রুদ্র মিজান : ঈদ নেই। আছে অসহ্য যন্ত্রণা। শরীরজুড়ে সেলাই, ব্যান্ডেজ। হাসপাতালের শয্যায় কাতরাচ্ছেন তারা। ঈদের আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়েছে তাদের পরিবারের সদস্যদেরও। প্রত্যেক অসুস্থ স্বজনের পাশে বসে আছেন তার পরিবারের অন্তত একজন সদস্য। বদলি দিচ্ছেন। একজনের পর আরেকজন। এভাবেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন টঙ্গীর বিসিক শিল্প নগরীর ট্যাম্পাকো ট্র্যাজেডিতে আহতরা।
এ ঘটনার পর এখনও ঢামেকে চিকিৎসাধীন ৯ জন। তাদের মধ্যে একজন মোহাম্মদ রোকন। গতকাল বিকালে হাসপাতালের শয্যায় বসে ছিলেন রোকন। পাশে অসহায়ভাবে গালে হাত দিয়ে ছিলেন তার স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা। রোকনের পুরো শরীরজুড়ে কাটা-ছেঁড়ার দাগ। মাথায় অনেকগুলো সেলাই। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতে নিষেধ করেছেন চিকিৎসক। তার স্ত্রী রাজিয়া জানান, মাথায় ৯২টি সেলাই রয়েছে। শরীরে ব্যথা হয়। ঘুম হয় না। ছটফট করে। এই বিপদে ঈদ কিসের। ঈদের দিনও মনে হয়নি আজ ঈদ। রোকনের সঙ্গে রাত জাগেন তিনিও। তবু স্বামীকে জীবিত পেয়ে খুশি তিনি।
ট্যাম্পাকো কারখানায় ৯ বছর যাবৎ ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে কাজ করতেন রোকন। তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময় নিজে থেকেই ঘটনার সময়ের বর্ণনা দেন রোকন। তিনি জানান, সকালে কারখানার নিচ তলায় ঢুকেছেন মাত্র। এর মধ্যেই বিকট শব্দ হলো। এর আগে কখনও এরকম শব্দ শুনেননি তিনি। সঙ্গে সঙ্গে বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়ছিল। রোকন নিচে পড়ে যান। তার মাথা ফেটে রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। তখনই ভবনের পূর্বদিকের দেয়াল ভেঙ্গে পড়ে। আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে ভাঙ্গা দেয়ালের দিক থেকে বের হন তিনি। আসেন রাস্তায়। তারপর আর কিছু মনে নেই।
তার স্ত্রী রাজিয়া জানান, সেখান থেকে একজন রিকশাচালক রোকনকে টঙ্গি হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। ঘটনার দিনই ঈদ উপলক্ষে বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল রোকনের। কথা ছিল বেলা ২টায় কারখানা থেকে বের হয়ে সদরঘাটে পৌঁছাবেন। সন্ধ্যা ৭টার দিকে লঞ্চে করে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। মা, বাবা, স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে ঈদ করার ইচ্ছে ছিল তার। হাসপাতালের খাবার মুখে নিতে পারেন না। তরল জাতীয় খাবর খেতে হয়। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে গ্রাম থেকে তার মা-বাবা, স্ত্রী ও সন্তান ছুটে আসেন ঢাকায়। গতকালও হাসপাতালে ছিলেন স্ত্রী ও তার তিন বছর বয়সী ছোট ছেলে জুনায়েদ। দুই ছেলের জনক রোকন। তার বাড়ি বরিশালের গৌড়নদী উপজেলার কান্তপাশ গ্রামে।
একই অবস্থা কারখানার লাইনম্যান আনোয়ার আলমের। পালা করে তার পাশে থাকছেন স্ত্রী, সন্তান ও ভাগ্নে। গতকাল বিকালে ভেজা গামছা দিয়ে আনোয়ারের শরীর মুছে দিচ্ছিলেন তার ভাগ্নে ফরিদ। ফরিদ জানান আনোয়ার আলমের স্ত্রী-সন্তানরা এতদিন হাসপাতালে ছিলেন। হাসপাতালের পরিবেশের কারণে তারা নিজেরাই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আনোয়ার আলমের পুরো শরীরে কাটা দাগ। মাথায় অসংখ্য সেলাই। ফরিদ জানান, ঈদের আগের এই ঘটনা পরিবারে খুশির বদলে বিষাদের জন্ম দিয়েছে। ঈদের দিন হাসপাতালে ভালো খাবার দিলেও এসব রোগীর ভাগ্যে তা জুটেনি। কারণ তারা তরল খাবার ছাড়া কিছু খেতে পারেন না।
আনোয়ার জানান, ঘটনার দিন রাতের ডিউটি শেষে বের হচ্ছিলেন আনোয়ার। গেট থেকে বের হওয়ার আগেই বিস্ফোরণটি ঘটে। তিনি অন্তত ১০-১৫ হাত দূরে ছিটকে পড়েন। তারপর আর কিছুই মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরে তখন তিনি হাসপাতালে। দুই ছেলে ও স্ত্রী জোছনা বেগমকে নিয়ে টঙ্গীর কলেজ গেট এলাকায় থাকতেন আনোয়ার। তার গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলা সদরের আলীপুরে।
নাকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে আমিনুল হক মিজুকে। এখন পর্যন্ত কথা বলতে পারেন না তিনি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মাথায় আঘাত পেয়েছেন মিজু। আট মাস যাবৎ ওই কারখানায় কাজ করতেন তিনি। ঘটনার পর টিভিতে খবর দেখে ঢাকায় ছুটে এসেছেন মিজুর ভাই-বোন। গতকাল হাসপাতালে তার পাশে বসা ছিলেন দুই বোন। আমিনুল হক মিজুর বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজারের আঙ্গুরা গ্রামে।
মাথায় ও হাতে আঘাত পেয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন মীর শিপন। ট্যাম্পাকো কারখানার প্রিন্টিং বিভাগে কাজ করতেন তিনি। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে থাকতেন কারখানার পাশের একটি এলাকায়। ঘটনার পর থেকে হাসপাতালে তার সঙ্গে রয়েছেন স্ত্রী আবিদা সুলতানা। আবিদা বলেন, এবার ঈদ আমাদের জন্য আসেনি। ঈদের কোন খাবার আমাদের পেটে যায়নি। আমাদের সকল আনন্দ কেড়ে নিয়েছে এই দুর্ঘটনা। মীর শিপনের বাড়ি মাগুরা জেলার শ্রীপুর থানার আমতৈল গ্রামে। এ ছাড়াও হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন জাহাঙ্গীর, জাকির হোসেন, ফেরদৌস ও প্রাণকৃষ্ণ। তাদের মধ্যে জাহাঙ্গীরের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানান।
গত ১০ই সেপ্টেম্বর গাজীপুরের টঙ্গীর ট্যাম্পাকো কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ৩৫ জন নিহত হয়েছেন। নিখোঁজও রয়েছেন বেশ কয়েকজন। এমজমিন
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি