সোমবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ০৬:২৫:৫৪

নেতৃত্বে জাহিদের স্ত্রী, নতুন চ্যালেঞ্জ নারী জঙ্গি

নেতৃত্বে জাহিদের স্ত্রী, নতুন চ্যালেঞ্জ নারী জঙ্গি

সরোয়ার আলম : জঙ্গিদের নারী ইউনিট সংগঠিত করছেন জেবুন্নাহার শিলা; যিনি মিরপুরের রূপনগরে নিহত নব্য জেএমবির সামরিক প্রশিক্ষক মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী। স্বামীর কাছেই জঙ্গিবাদের দীক্ষা পেয়েছেন শিলা। পুলিশের অভিযানে স্বামী নিহত হওয়ার পর দুই সন্তানসহ পালিয়ে আস্তানা গেড়েছিলেন আজিমপুরে। সেখানে পুলিশ হানা দেওয়ার চার দিন আগেই এক সন্তান নিয়ে সটকে পড়েছেন তিনি। কিন্তু ধরা পড়েছেন তার তিন সহযোগী, যাঁরা দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের স্ত্রী।

গ্রেপ্তার হওয়া ওই তিনজন হলেন—গুলশান হামলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড নুরুল ইসলাম মারজানের স্ত্রী আফজান ওরফে প্রিয়তি, জঙ্গি বাশারুল্লাহ ওরফে চকলেট ওরফে রাহুলের স্ত্রী শায়লা আফরিন ওরফে আফরা এবং অভিযানে নিহত জঙ্গি করিম ওরফে শমসের উদ্দিন ওরফে জামশেদ ওরফে তানভীর কাদেরীর স্ত্রী শারমিন ওরফে রুহমা। শনিবার রাতে পুলিশ আজিমপুরে তাদের আস্তানায় অভিযান চালাতে গেলে তারা পুলিশের ওপর হামলাও চালিয়েছিলেন।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) জিজ্ঞাসাবাদ এবং অনুসন্ধানে ওই তিন নারীর জঙ্গি সম্পৃক্ততার তথ্য মিলেছে। গ্রেপ্তারকৃত তিন নারীর মাধ্যমে পলাতক শিলাসহ জঙ্গিদের নারী ইউনিটের কর্মকাণ্ড জানার চেষ্টা করছে গোয়েন্দারা।

পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘পলাতক জঙ্গিদের ধরতে অভিযান বেগবান করা হয়েছে। রূপনগরে নিহত জাহিদুলের স্ত্রী শিলা নারী জঙ্গিদের সংগঠিত করছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। আজিমপুরে পুলিশের অভিযানের সময় যে জঙ্গি মারা গেছে, সে আত্মঘাতী। তার সহযোগীদের ধরতে অভিযান চলছে।’

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘জাহিদুলের স্ত্রী জেবুন্নেছা শিলা ওই আস্তানা থেকে এক শিশু সন্তান নিয়ে পালিয়ে গেছে। তার বড় মেয়েকে সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। সে আমাদের এ তথ্য জানায়। তবে আহতদের মধ্যে একজন জঙ্গি মারজানের স্ত্রী। অন্যজন আরেক জঙ্গির স্ত্রী।’

সূত্র জানায়, গত জানুয়ারি মাসে মারজান তার খালাতো বোন প্রিয়তিকে বিয়ে করেন। তার বাড়ি পাবনার ঈশ্বরদীর দাপুনিয়া ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামে। মারজানের বাড়িও পাবনার হেমায়েতপুরের আফুরিয়া গ্রামে। আরেক নারী জঙ্গি শায়লা আফরিন ওরফে আফরার বাড়ি রাজধানীতেই। আস্তানা থেকে উদ্ধার হওয়া তিন শিশুর একটি তার সন্তান। অন্য নারী জঙ্গি শারমিন ওরফে রুহমা। তাঁর দুই যমজ ছেলের মধ্যে একজনকে পুলিশ ওই বাসা থেকে উদ্ধার করে। উদ্ধার হওয়া শিশুটি ধানমণ্ডির ইংরেজি স্কুল মাস্টারমাইন্ডের লেভেল এইটের ছাত্র।

গোয়েন্দা পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, আজিমপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে উদ্ধার হওয়া তিন শিশুকেই তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। মিরপুরের রূপনগরে নিহত জঙ্গি জাহিদের বাবা মমিনুল হকসহ স্বজনরা গতকাল বিকেলে তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে জাহিদের শিশুকন্যাকে দেখতে যান। এদিকে গ্রেপ্তার তিন নারী জঙ্গিকে গতকাল জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন কয়েকজন কর্মকর্তা। তাতে দুজন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন।

অন্যদিকে শনিবার রাতে আজিমপুরে পুলিশের অভিযানের সময় যে যুবকের লাশ উদ্ধার হয়েছে তিনি গলায় ছুরি চালিয়ে ও বোমা ফাটিয়ে ‘আত্মহত্যা’ করেছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। লাশের ময়নাতদন্তকালে মিলেছে এ-সংক্রান্ত আলামত। নারী জঙ্গিদের সঙ্গে থাকা এই ব্যক্তির পরিচয় নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা কাটেনি। তবে প্রাথমিক তথ্য মতে, তিনি রাজশাহীর বোয়ালিয়ার জঙ্গি নেতা শমসের উদ্দিন। এম এ করিম তার সাংগঠনিক নাম। একসময় জেএমবির সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইয়ের অনুসারী শমসের পরে নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন।

উদ্বেগ নারী জঙ্গি নিয়ে : গোয়েন্দা তথ্য মতে, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ, এবিটি ও হিযবুত তাহ্রীরের মহিলা সদস্যরা ইসলামের দাওয়াতের নামে কর্মী সংগ্রহ করছেন। শিশুসহ তারা দাওয়াতি কার্যক্রমের পাশাপাশি জঙ্গি আস্তানায় অবস্থান করায় পুলিশের নজর এড়িয়ে গেছেন বারবার। সম্প্রতি কয়েকজন নারী গ্রেপ্তারের পর এই নারী জঙ্গি নেটওয়ার্কের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা স্বামী ও স্বজনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন বলে তথ্য মিলছে। এ নেটওয়ার্কে উচ্চশিক্ষিত ও স্মার্ট অনেক নারী যুক্ত রয়েছেন বলেও জানা গেছে।

আত্মঘাতী শমসের : নিউ জেএমবির কিছু সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ জেনেছে, শমসের নামের তাদের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা রয়েছেন। শনিবার রাতে আজিমপুরে অভিযান চালানোর সময় পুলিশ যে যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে তিনিই শমসের বলে পুলিশ প্রাথমিক তথ্যে জেনেছে। গতকাল সকালে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) সূত্র ধরে পুলিশ আজিমপুরে জঙ্গি আস্তানায় পাওয়া লাশের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করে। এনআইডি অনুসারে তার নাম মো. শমসের উদ্দিন, বাবার নাম মোসলেহ উদ্দিন। গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর বোয়ালিয়ায়।

এনআইডি নম্বর-৮১৯২২২৬৩৩৯১৫৩। এডিসি ছানোয়ার হোসেন জানান, শমসেরের সাংগঠনিক নাম আবদুল করিম। তিনি বোয়ালিয়ায় বেশি থাকেননি, পড়ালেখা করেছেন ঢাকায়। তাঁর বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। ওদিকে আরএমপির এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, এনআইডিতে যে ঠিকানা রয়েছে সেখানে গিয়ে শমসের নামের কাউকে পাওয়া যায়নি। এলাকার লোকজনও তাঁর সম্পর্কে বলতে পারছে না।

পুলিশ জানিয়েছে, আজিমপুরে বাড়ির মালিককে জামশেদ নামে পরিচয় দিয়েছিলেন নিহত ব্যক্তি। বাড়ির মালিক পুলিশকে জানিয়েছেন, পুলিশের দেওয়া ভাড়াটিয়া তথ্য ফরম পূরণ করেছিলেন জামশেদ। পরে ওই ফরমটি থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিহত জঙ্গি বাসাটি ভাড়া নিয়েছিল। আমাদের হেফাজতে থাকা তার ছেলেও একই রকম তথ্য দিয়েছে।’

কাউন্টার টেররিজম বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার ছানোয়ার হোসেন বলেন, আত্মঘাতী হামলায় শমসের মারা গেছেন। তার নেতৃত্বেই নারী জঙ্গিরা পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছিলেন। এরই এক পর্যায়ে তিনি গলায় ছুরি চালিয়ে ও বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মারা গেছেন। দুর্ধর্ষ জঙ্গি শমসের গুলশানের হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ার জঙ্গি হামলায় জড়িত ছিলেন বলে জানা গেছে।

গতকাল বিকেল ৪টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে শমসেরের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ঢামেকের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডাক্তার সোহেল মাহমুদ জানান, লাশের গলায় ধারালো কাটা জখম রয়েছে। তার ডান হাতে বোমার স্প্লিন্টার পাওয়া গেছে। এ ছাড়া শরীরের বিভিন্ন স্থানে পাঁচটি জখমের চিহ্ন আছে। তাতে বোঝা যায়, আত্মঘাতী হামলায় তার মৃত্যু হয়েছে। - কালেরকণ্ঠ

১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে