যে পয়সা পড়ে থাকলেও এখন তুলে নেয়ার লোকের অভাব হবে না, প্রশ্নপত্র ফাঁস করে কিংবা নকল প্রশ্নপত্র বিক্রি করে টাকা আয়ের চেষ্টা যখন পাস করা ডাক্তাররা করেন, তখন তা খুব স্পষ্ট হয়ে যায়। আর আছে চাহিদা ও সরবরাহের সহজ অর্থনৈতিক সূত্র। আমি সম্প্রতি ঢাকার কয়েকটা স্কুলে গিয়েছিলাম, প্রধানত মেয়েদের স্কুল। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়া শিক্ষার্থীদের বললাম, তোমরা কারা ডাক্তার হতে চাও, হাত তোলো। শতকরা ৯০ জন হাত তুলেছে, তারা ডাক্তার হতে চায়। তাহলে মেডিকেলে ভর্তির প্রশ্নপত্রের চাহিদা তো থাকবেই, আর তা বিক্রির ব্যবসা গড়ে উঠতে চাইবেই। আর আমাদের মূল্যবোধ এতই পোকায় খাওয়া যে আমার সন্তানের জন্য ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্র কিনে আনতে আমার বিবেক সামান্য দগ্ধ হবে না।

কাজেই প্রশ্নপত্র ফাঁস করার প্রয়াস চলবেই। প্রক্রিয়াটাও বেশ জটিল। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা, বাছাই করা, ছাপানো, কেন্দ্রে কেন্দ্রে পাঠানো—এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় একজনও যদি লাইনচ্যুত হয়, তাহলেই শিকলের গ্রন্থি ছিঁড়ে যাবে, আর একটা কপিও যদি বাইরে যায়, তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়বে। তাই বলছি, বারবার করে বলছি, ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে উদ্ধৃত করে বলছি, ৫ সেট প্রশ্নপত্র তৈরি রাখুন, তাতে পুরো সিলেবাস কভার করে রাখুন, শুধু পরীক্ষার এক ঘণ্টা আগে জানিয়ে দিন, কোন সেটে পরীক্ষা হবে। এই সহজ বুদ্ধিটা কেন কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করছে না, সেটা আমার জন্য এক বিস্ময়ই।

আর শিক্ষার্থীদের বলব, ডাক্তার যে হতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। অভিভাবকদের বলব, আপনার স্বপ্ন সন্তানদের ওপরে চাপিয়ে দিয়ে অনর্থক চাপ সৃষ্টি করবেন না। এ পি জে আবদুল কালামের কাহিনিটা আবার বলি, তিনি হতে চেয়েছিলেন বিমানবাহিনীর পাইলট। ভর্তি পরীক্ষায় তিনি হয়েছিলেন নবম, নেয়া হয়েছিল আটজনকে। তিনি জীবনের ওপরে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন।

এই সময় এক স্বামীজি তাঁকে বলেন, নিয়তি তোমাকে হয়তো বিমানবাহিনীর পাইলট হওয়ার জন্য তৈরি করেনি, তুমি অন্য কিছু হবে, হতাশ না হয়ে আবার নতুন করে শুরু করো। এ পি জে আবদুল কালাম বিমানবাহিনীর পাইলট না হয়ে খারাপ কিছু করেননি, শেষতক ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। সম্প্রতি ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের পিতার সাক্ষাৎকার দেখলাম এক টেলিভিশনে। সাকিবের বাবাও চাননি ছেলে ক্রিকেটার হোক। ছেলে ভালো ছাত্র ছিল, তাই তিনি চেয়েছিলেন ছেলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হোক।

আজকে আমরা জানি, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে সাকিব ভালোই করেছেন। কাজেই যে তরুণেরা মেডিকেলে ভর্তিতে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অন্যায় পদ্ধতির শিকার হয়ে বঞ্চিত হয়েছে, তাদের আমি বলব, তোমাদের প্রতিবাদের সঙ্গে আমি সংহতি প্রকাশ করছি, তারপরেও বলব, মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে না পারা মানেই সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়। তোমাদের নিশ্চয়ই নিয়তি আরও ভালো কিছু করার জন্য, ভালো কিছু হওয়ার জন্য বেছে রেখেছে।

তার মানে এই নয় যে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার মতো প্রজ্বলন্ত অন্যায়কে আমি মেনে নিচ্ছি। আমি প্রতিবাদ করছি। আমি চাইছি ফাঁসকারীদের কঠোর শাস্তি। আমরা দেখতে চাই, এরপর আর কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে না, কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে আগে থেকেই শতভাগ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে রাখবে।

পাশাপাশি আবারও বলব, আমাদের সন্তানদের মারা হবে কেন? সরকারের মধ্যে কেউ কি নেই, যিনি কিনা আন্দোলনরত ওই শিক্ষার্থীদের কাছে যেতে পারেন, তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে আলোচনার টেবিলে আনতে পারেন, তাদের সঙ্গে বুঝিয়ে কথা বলতে পারেন, তাদের কথাও শুনতে পারেন? পুলিশি ব্যবস্থাই বিক্ষোভ দমনের একমাত্র উপায় নয়, শ্রেষ্ঠ উপায় তো নয়ই।

কিন্তু আরেকটা কথাও এই প্রসঙ্গে বলতে চাই। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এই বছরে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়া ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনেক ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন বেরোচ্ছে। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, এই রকম একজনও কি নেই, যে প্রশ্নপত্র পায়নি, নিজের যোগ্যতা ও মেধা দিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করেছে? উত্তর পেয়েছি, এই রকম অনেক আছে, তাদের সংখ্যাই বেশি।

আমি বলি, একজনও যদি বলে, সে প্রশ্নপত্র আগে পেয়েছিল, সেটাকে যেমন খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে, তেমনি একজনও যদি থাকে, যে সততার সঙ্গে যোগ্যতা ও মেধা দিয়ে পরীক্ষায় ভালো করেছে, তাহলে তাকে অসম্মান করাটা হবে ঘোরতর অন্যায়। ব্রিটিশ বিচার-পদ্ধতির একটা দর্শন হলো, ১০০ জন অপরাধী যদি ছাড়া পায়, সেটাও বিনা অপরাধে একজনকে শাস্তি দেয়ার চেয়ে ভালো। যে শিক্ষার্থীরা সততা ও মেধা দিয়ে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে, তাদের অবমানিত করার অধিকার আমাদের কারও নেই।-প্রথমআলো
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
২ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে