আনোয়ার হোসেন : এবার ভারী বর্ষণে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) হিসাবই বলছে, দেশের প্রধান সড়কের অন্তত ৩ হাজার ১০০ কিলোমিটার খানাখন্দে ভরা। ফলে এবার ঈদুল আজহার সময় ঘরে ফেরা লোকজনকে দুর্ভোগে পড়তে হতে পারে।
তবে এসব সড়ক মেরামতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় স্বাভাবিক বরাদ্দের বাইরে বাড়তি ২০০ কোটি টাকা চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে।
সম্প্রতি সওজের মাঠপর্যায়ের কার্যালয়গুলো থেকে বন্যা ও বর্ষণের ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন তৈরি করে তা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। এসব প্রতিবেদনে কিছু কিছু সড়কের ছবিও সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ভোলা এলাকার কিছু সড়ক এতই নাজুক যে তা চাষের জমি, নাকি সড়ক, তা আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
সওজ সূত্র জানায়, সারা দেশে সওজের বিভাগ আছে ৬৫টি। এর আওতাধীন মহাসড়ক-সড়ক পরিমাণ প্রায় ২১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় ১৯ হাজার কিলোমিটার গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা রোড; বাকি সড়ক কাঁচা বা ইটের। সওজের মাঠপর্যায় থেকে পাঠানো প্রতিবেদন অনুসারে ১৪ দশমিক ৩২ শতাংশ সড়ক-মহাসড়ক খুবই বেহাল।
গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত মাঠপর্যায় থেকে পাঠানো হিসাবে দেখা গেছে, ৩ হাজার ১০৭ কিলোমিটারের অবস্থা খুবই নাজুক। গত ১০ দিনে অবস্থা আরও অবনতি হয়েছে বলে সওজের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
সড়ক পরিবহন বিভাগের সচিব এম এ এন সিদ্দিক প্রতিবেদককে বলেন, সড়কের অবস্থা নিয়ে আমরা অবগত। আবহাওয়া অফিস বলছে, বৃষ্টি কমে আসবে। ঈদের আগেই রাস্তা ঠিক হয়ে যাবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ে বাড়তি অর্থ চাওয়া হয়েছে। তবে পুরোনো বরাদ্দ দিয়েই এখন কাজ চলছে।
এসব সড়ক-মহাসড়ক মেরামতে তাৎক্ষণিকভাবে ৩৫৪ কোটি টাকা চেয়েছে সওজের বিভাগীয় কার্যালয়গুলো। আর স্থায়ী মেরামতের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ২০৯ কোটি টাকা। তবে সওজ থেকে পাঠানো তাৎক্ষণিক চাহিদা ধরে সড়ক পরিবহন বিভাগ অর্থ মন্ত্রণালয়ে ২০০ কোটি টাকা চেয়েছে।
চলতি অর্থবছরে মেরামত খাতে সওজের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ১ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে ছিল ১ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, সওজের সড়ক ও সেতু মেরামতে গত পাঁচ বছরে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এ সময় প্রতিবছর মেরামতের জন্য গড়ে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। ২০১১ সালে সারা দেশে সড়কব্যবস্থা নাজুক হয়ে পড়লে সরকার আলাদা করে ১ হাজার ৪১০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেয়। এই প্রকল্পও শেষ হয়ে গেছে। এর বাইরে নানা উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনেও সড়ক মেরামত বাবদ অর্থ বরাদ্দ করা হয়।
সারা দেশে সওজ ছাড়াও স্থানীয় সড়ক প্রকৌশল অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের সড়ক রয়েছে। তবে সওজের সড়কেই সবচেয়ে বেশি যানবাহন চলাচল করে।
সড়কের চিত্র:- সওজের জেলা পর্যায়ের পাঠানো প্রতিবেদন অনুসারে সবচেয়ে বেশি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিরাজগঞ্জে। এই জেলার ৪২৭ কিলোমিটারের মধ্যে ২০৯ কিলোমিটারই বর্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মেরামত দরকার। এ ছাড়া বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম, পাবনা, ভোলা, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কক্সবাজার, রংপুর। সওজের প্রতিবেদনই বলছে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পুরোটাই খানাখন্দে ভরা।
ঈদের আর বাকি দুই সপ্তাহ। এ সময়ের মধ্যে সারা দেশের সড়ক মেরামতের কাজ শেষ করা নিয়ে সংশয় আছে সওজের কর্মকর্তাদের। তবে একাধিক কর্মকর্তা জানান, মহাসড়কগুলো বেশির ভাগই ভালো। স্থানে স্থানে খারাপ। ঈদের আগে এসব মহাসড়কেই বেশি জোর দেয়া হবে। তবে সওজের প্রধান প্রকৌশলী ফিরোজ ইকবাল এই প্রতিবেদককে বলেন, আবহাওয়ার আনুকূল্য পেলেই হবে। ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। ব্যাপকভাবে কাজের জন্য প্রস্তুত সবাই। ঈদে মানুষ নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
মেরামত ধুয়ে যাচ্ছে: প্রতিবছরই বর্ষা এলে সারা দেশের সড়ক বেহাল হয়ে পড়ে। সড়ক পরিবহন বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বৃষ্টিতে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া স্বাভাবিক। তবে বেহাল হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে মেরামতে অপচয়-লুটপাট।
সওজের কর্মকর্তা, সড়ক বিভাগের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তিন কারণে বর্ষা এলেই সড়ক বেহাল হয়ে পড়ে। প্রথমত, বেহাল সড়ক মেরামতের জন্য চাহিদা মেনে বরাদ্দ পাওয়া যায় না।
প্রতিবছরই সওজের মহাসড়ক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা (এইচডিএম) বিভাগ যন্ত্রের সাহায্যে ঘুরে ঘুরে সড়কের অবস্থার ওপর প্রতিবেদন তৈরি করে। কোন সড়ক কীভাবে মেরামত করা দরকার এবং কী পরিমাণ ব্যয় হতে পারে সেই হিসাবও প্রস্তাব করে। সেই হিসাবে দেখা গেছে, ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা মেরামতে ব্যয় করার কথা বলা হয়। কিন্তু এ সময় এর অর্ধেকও বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।
সড়ক পরিবহন বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, কম বরাদ্দ পাওয়ার পরও এর একটা অংশ আবার বেহাত হয়ে যায় প্রকৌশলী-ঠিকাদারের যোগসাজশে।
জানা গেছে, দৈনন্দিন মেরামতের একটা বড় অংশ ব্যয় করা হয় তাৎক্ষণিক দরপত্রের মাধ্যমে। সওজের প্রতিটি জেলা পর্যায়ের কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারকে কাজ দেয়া হয়। এঁদের অনেকেই আবার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা। এসব ঠিকাদার অর্থবছরের শুরুতে কিছু কাজ করে ফেলে রাখেন। শেষের দিকে এসে তাড়াহুড়ো করলেও তা মানসম্মত হয় না। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই তা ধুয়ে যায়।
এর বাইরে মেরামতের একটা অংশ চলে যায় মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আপ্যায়নে। মাঠ পর্যায়ে সফরে গেলে তাঁদের যে আপ্যায়ন করা হয়, তা মেরামত খাত থেকেই ব্যয় হয়। সওজের একজন কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রী, সচিব কিংবা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আপ্যায়নের আলাদা বরাদ্দ নেই। তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয় ঠিকাদারদের টাকায় আপ্যায়ন করা হয়। পরে তাঁদের মেরামতকাজ দিয়ে খরচ করা অর্থ সমন্বয় করা হয়।
সচিব এম এ এন সিদ্দিক বলেন, পর্যবেক্ষক দল সফরে গেলে আলাদা টিএ/ডিএ দেয়া হয়। আপ্যায়ন বা গিফট দেয়ার তথ্য কেউ দিয়ে থাকলে মিথ্যা বলেছেন। ঠিকাদার-কর্মকর্তার যোগসাজশে লুটপাট-অপচয় সম্পর্কে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে। এরপরও কেউ অনিয়ম করলে ছাড় দেয়া হয় না। ওয়েবসাইটে দেখবেন চারজন ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। কর্মকর্তাদেরও অব্যাহতিসহ নানা শাস্তি দেয়া হচ্ছে।-প্রথমআলো
১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে