শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া : বাসের ভেতর দুই পাশে অতি মূল্যবান যে কয়েকটি কথা লেখা থাকে, এর মধ্যে একটি হচ্ছে—সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি। লেখা থাকে বটে, কিন্তু সজ্ঞানে তা মেনে চলার মতো মানুষ নেই বললেই চলে। সড়কপথে একই দিকে ছুটে চলা যাত্রীবাহী বাসগুলোর চালকদের পরস্পরকে অতিক্রম করার মরণপণ লড়াইয়ে এর প্রমাণ মেলে।
রাজধানীতে ‘মুড়ির টিন’ বলে পরিচিত সমগোত্রীয় মিনিবাসগুলো যখন একই গন্তব্যের দিকে যাওয়ার পথে কাছাকাছি অবস্থান করে, এ সময় যেন আসুরিক ক্ষমতা ভর করে চালকদের মধ্যে। কে কাকে ছাড়াবে, এই নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এ সময় তাঁদের নিবৃত্ত হতে যাত্রীরা গলা ফাটালেও অনেক চালক আমল দেন না; বরং সহকারী সোৎসাহে বাসের গায়ে সজোরে চাপড় দিয়ে তাঁর ওস্তাদকে উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করেন।
এই ভয়ংকর প্রতিযোগিতার পরিণতি যে কতটা মারাত্মক হতে পারে, তা আমরা অনেক দেখেছি। এখানে জীবন বা সময়ের মূল্য কোনোটাই আসলে বিবেচ্য নয়। এখানে চালক হিসেবে বাহাদুরি প্রদর্শনই মুখ্য হয়ে ওঠে। গাড়ি চালনার ক্ষেত্রে প্রধান বিষয় হচ্ছে সংযম ও ধৈর্য। কিছুতেই অসহিষ্ণু হওয়া যাবে না। যানজট যতই থাকুক, গন্তব্যে যাওয়ার তাড়া যতই থাকুক, মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। ঈদের ছুটিতে রাজধানী বা মহাসড়ক যখন প্রায় ফাঁকা থাকে, তখন অনেক চালকই গাড়িটাকে হাওয়াই পঙ্খি বানিয়ে পূর্ণ গতিতে ছোটান। দুর্ঘটনার বিষয়টি যেন মাথায়ই থাকে না। পরিণতিতে ঘটে শেওড়াপাড়ায় প্রাইভেট কারের ধাক্কায় বয়স্ক দম্পতি নিহত হওয়ার মতো দুর্ঘটনা। ঈদের ছুটির আমেজ এখনো শেষ হয়নি, এর মধ্যে আজ শনিবার পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় বৃদ্ধ দম্পতিসহ এ পর্যন্ত ২৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। আজ মির্জাপুরে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে নিহত হয়েছে দুজন।
গতকাল শুক্রবার টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে বেপরোয়া গতির একটি বাস উল্টে নিহত হয়েছে পাঁচজন। টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু সড়কে এ ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রামের পটিয়ায় মিনিবাসের সঙ্গে সংঘর্ষে মাইক্রোবাসের চালক নিহত হয়েছেন। আগের দিন চারটি জেলায় পৃথক দুর্ঘটনায় নিহত হয় চারজন।
গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাস ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ঝরে গেছে আটটি প্রাণ। মাইক্রোবাসটি বরযাত্রীদের নিয়ে যাচ্ছিল। দুর্ঘটনায় নিহত আটজনের মধ্যে বর ও তাঁর দুই ভাই রয়েছেন। একটি বিয়েবাড়িতে আনন্দময় উৎসবে আচমকা বরসহ তিন ভাই নিহত হওয়ার ঘটনা যে কতটা বেদনাদায়ক, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ওই তিনটি ভাই-ই ছিলেন তাঁরা। স্বজনেরা এখন শোকে মাতম করছেন ঠিকই। ভবিষ্যতে দেখা যাবে, ওই বাড়িতে সান্ধ্য আলো জ্বালার মতো লোকও নেই। এ কথা কল্পনা করলেই তো মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়।
আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে মাদারীপুরের রাজৈরে। সেখানে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাস ও মাহিন্দ্র বলে পরিচিত স্থানীয় যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়।
যে দুর্ঘটনাগুলোর কথা এখানে উল্লেখ করা হলো, বোঝাই যায়, ফাঁকা রাস্তায় গাড়িগুলো বেপরোয়া গতিতে ছুটছিল। টাঙ্গাইলে দুর্ঘটনা ঘটে স্থানীয় একটি যানকে ওই যাত্রীবাহী বাস অতিক্রম করার সময়। তাল সামলাতে না পেরে বাসটি উল্টে যায়। আর বাস ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষের ক্ষেত্রেও ছিল বেপরোয়া গতির কারণে চালকদের নিয়ন্ত্রণহীনতা।
আজকাল ব্যাপারটা এমন হয়ে গেছে যে স্টিয়ারিং হুইল ধরে কয়েকটা দিন বসে থাকতে পারলেই চালক হওয়া যায়। ট্রাক-বাসের চালকের সহকারীরা কয়েকটা দিন চালকের জায়গা প্রক্সি দিয়ে দিব্যি চালক বনে যাচ্ছেন। চালক হতে যে মন-মেজাজ ও যোগ্যতা প্রয়োজন, তা অনেকেরই নেই। বয়সের বাছবিচার নেই। ঢাকা শহরে গণপরিবহন হিসেবে যেসব টেম্পো ও হিউম্যান হলার ব্যবহৃত হচ্ছে, অনেক যানেরই চালক দেখা যায় ১৩ থেকে ১৪ বছরের কিশোর। তারা যানবাহনে ব্যস্ত সড়কে প্রচণ্ড গতিতে এঁকেবেঁকে যানটি নিয়ে যায়, প্রাণটা তখন কচুপাতার পানির মতো টলমল করে। একযাত্রায় গন্তব্যে পৌঁছালে মনে হয়, আয়ুটা বোনাস পাওয়া গেল!
মহাসড়কগুলোতে দূরপাল্লার বাস যাঁরা চালান, তাঁদের ক্ষেত্রে বিশ্রাম একটি বড় বিষয়। এসব সড়কে অনেক চালক প্রতি ট্রিপ অনুযায়ী টাকা পান। এ ক্ষেত্রে যে যত বেশি ট্রিপ মারবেন, তাঁর তত টাকা। টাকার দিকে তাকিয়ে অনেক চালক নাওয়া-খাওয়া হারাম করেন। টানা বেশ কয়েক ঘণ্টা না ঘুমিয়ে গাড়ি চালানোর সময় তাঁর টের পান না কোন ফাঁকে ঘুম এসে গেল। আর তক্ষুনি দুর্ঘটনা ঘটে। অনেক সময় ভালো চালকের ওপর কর্তৃপক্ষের চাপ বেশি থাকে। আস্থাটা ধরে রাখতে চালক ক্লান্তিকে পাত্তাই দেন না। কিন্তু শরীর তো সেই ইঞ্জিনের মতোই। ইঞ্জিন বেশি গরম হলে যেমন বিশ্রাম দিতে হয়, শরীরেরও চাই একটুখানি আরাম। নইলে হিতে বিপরীত ঘটবেই।
বলা হয়ে থাকে, একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। এই কান্না যে কেমন কান্না, এর কঠিন ভুক্তভোগী আমার পরিবার। আমার বাবা যখন সড়ক দুর্ঘটনা মারা যান, তখন চার শিশুসন্তান নিয়ে অথই সাগরে পড়েছিলেন আমার মা। আমি সবার বড়। ওই সময় আমার বয়স ছিল মাত্র সাত বছর। আর সবার ছোট যে বোনটি, তার বয়স ছিল ছয় মাস। এই ছোট ছোট চার সন্তানকে আমার মা কীভাবে যে বড় করেছেন, তা এখনো আমার কাছে অত্যাশ্চর্য বিষয়।
একটি দুর্ঘটনা কেবল একটি প্রাণই যে ছিনিয়ে নেয়, তা নয়, গোটা পরিবারের সব মানুষের প্রাণকে নিদারুণ এক সংকটে ফেলে দেয়। এই সংকটে লন্ডভন্ড হয়ে যেতে পারে একটি পরিবার। কাজেই সড়ক-মহাসড়কে যাঁরা গাড়ি চালনার সঙ্গে জড়িত, সবাইকে এই বিষয়টি খুব ভালোভাবেই মাথায় রাখা উচিত।-প্রথম আলো
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাংবাদিক
১৭ সেপ্টেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর