নুরুজ্জামান লাবু : রাজধানীর রূপনগরের মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলামের বাসায় যাতায়াত ছিল আরও অন্তত ১০ জঙ্গির। এর মধ্যে চার জনের নাম পেয়েছে পুলিশ। তারা হলো মানিক, ইকবাল, আকাশ ও সাগর। এ ঘটনায় রবিবার রূপনগর থানার এসআই মেহেদী হাসান বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া জাহিদের বাসা থেকে ৪৬ ধরনের আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান এই তথ্য জানিয়েছেন।
এজাহারে বলা হয়েছে, প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, জঙ্গি জাহাঙ্গীর আলম ওরফে মেজর মুরাদ ওরফে ওমর গত ২ সেপ্টেম্বর রাত সোয়া ৮টার দিকে রূপনগর আবাসিক এলাকার ৩৩ নম্বর সড়কের ১৪ নম্বর বাসার ষষ্ঠ তলার পশ্চিম পার্শ্বে (আবুল হাশেমের ভাড়াটিয়া) ফ্ল্যাটে অবস্থান করে। এ সময় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তল্লাশির জন্য ব্লক রেইড চালানোর সময় সে পুলিশকে হত্যার উদ্দেশ্যে অতর্কিত গুলিবর্ষণ ও চাকু নিয়ে আক্রমণ করে।
পুলিশও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালালে ওই জঙ্গি মারা যায়। ওই জঙ্গি তার ফ্ল্যাটে মাঝে মাঝে থাকতো এবং তার সহযোগী মানিক, ইকবাল, আকাশ ও সাগরসহ অজ্ঞাতনামা ৫/৬ জন জঙ্গি তার ফ্ল্যাটে যাতায়াত করত। সে অজ্ঞাতনামা জঙ্গিদের সহায়তায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবি ও সমর্থনপুষ্ট অন্যান্য সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের কাজে অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্ফোরকদ্রব্য দিয়ে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শের মাধ্যমে সহায়তা ও প্ররোচনা দিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে অপরাধ করেছে।
রূপনগরের অভিযানের বর্ণনা দিয়ে মামলার এজাহারে বলা হয়, পুলিশ ব্লকরেইড করার সময় ভবনের নিচে এবং ছাদসহ সুবিধাজনক স্থানে পুলিশ অবস্থান নেয়। ঘটনার রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে আল্লাহ আকবর বলে ধ্বনি দিয়ে বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কা তৈরি করে। সে দরজা খুলে দৌড়ে নিচে নেমে আসে এবং মেইন গেটে পুলিশের মুখোমুখি হলে পুলিশ তাকে আটকানোর চেষ্টা করে। এ সময় সে রূপনগর থানার অফিসার্স ইনচার্জ সৈয়দ সহিদ আলমকে আক্রমণ করে এবং চাকু দিয়ে এলোপাথাড়ি আঘাত করে।
এ সময় পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) শাহীন ফকির এগিয়ে গেলে তাকেও চাকু মারে এবং গুলি করে মারাত্মক জখম করে। তাদের সঙ্গে থাকা এসআই মমিনুর রহমান এগিয়ে গেলে তাকেও চাকু দিয়ে ডান হাতে আঘাত করে এবং অন্যান্য পুলিশ সদস্যদের প্রতিও আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। এ সময় ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশে অফিসার্স ইনচার্জসহ এসআই মেহেদী, মামুন, মোমিন, এএসআই বোখারী, পলাশ ও কনস্টেবল সোহেল গুলি করে। পুলিশের গুলিতে ওই জঙ্গি ৩৩ নম্বর সড়কের ১৫ নম্বর বাড়ির সামনে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে এবং মৃত্যুবরণ করে। পরে আহত পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। খবর পেয়ে উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান।
অভিযানের পর পুলিশ ওই বাসা থেকে দুটি পৃথক জব্দ তালিকার মাধ্যমে ৪৬ ধরনের আলামত জব্দ করেছে। জব্দ করা আলামতগুলো হলো এক রাউন্ড গুলিসহ একটি ম্যাগাজিনযুক্ত সিলভার কালারের পিস্তল, একটি সিলভার কালারের চাকু যাহার লম্বা অনুমান সাড়ে ৭ ইঞ্চি, ৩টি বিকৃত বুলেট, পিস্তলের গুলি একটি, পিস্তলের গুলির খোসা ১১টি, এসএমজির গুলির খোসা ৪টি, এক জোড়া সাদা কালো রঙের স্যান্ডেল এবং দুটি চাবি।
এছাড়া অন্য একটি জব্দ তালিকায় একটি বুলেট যার পেছনে হোর্নডে ৩২ অটো লেখা, দুটি চাপাতি যার লম্বা একটি বাটসহ লম্বা অনুমান ১১ ইঞ্চি ও আরেকটি সাড়ে ১৬ ইঞ্চি, একটি কাঠের বাটসহ অনুমান সাড়ে ৯ ইঞ্চি লম্বা চাকু, একটি স্ক্রু ড্রাইভার, ধার দেওয়া পাটা জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া সেখান থেকে যেসব বই জব্দ করা হয়েছে এগুলো হলো, আল্লাহর ৯৯টি নাম সংবলিত বই দুটি, তাফসির ইবনে কাসি (১ থেকে ১৮ খণ্ড পর্যন্ত মোট ৯টি বই), মন দিয়ে নামাজ পড়ার উপায়, বাংলা ও ইংরেজিতে অনুবাদসহ কোরআন শরিফ ( ৩টি), জান্নাতি সুধা ইসলামি, তাক্বিব রিয়াম্বসম্বালিহীন, আলকোরানুল মজিদ (১০ খণ্ড), কালিমা তাইয়্যাইবা একটি জীবন আদর্শের দাওয়াত, সালাতের পর রাসুল (সা) যেসব দোয়া পড়তেন, জিকির, ফাতাওয়া আরকানুল, বাংলাদেশ প্রচলিত শিরক, বিদআত ও কুসংস্কার পর্যালোচনা, নামাজ ত্যাগকারীর বিধান, আল কোরআনের ভাষা, বুলুগুল মারাম, আহলে সুন্নাত, আকিদাহ্ সম্পর্কিত কতিপয় মাসালাহ, দ্য পিলারস অব ফেইথ, রমজান মাসের ৩০ আমল, নেক সুরতে শয়তানের ধোঁকা, মুসলিম এটিকুয়েটস, আল আক্বিদাহ আততাহবীয়াহ, জান্নাত জাহান্নাম, সালাতুল রাসুল, কিতাবুল ইলম, ইমাম ইবনে তাইময়াহ (রহ.), তাওহিদি দুর্গ, শুধু আপনারই সাহায্যে প্রার্থনা করিব, তাওহিদি জিজ্ঞাসার জবাব, ইসলামে বন্ধুত্ব ও শত্রুতা, দ্য লাস্ট কুরানিক জাজ। এছাড়া জব্দ করা হয়েছে এক জোড়া সেনাবাহিনীর মোজা।
পুলিশের অভিযানে নিহত জঙ্গি জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী জেবুন্নাহারও জঙ্গি দলের সদস্য বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। রূপনগরের বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর দুই কন্যা সন্তান নিয়ে আত্মগোপনে রয়েছে জেবুন্নাহার। ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের (সিটি) কর্মকর্তারা বলছেন, ‘দুই সন্তানসহ জেবুন্নাহারকে খোঁজা হচ্ছে। তাকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারলে জাহিদুলের অনেক অজানা বিষয় সম্পর্কে জানা যাবে।’
সিটির কর্মকর্তারা জানান, ‘তাদের কাছে তথ্য রয়েছে জেবুন্নাহারও তার স্বামীর সঙ্গে জঙ্গি দলে নাম লিখিয়েছে। স্বামীসহ অন্যান্য জঙ্গিদের সে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতো। তারা এর আগে কোথায় কোথায় অবস্থান করেছিল এবং তাদের সঙ্গে কাদের কাদের যোগাযোগ হয়েছে তা জানা যাবে। সে রাজধানীর একটি আবাসিক এলাকায় অবস্থান করছে বলে সিটি কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য রয়েছে। তাকে ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে।’ - বাংলা ট্রিবিউন
৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি