শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ০৭:২৭:৫৪

আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে কী পরিবর্তন আসবে?

আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে কী পরিবর্তন আসবে?

সোহরাব হাসান : ৬৭ বছর বয়সী আওয়ামী লীগের ২০তম কাউন্সিল হতে যাচ্ছে আগামী ২২ ও ২৩ অক্টোবর; নির্ধারিত সময়ের প্রায় এক বছর পর। গেল কাউন্সিল হয় ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর। বাংলাদেশে সাধারণত বিরোধী দলগুলো বৈরী পরিবেশে যথাসময়ে কাউন্সিল করতে পারে না। যেমন বিএনপি। বিরোধী দলে থাকতে আওয়ামী লীগও একই ধরনের পরিস্থিতির শিকার হয়েছে।

কিন্তু ক্ষমতাসীন দলটির কাউন্সিল দুই দফা (২৮ মার্চ ও ১০-১১ জুলাই) পিছিয়ে দেওয়ার কী কারণ থাকতে পারে? আওয়ামী লীগের কাউন্সিল নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে যেমন আগ্রহ আছে, তেমনি দলের বাইরের সাধারণ মানুষও কৌতূহলের সঙ্গে দেখতে চাইছেন গঠনতন্ত্র ও নেতৃত্বে কী ধরনের পরিবর্তন আসে। ২০১৯ সালের শুরুতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। অনেকে আগাম নির্বাচনের কথা বললেও তার সম্ভাবনা কম। সে ক্ষেত্রে এই কাউন্সিলে দলের যে-ই নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে, সেই নেতৃত্বের হাতেই অর্পিত হবে সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি ও রণকৌশল।


যেকোনো দলের জাতীয় কাউন্সিলের উদ্দেশ্য থাকে বিগত কাউন্সিলের পর নেতৃত্বের সাফল্য-ব্যর্থতার নিরিখে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ও কর্মকৌশল নির্ধারণ। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব মনে করেন, তারা কোনো ভুল করতে পারেন না। অন্যদিকে দলীয় কাউন্সিলররাও ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের সুযোগ পান না। দলের শীর্ষ নেতা বা নেত্রী যত দিন বেঁচে আছেন, তত দিন বিকল্প নেতৃত্বের কথা তারা ভাবতে পারেন না বা ভাবতে দেওয়া হয় না।

তবে দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি, অর্থাৎ সাধারণ সম্পাদক বা মহাসচিব পদ নিয়ে কাউন্সিলে কিংবা কাউন্সিলের আগে সরগরম আলোচনা হয়ে থাকে। গত মার্চে বিএনপির কাউন্সিল হওয়ার আগে প্রায় তিন বছর ধরেই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আলোচনায় ছিলেন, যদিও শীর্ষ নেতৃত্ব তাকে ‘ভারপ্রাপ্ত’ করে রেখে দিয়েছিলেন। হয়তো আনুগত্য প্রমাণের পরীক্ষা। আওয়ামী লীগে ভারপ্রাপ্ত থাকার নজির কম (ব্যতিক্রম ১৯৮৩ সালে আবদুর রাজ্জাক দল ছেড়ে নতুন দল করায় সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল)।

এবারও আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সভাপতি পদে পরিবর্তন আসবে, সে কথা কেউ মনে করেন না। অর্থাৎ, শেখ হাসিনাই সভানেত্রী পদে থেকে যাচ্ছেন। ১৯৮১ সালের পর এই পদে কোনো পরিবর্তন নেই। খালেদা জিয়াও ১৯৮৪ সাল থেকে দলের চেয়ারপারসন পদে আছেন। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে কেউ কেউ নিজেকে বিকল্প ভাবলেও তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মতে, সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বিকল্প নেই। অন্যান্য পদে যোগ-বিয়োগ হলেও সেটি খুব উল্লেখযোগ্য হবে না বলেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, আগামী ২২ ও ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের আকার ৭৩ থেকে বাড়িয়ে ৮১ করা হচ্ছে। জেলা-উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটির আকারও বাড়বে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রেসিডিয়ামে দুটি, সাংগঠনিকে তিনটি পদ বাড়ছে। প্রশিক্ষণ সম্পাদকের পদ নতুন সৃষ্টি করা হচ্ছে। বিভাগ বেড়ে যাওয়ায় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদও বাড়বে। রাজনৈতিক দলে নেতাদের প্রশিক্ষণের কাজটি চালু করেছিলেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। নেতা-কর্মীরা প্রশিক্ষণের জন্য প্রশিক্ষণ সম্পাদক থাকবেন, প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, খুবই ভালো কথা। কিন্তু নেতা-কর্মীরা সেই প্রশিক্ষণ কী কাজে ব্যবহার করছেন, নেতাদের সেটিও তদারক করা উচিত।

বর্তমান গঠনতন্ত্রে আওয়ামী লীগের ৭৩ সদস্যের কার্যনির্বাহী সংসদের মধ্যে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মিলে সভাপতিমণ্ডলীর পদের সংখ্যা ১৫। সাধারণ সম্পাদকসহ দলের সম্পাদকমণ্ডলীর পদ ৩২টি। এর মধ্যে তিনজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাতজন সাংগঠনিক সম্পাদক। দপ্তর-উপদপ্তর ও প্রচার-উপপ্রচার সম্পাদক চারজন। বাকি ১৭টি বিষয়ভিত্তিক সম্পাদকের পদ। এর বাইরে একজন কোষাধ্যক্ষ ও ২৬টি সদস্যের পদ রয়েছে। বর্তমান কমিটিতে সহসম্পাদক আছেন এক হাজারের অধিক।

গত কয়েক বছরে গণহারে এসব সহসম্পাদক নিয়োগ করা হয়। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে সহসম্পাদকের সংখ্যা নির্দিষ্ট না থাকলেও ১৯টি সম্পাদকীয় বিভাগের কথা উল্লেখ আছে। আর প্রতিটি সম্পাদকীয় বিভাগে অনূর্ধ্ব পাঁচজন সহসম্পাদক নেওয়ার কথা বলা আছে। এই হিসাবে সহসম্পাদকের সংখ্যা ৯৫-এর বেশি হওয়ার কথা নয়। বিএনপির ঢাউস কমিটি নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা হাসিঠাট্টা করেছেন। কিন্তু সহসম্পাদকের সংখ্যা বিবেচনায় নিলে আওয়ামী লীগের পাল্লাই ভারী।

আওয়ামী লীগ নিজেকে দেশের সবচেয়ে বড় ও বনেদি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে দাবি করে। কিন্তু সেই দলে গণতন্ত্রচর্চার সুযোগ কতটা আছে, সেই প্রশ্ন না উঠে পারে না। সম্প্রতি নির্বাহী কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, বিগত পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করার কারণে যাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল, তাদের আবার দলে ফিরিয়ে আনা হবে। এখানে শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনা ঘটেছে। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে বহিষ্কৃত নেতারা নির্বাচন করেছেন এবং অনেকে জয়ীও হয়েছেন। পরাজিত হয়েছেন দলের মনোনীত প্রার্থীরা। তাঁদের সংখ্যা মনোনীত প্রার্থীদের কাছাকাছি। এতে প্রমাণিত হয়েছে, তৃণমূলের সঙ্গে দলের নেতৃত্বের দূরত্বটা কত বেশি।

দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে যারা বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচন করেছেন, তারা দলে ফিরে আসতে পারলেও কথিত সংস্কারবাদীদের কেউ কেউ এখনো দলের কাছে অসূয়া হয়ে আছেন। আবার কাউকে কাউকে দল থেকে একেবারে বাদ না দিলেও পদাবনয়ন করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তারা বলেন, বাদ পড়া নেতাদের দলে ফেরত নেওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু নির্বাচনে জয়ী হলে তাকে সাদরেই গ্রহণ করা হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে হারিয়ে জয়ী হন বিদ্রোহী প্রার্থী হাজি সেলিম। সংসদে তিনি স্বতন্ত্র সদস্য আর বাইরে আওয়ামী লীগের নেতা। এ রকম উদাহরণ আরও আছে।

আওয়ামী লীগের কাউন্সিলকে সামনে রেখে দেশবাসী কী পরিবর্তন আশা করতে পারে? ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে দলটি দিনবদলের কথা বলেছিল। কিন্তু দিন বদল হয়নি। আর্থসামাজিক উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকারের বেশ কিছু সাফল্য থাকলেও রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা পুরোপুরি ধসে গেছে। সরকার ও প্রধান বিরোধী পক্ষের মধ্যে মুখ দেখাদেখিও বন্ধ।

গণমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই গুরুত্ব পাবে। অস্বীকার করার উপায় নেই, জঙ্গিবাদ দেশ ও মানবতার শত্রু। রাজনৈতিক দলসহ সব শ্রেণি ও পেশার মানুষকে এর বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ অতীতে যে দুর্নীতি, অপশাসন ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিল, সেসব ক্ষেত্রে আদৌ অগ্রগতি আছে কি? জনপ্রশাসনে দুর্নীতি কি কমেছে? দলীয় সন্ত্রাসীরা খামোশ হয়েছে?

আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটে যে গঠনতন্ত্র আছে, তাতে স্বাধীনতার আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার পাশাপাশি সংসদীয় গণতন্ত্রের সুস্থ বিকাশ ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের কথা আছে। এ ছাড়া জনগণের পছন্দমতো ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই যে বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাস, মাস্তানি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি চলছে, তা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা? ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের কথা না হয় বাদ দিলাম।

আওয়ামী লীগের সাফাই, বিএনপি নির্বাচনে না আসায় জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাননি। কিন্তু গত ইউপি ও পৌরসভা নির্বাচনে তো বিএনপি অংশ নিয়েছে। সেসব নির্বাচনে কেন ভোটাররা পছন্দমতো ভোট দিতে পারলেন না? ইউপি নির্বাচনের চিত্র এতটাই ভয়ংকর ছিল যে, আওয়ামী লীগের নেতারাও ‘বিব্রত’ বোধ করেছেন। ক্ষমতাসীন দলের বিব্রত হওয়ার নির্বাচন দিয়ে কীভাবে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে?

কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে আরও কিছু বিষয় সামনে এসেছে। ২০০৯ সালে সংশোধিত জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) বলা হয়েছিল, ২০২০ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো সর্বস্তরের কমিটিতে নারীদের ৩৩ শতাংশ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে। এই অঙ্গীকার করে তারা নিবন্ধন নিয়েছে। এরপর ২০১২ সালে আওয়ামী লীগ একটি কাউন্সিল করলেও নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে তেমন অগ্রগতি হয়নি।

৭৩ সদস্যের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটিতে সভাপতিসহ মাত্র ৯ জন নারী আছেন। আগামী কমিটির সদস্যসংখ্যা ৮১ হলে নারী সদস্যসংখ্যা ২৭ হওয়ার কথা। আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, তাঁরা কোনো চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় পান না এবং মেয়াদের আগেই এমডিজি অর্জন করেছেন। শিক্ষার হার বাড়িয়েছেন। আশা করি, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের চ্যালেঞ্জটিও তাঁরা এই কাউন্সিলে গ্রহণ করবেন।

একই সঙ্গে সামনে আসছে ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বের বিষয়টিও। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ জাতীয় সংসদের ৩০০ সাধারণ আসনের মধ্যে ৬০টি তাদের জন্য সংরক্ষণ করার দাবি জানিয়েছে। সেটি হবে অভিন্ন নির্বাচন পদ্ধতিতে, পৃথক নির্বাচনের মাধ্যমে নয়। জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি ক্ষমতায় এলে শতকরা ১০টি, অর্থাৎ ৩০টি আসন সংখ্যালঘুদের জন্য ছেড়ে দেবেন। বিএনপি এখনো কোনো মন্তব্য করেনি। এই দাবির বিষয়ে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে কী সিদ্ধান্ত হয়, তা জানার জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সাগ্রহে অপেক্ষা করবে।

আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে ২০৪১ সাল পর্যন্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সংযোজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। কিন্তু আগের কাউন্সিলে ২০২১ সাল পর্যন্ত যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ তথা রূপকল্প নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো বাস্তবায়নে কী অগ্রগতি হয়েছে বা হয়নি, সেটিও যাচাই করে দেখা প্রয়োজন।
অন্যথায় নেতাদের কথা ও কাজের ফারাক বাড়তেই থাকবে। প্রথম আলো

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে