মাহমুদ আজহার : হোঁচট খেল বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জঙ্গিবিরোধী জাতীয় ঐক্য। সরকারবিরোধী অন্য দলগুলোর সাড়া না পেয়ে ২০-দলীয় জোটই এখন ভরসা বিএনপি প্রধানের। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ছাড়া কোনো দলই বেগম জিয়ার চায়ের দাওয়াতে আসেনি। বাম দলগুলো ইতিমধ্যে বিএনপির ঐক্যের ডাকে ‘না’ আসার কথা জানিয়ে দিয়েছে।
অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও ড. কামালের ভূমিকাও অস্পষ্ট। তাদেরও খালেদা জিয়ার ডাকে সাড়া দেওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা কিছুটা হতাশ হলেও ঘর ঘোছানো নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে দলটি। একইভাবে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে লড়তে সেই ২০ দলই ভরসা মনে করছে বিএনপি। রাখা না রাখা ইস্যুতে সমালোচনার ঝড় বইলেও জোটে জামায়াত থাকছে আগের মতোই।
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, জাতীয় ঐক্য নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া এখন আর মাথা ঘামাচ্ছেন না। এরই মধ্যে দলের নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ঈদের পর তিনি জেলা পুনর্গঠন নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাবেন। টানা তিন-চার মাস ঘর গোছানো নিয়েই দলীয় নেতা-কর্মীরা ব্যস্ত থাকবে। বেগম জিয়াও চলতি বছরের মধ্যেই দলকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আগামী বছরের মাঝামাঝি দল ও জোটকে নিয়েই রাজপথের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার চিন্তাভাবনা করছেন তিনি। তবে সরকারবিরোধী অন্য দলগুলোর ভূমিকায় তিনি কিছুটা হতাশও— জানালেন বিএনপির সিনিয়র এক নেতা।
জানা যায়, জোটের শরিক দলগুলোও বিএনপির জাতীয় ঐক্য নিয়ে খুব একটা খুশি নয়। জোটের বৈঠকে বেগম জিয়ার ঐক্যের উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও তাদের পাশ কাটিয়ে জাতীয় ঐক্য নিয়ে বিএনপির একলা চলো নীতির সমালোচনাও করছে তারা। অনেকে বিএনপির ভূমিকা নিয়েও ধোঁয়াশায় রয়েছেন। এটাকি শুধু জঙ্গিবিরোধী ঐক্য না পৃথক নির্বাচনী ঐক্য—তাও স্পষ্ট নয়। শরিক দলের নেতারা বলছেন, এর আগেও যেসব দল বিএনপির ডাকে সাড়া দেয়নি, তাদের পেছনে দৌড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই।
বিএনপির জাতীয় ঐক্য নিয়ে প্রকাশ্যেই সমালোচনা করেছেন জোটের অন্যতম শরিক দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম। তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি যে দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য করতে চাইছে, তাদের দিয়ে বৃহত্তর ঐক্য হবে বলে বিশ্বাস করি না। নানা অজুহাতে জোটে আসতে অনীহা প্রকাশ করেছে তারা। ২০ দলের বাইরে যারা আছে, তাদের সঙ্গে বিএনপির পক্ষ থেকে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। তারা কয়েকটা দল নিয়ে ড. কামাল হোসেন সাহেবের সঙ্গে একটা জোটও করেছিল। এদের অনেকে ধান্দাবাজ, অনেকে দুর্নীতিবাজ। তারা বিভিন্ন কলাকৌশল নিয়ে এগোচ্ছে।’
জোটের একাধিক নেতা জানান, এ মুহূর্তে বিএনপির উচিত ২০-দলীয় জোটকে সক্রিয় করা। প্রয়োজনে নিবন্ধিত আরও দলকে সম্পৃক্ত করে জোটের পরিধি বাড়ানো। দুঃসময়ে যারা জোটের পাশে থাকবে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা। অবশ্য নানা কারণে প্রকাশ্যে জাতীয় ঐক্য নিয়ে সম্ভাবনা দেখছে না খোদ বিএনপিও। তাই এ ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে ধীর গতিতে চলছে দলটি।
জানা যায়, জাতীয় ঐক্য প্রশ্নে একমাত্র কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল বেগম খালেদা জিয়ার চায়ের আমন্ত্রণে সাড়া দেয়নি। চায়ের আমন্ত্রণে এলেও কাদের সিদ্দিকীর কথাবার্তাও বিএনপি সন্তুষ্ট হতে পারেনি। এরই মধ্যে আ স ম আবদুর রবের জেএসডি, বাসদ ও সিপিবিও ওই ঐক্য প্রক্রিয়ায় না থাকার কথা জানিয়েছে। আ স ম আবদুর রব অবশ্য পৃথক জোট গঠনের প্রক্রিয়া করছেন। ২০-দলীয় জোটের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা জানান, একটি রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিয়ে উপনির্বাচনে অংশ নিয়েছে। ঋণ খেলাপির দায়ে তার মনোনয়নও বাতিল হয়েছে। এ নিয়ে রাজনীতিতে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়।
এ দলটি কখন কী বলে, কী করে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এখন বিএনপি তার পেছনে ছুটছে। জোটপ্রধান বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে জাতীয় ঐক্য নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ওই দলটির নেতা যে ধরনের বিব্রতকর বক্তব্য দিচ্ছেন, তাকে নিয়ে ঐক্য করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। অন্যদিকে বাপ-ছেলের আরেকটি দল বিএনপি জোটের হরতাল-অবরোধ নিয়ে যেসব মন্তব্য করেছে, দুঃসময়ে তারা সরকারের সঙ্গে আঁতাত করেছে তাদের নিয়েও কোনো ঐক্য হতে পারে না। আবার আ স ম আবদুর রব পৃথক জোটও করছেন। সুতরাং ওইসব দলের পেছনে না ঘুরে বিএনপির উচিত জোটকে আরও সক্রিয় করা।
এ প্রসঙ্গে জোটের অন্যতম শরিক দল কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক জানান, ‘গত ১৩ জুলাই ২০-দলীয় জোটের বৈঠক হয়। সেখানে সবার পরামর্শেই জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই ঐক্যের অগ্রগতি কী আমি জানি না।’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে চায়ের দাওয়াত গ্রহণ করে কাদের সিদ্দিকীর বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কাদের সিদ্দিকী থাকবেন না বলেই ওই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন।’
বিএনপির এক দায়িত্বশীল নেতা জানান, বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪২টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৩৬টি দলই অংশ নেয়নি। বিএনপির উচিত ছিল, জোটে আসুক আর না আসুক তাদের সঙ্গে কৌশলগত ঐক্য করা। সব সময় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। বিগত রমজানে রাজনৈতিক দলের সম্মানে বেগম খালেদা জিয়ার ইফতারেও জোটের বাইরে কোনো দলকেই দেখা যায়নি। কেন তারা এলো না—বিএনপিকে গভীরভাবে ভাবতে হবে।
জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘কাউকে জোর করে ঐক্যে আনার ইচ্ছা নেই বিএনপির। আমরা মনে করি, জঙ্গিবাদ সমস্যাটি জাতীয় সংকট। সেখানে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে একটি প্লাটফর্মে আসা উচিত। আমাদের চেয়ারপারসন জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। সরকারকেও আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। আমাদের ২০-দলীয় জোট তো আছেই। জোটের বাইরে থাকা কয়েকটি দলের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে চান বিএনপি চেয়ারপারসন। এরই মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরুও হয়েছে। প্রত্যেকেরই মত-পথ আলাদা। তারপরও আমরা চাচ্ছি, দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের স্বার্থে ঐক্য হওয়া।’ বিডি প্রতিদিন
৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি