জামাল উদ্দিন : পবিত্র হজ পালন শেষে দেশে ফিরতে ফিরেছেন, এতেই আবেগ আপ্লুত হাজিরা। স্বজনকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরে অনেকেই কেঁদেছেন। কেউ কেউ হাউমাউ করে কেঁদে বলেছেন, ‘বাবারে, তোদের দোয়ায় অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। দু-এক মিনিট এদিক-সেদিক হলেই হয়ে যেতাম লাশ। সব আল্লার ইচ্ছা।’
শুক্রবার দুপুরে ঘরে ফেরা হাজি ও তাদের স্বজনদের কান্নায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বহির্গমন চত্বরে সৃষ্টি হয় এক আবেগঘন পরিবেশ।
পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জের বাসিন্দা লাট মিয়া। তিনি পবিত্র হজ পালন শেষে মদিনা এয়ারপোর্ট হয়ে সৌদিয়া এয়ারলাইন্সে দেশে ফেরেন শুক্রবার দুপুরে। ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে বের হয়ে এসেই হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় স্বজনরা দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলে সবাই কান্না জুড়ে দেন। তাকেও সান্ত্বনা দেন সবাই।
এ সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে মিনার স্মৃতিচারণ করে হাজি লাট মিয়া উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, তারা জামারায় ছোট-বড় তিন শয়তানকে পাথর মেরে মাত্র বের হয়েছেন। অমনিই শুরু হয় হৈচৈ ও হজ করতে যাওয়া হাজার নারী-পুরুষের হুড়োহুড়ি। দ্রুত তারা সেখান থেকে সরে আসতে পারলেও অনেক পরিচিতজন সেখানে পদদলিত হয়ে আহত ও নিহত হন।
রাজধানীর ধানমণ্ডির রফিকুল হাসান হজ শেষে দেশে ফিরে আসেন শুক্রবার। বয়স ৩০-এর কোঠায়। এক বন্ধুসহ তিনি হজ করতে যান। মিনার ভয়াবহ ট্রাজেডির একজন প্রত্যক্ষদর্শী।
হাসান বলেন, মাত্র দুই মিনিটের ব্যবধানে তিনি ও তার বন্ধু প্রাণে বেঁচে যান। দুই মিনিট আগে গেলেই পদদলনের শিকার হতেন তারা। যখন হুড়োহুড়ি শুরু হয়, তখন সেখানে এক অবর্ণনীয় দৃশ্যের অবতারণা হয়। নারী, শিশু, বৃদ্ধরা নিমেষেই হাজার হাজার মানুষের পায়ের নিচে পড়ে যাচ্ছেন।
হাসান বলেন, কী কারণে জানি না, জামারায় যেখানে শয়তানকে পাথর মারা হয়, সেখানে যাওয়ার প্রধান সড়কটি বন্ধ করে দিয়ে অন্যদিক দিয়ে ছোট একটি ফটক খুলে দেওয়া হয়। স্থানীয় সময় আনুমানিক সকাল পৌনে ৯টা থেকে ১০ টার মধ্যে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। প্রধান সড়ক বন্ধ করে দেয়ার বিষয়ে হাসান পরে জানতে পারেন, ওই সড়ক দিয়ে সৌদি রাজার ছেলে গেছেন।
তিনি বলেন, যখন পদদলনের ঘটনা শুরু হয়, তখন তারা দ্রুত অন্য প্রান্তে সরে যান। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে ওইখানে গিয়ে দেখেন নারী ও শিশুসহ শত শত মানুষের নিথর দেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। পরে তারা শয়তানকে পাথর মেরে পবিত্র মক্কা নগরীর দিকে চলে যান।
কুমিল্লার মুরাদনগরের তছলিম সরকার বলেন, হেরেম শরিফে ক্রেন ভেঙে পড়ার কথা। তিনি বলেন, গত ১১ সেপ্টেম্বর ঘটনার দিন বিকালে হঠাৎ ঝড় শুরু হয় মক্কা নগরীতে। পরে তাদের অনেকেই হেরেম শরিফে আশ্রয় নেন। সন্ধ্যার কিছু আগে হঠাৎ তাদের অদূরে একটি ক্রেন ভেঙে পড়ে। মুহূর্ত মাত্র, এরপরই দেখেন সেখানে অনেক রক্তাক্ত লাশ।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের বাসিন্দা এ কে এম জহির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, হজের নিয়ম অনুযায়ী মুজদালিফার ক্যাম্প থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর সকালে মিনার জামারাতে শয়তানকে পাথর মারতে যাচ্ছিলেন হাজার হাজার মানুষ। তখনই সেখানে হুড়োহুড়ি শুরু হলে পদদলনের মতো মর্মান্তিক ঘটনার সূত্রপাত হয়।
তিনি বলেন, সৌদি রাজার ছেলের নিরাপত্তার জন্য হঠাৎ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তিনটি গেটের মধ্যে দুটি বন্ধ করে দেয়। ফলে সেখানে প্রচণ্ড জনচাপের সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, আমরা তখন ওপরে ছিলাম। তাই বেঁচে গেছি। না হয়, সেখানেই পদদলিত হয়ে মারা যেতাম। হায়াত-মউতের বিষয়টি আল্লার হাতে মনে করেন তিনি। যারা মারা গেছেন তারা শহীদ হয়েছেন বলেও তার বিশ্বাস।
রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের বাসিন্দা হাবিবুল্লাহ বলেন, তিনি আয়ারল্যান্ডে স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে বসবাস করেন। তার পুরো পরিবারই আয়ারল্যান্ডের নাগরিক। এবার বাচ্চাদের স্কুল ছুটির পর স্ত্রী ও সন্তানদের দেশে পাঠিয়ে তিনি হজ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে যান। সেখানে তিনি আয়ারল্যান্ডের পাসপোর্ট ব্যবহার করে গিয়েছিলেন।
হজ শেষে শুক্রবার দেশে ফিরে আসেন। হাবিবুল্লাহ বলেন, সৌদি আরবে গিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশি ও হাজিদের দেখে অনেক কষ্ট পেয়েছেন। সৌদিয়ানরা এশিয়া অঞ্চল, বিশেষ করে বাঙালিদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেন। আর ইউরোপের নাগরিকদের অনেক সমীহ করেন। তিনিসহ যারা ইউরোপ থেকে হজে গিয়েছিলেন, তারা আয়েশেই ছিলেন। তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থাপনা করা হয়। বাংলাদেশ থেকে যারা কম টাকায় হজে গেছেন, তারা যেমন কষ্টে ছিলেন, তেমনি বেশি টাকা খরচ করে যারা গেছেন, তারাও ভালো ছিলেন না। মদিনায় এমন কয়েকজনের সঙ্গেই তার কথা হয়েছে বলে জানান তিনি।
মিনার দুর্ঘটনার বিষয়ে হাবিবুল্লাহ বলেন, তারা ছিলেন ওপরে। ঘটনাটি ঘটেছে নিচে। ওপর থেকে দেখেছেন, এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য, যা বলার মতো নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন। -ট্রিবিউন
২ অক্টোবর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম