মাসুদ করিম : মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সফর বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। দূর হবে অবিশ্বাস। সব মিলে তৈরি হবে আস্থার সম্পর্ক। বিশেষ করে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা এ সফরে বেশ উৎফুল্ল।
অনেক দিন ধরে দুই দেশের রাজনৈতিক পর্যায়ে নানা ইস্যুতে অবিশ্বাস বিরাজ করছিল। কিন্তু জন কেরি ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে শ্রদ্ধা নিবেদন করে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি যেভাবে আবেগপূর্ণ মন্তব্য লিখেছেন তাতে ক্ষমতাসীন মহল খুবই খুশি।
এদিকে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার জন কেরির সফরের ফল সম্পর্কে জানাতে একটি বিবৃতি দিয়েছে। এ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জন কেরি সফরকালে বাংলাদেশের কাছে শুভেচ্ছা বার্তা এবং বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সমর্থন পৌঁছে দিয়েছেন। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জঙ্গিবাদ দমনে আরও নতুন সহযোগিতার বিষয়ে তারা একমত হয়েছেন।
এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু উল্লেখ করা হয়নি। তবে কেরির সফরের পর সন্ত্রাস দমনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে আরও বেশি সম্পৃক্ত হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এদিকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমুন্নত রেখে সন্ত্রাস দমনের তাগিদ দিয়েছেন জন কেরি। তিনি সব রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে এ সংক্ষিপ্ত সফরেই সাক্ষাৎ করেছেন।
কেরির সংক্ষিপ্ত ও ব্যস্ত সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল, জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সিনিয়র পরিচালক পিটার লেভয়, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারীমন্ত্রী ম্যানপ্রীত আনন্দ সফরসঙ্গী হিসেবে ছিলেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর পরিদর্শনের দিকটি সরকারের উচ্চমহলে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের পরিদর্শন বইতে কেরি লিখেছেন, ‘সহিংসতা ও কাপুরুষোচিত ট্র্যাজেডি ঘটিয়ে মেধাবী ও সাহসী নেতাকে বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে চুরি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু আজ বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে তারই কন্যার শক্তিশালী নেতৃত্বের মাধ্যমে। তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে অংশীদার ও জোরালো সমর্থক হতে পেরে যুক্তরাষ্ট্র গর্বিত। আমরা শান্তি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে ও একসঙ্গে কাজ করতে চাই।’
যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের কোনো রাজনীতিবিদের পক্ষ থেকে কেরিই প্রথম বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানালেন। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রভাবশালী নেতা সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এসব কারণে কেরির এ সফরকে সরকারের পর্যায় থেকে মাইলফলক হিসেবে দেখা হচ্ছে। জন কেরির সফর কোনো বিশেষ এজেন্ডা পূরণের সফর ছিল না।
দুই দেশের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের সফর হিসেবে বিবেচিত ছিল। সেই দিক থেকে এই সফরকে ফলপ্রসূ বলছেন অনেকেই। তার ওপর কেরির সফর দুই দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সম্পৃক্ততার সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশেষ করে আগামী ২ অক্টোবর ঢাকায় নিরাপত্তা সংলাপের আগে এ সফর নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার অভিযান তুঙ্গে রয়েছে। এই ব্যস্ত সময়ের এক ফাঁকে তিনি ঢাকা সফর করে দুই দেশের সম্পর্কে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছেন। ফলে নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলের বিজয় হলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অভাবনীয় উন্নতি ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে। রিপাবলিকান দলের বিজয় হলেও পররাষ্ট্রনীতিতে ধারাবাহিকতায় কেরির সফরের সুফল অনেক বেশি পাওয়া যাবে।
মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কেরি মার্কিন জনগণের পক্ষে থাকার বার্তা সরকারি মহলে সাফল্য হিসেবে দেখছে সরকার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সফরে অভিভূত। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সরকারের তরুণ কূটনীতিক পদ ছেড়ে মাহমুদ আলী বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন।
সেই সময়ের কথা স্মরণ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী মঙ্গলবার বলেন, ‘নিক্সন, কিসিঞ্জার আর দু’জন উপদেষ্টা ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ব্যাপকভাবে বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন। কেরি ওই সময়ে অ্যাডওয়ার্ড কেনেডির সঙ্গে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করেছেন। তিনি বাংলাদেশ সফরকালে সেসব কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এটা চলমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরও জোরদার করবে’।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘গুলশানে হামলার পর কেরি প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন করেছিলেন। এখন নিজে এসে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার কথা বলেছেন। সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা আমরা নিচ্ছি। ডিএনএ পরীক্ষাসহ বিভিন্ন কারিগরি সহায়তা নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এসবই ইতিবাচক দিক’।
মুক্তিযুদ্ধকালে ওই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন ও কিসিঞ্জার বাংলাদেশের বিরোধিতা করায় বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের নীতিনির্ধারকরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নাখোশ ছিলেন। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস ইস্যুতে রাজনৈতিক পর্যায়ে বেশ টানাপোড়েন ছিল। গত পাঁচই জানুয়ারির সংসদীয় নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র হতাশা ব্যক্ত করেছিল। এসব কারণে বাংলাদেশে বর্তমান ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার সরকারের মধ্যে অস্বস্তি ছিল।
সরকারের কর্তাব্যক্তিদের নানা মন্তব্যে তা প্রমাণ হয়েছে। এতে দুই দেশের রাজনৈতিক পর্যায়ে শীতল সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামি রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় দেয়ায় ক্ষমতাসীন মহলে অবিশ্বাসের মাত্রা বাড়ে। ফলে ২০১২ সালে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সফরের পর কেরির সফরই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের কোনো রাজনৈতিক নেতার প্রথম বাংলাদেশ সফর। কেরির এই সফরের কারণে নিরাপত্তা, বাণিজ্য, বিনিয়োগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যোগাযোগ অনেক সহজতর হবে।
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনীতিক ও আমলা পর্যায়ে খুব ভালো যোগাযোগ আছে। তবে রাজনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ কম থাকায় যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত সুবিধাসহ বাণিজ্য সুবিধা দেশটির কংগ্রেসে পাস করানো কঠিন হয়। বাংলাদেশের রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থা নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের বিভিন্ন কমিটিতে কড়া সমালোচনা হয়। কেরির এই সফরে উভয়পক্ষের মধ্যে একটা বোঝাপড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
গুলশানে জঙ্গি হামলার পর বিদেশীদের মধ্যে বাংলাদেশ সফরে কিছুটা ভয়-ভীতি কাজ করেছিল। এখন জন কেরি বাংলাদেশ সফরের পর সেই ভীতি কেটে গেছে। যুক্তরাজ্যের ক্রিকেট দল বাংলাদেশ সফরে আসছে। যুক্তরাজ্যের একজন প্রতিমন্ত্রীও বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। কেরির মতো প্রভাবশালী অতিথির বাংলাদেশ সফরকে সেই দিক থেকেও ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আগ্রহ লক্ষ্যনীয়।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম মঙ্গলবার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘জন কেরি ঢাকায় বলেছেন ভিয়েতনাম ও জাপানের মতো দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করেও যুক্তরাষ্ট্র এখন ওইসব দেশের সঙ্গে জোরালো সম্পর্ক গড়ে তোলেছে। আমাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকালে মার্কিন প্রশাসনের কেউ কেউ বিরোধিতা করলেও অনেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছেন। এখন জন কেরি ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে শ্রদ্ধা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু ও তার কন্যার প্রশংসা করেছেন’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আমেনা মহসিন মঙ্গলবার দেয়া প্রতিক্রিয়ায় জন কেরির সফরকে খুবই ইতিবাচক হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি এই সফরকে খুবই ইতিবাচকভাবে দেখছি। ১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল; জন কেরি সেটা শুধরানোর চেষ্টা করেছেন। তার সফরের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদ ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে সহযোগিতাও এগিয়ে যাবে। এটাও ইতিবাচক। এছাড়াও, সবাইকে নিয়ে গণতন্ত্র এগিয়ে নেয় এবং নাগরিক সমাজসহ সবার অংশগ্রহণে সন্ত্রাস দমনের কথাও তিনি বলেছেন। এসব কারণে কেরির এই সফর ইতিবাচক’। - যুগান্তর
৩১ আগস্ট, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি