রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ০১:৩৩:৩৬

‘জিয়ার মাজার সরিয়ে দিলে অক্ষম বিএনপি কী করবে’

‘জিয়ার মাজার সরিয়ে দিলে অক্ষম বিএনপি কী করবে’

কাজী সিরাজ : বিএনপির ‘বিপ্লবী কুস্তিগীররা’ দলের ভদ্রলোকদের বিরুদ্ধে কুস্তি লড়তে পারেন, কিন্তু দলবিরোধীদের বিরুদ্ধে মাঠে নামতেই ভয় পান। দলের সর্বজনস্বীকৃত ক্যারিয়ার রাজনীতিবিদদের ঘাড় ধরে মাথাটা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে অপদস্থ করতে পারেন, কিন্তু দলের রাজনীতি ও আদর্শবিনাশী শক্তির ভয়ে গর্তে ডুবে লুকিয়ে থাকেন।

সরকার বা অন্য কোনো বিদেশি সেবাদাস যখন রাজনৈতিক স্বার্থকেন্দ্রিক কৌশলগত বিবেচনায় বিএনপির কলিজায় হাত দিয়ে ফেলে, তখনো দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ পন্থায় অর্জিত বিপুল অর্থ-বিত্ত-বৈভবের মায়ায় বিএনপি দখলদাররা অপস্বার্থ চিন্তায় ও আত্মস্বার্থরক্ষার স্বার্থে পলায়নী মনোভাব নিয়ে ‘চোরাপথ’ হাতরায়।  প্রসঙ্গক্রমে একটি ঐতিহাসিক উক্তি উল্লেখ করছি— A leader is one who knows the awy, goes the awy and shows the awy. বাংলায় বোধ হয় এভাবেই বললে চলে যে, তিনিই প্রকৃত নেতা যিনি সঠিক পথ চেনেন, সঠিক পথে চলেন এবং অন্যদের সঠিক পথ দেখান।

একদা বেগম খালেদা জিয়া প্রবীণ ও পোড়খাওয়া সহকর্মী বিচারপতি আবদুস সাত্তার, মির্জা গোলাম হাফিজ, অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, এস. এ. বারী এটি, ব্যারিস্টার আবদুস সালাম তালুকদার, মেজর জেনারেল (অব.) মাজেদুল হক, কর্নেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমান, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল হালিম চৌধুরী, কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে সঠিক পথে চলেছেন পথ চিনে, দলের সবাইকে পরিচালিত করেছেন সঠিক পথে। পরামর্শ করেছেন অভিজ্ঞ সঙ্গীদের সঙ্গে, পরামর্শ নিয়েছেন অভিজ্ঞজনদের। তাই ভুল কম হয়েছে। শহীদ জিয়ার আলোয় উদ্ভাসিত খালেদা জিয়া সাফল্যও অর্জন করেছেন রাজনীতিতে।

প্রবীণ সহকর্মী যাদের নাম উল্লেখ করেছি, একজন ছাড়া বাকিদের কেউ বেঁচে নেই। জীবিতজন অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে অপমানিত-লাঞ্ছিত করে দল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তিনি ছিলেন দলের প্রথম মহাসচিব এবং দলীয় মনোনয়নে দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট— রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি। জীবদ্দশায় দলে প্রায় একযুগের সফল মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়াকে কোনো প্রকার কারণ দর্শানোর নোটিস বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ প্রদান ছাড়াই বহিষ্কার করে দেওয়া হয় দলকে দুর্নীতিবাজমুক্ত ও পরিশীলিত করার উদ্দেশ্যে সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপনের অপরাধে। দলের দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র এবং নানা জানা কারণে যাদের সম্পর্কে পাবলিক পারসেপশন খুব খারাপ, তখন তাদের কি উল্লাস নৃত্য দেখেছে দলের প্রগতিশীল গণতন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুসারীরা ও দেশবাসী।

দলের ভিতর সংস্কার প্রস্তাবের সমর্থক সৎ ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নীরব কান্না আর হৃদয়ের রক্তক্ষরণ তখন কোনো ধরনের বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ বেগম জিয়াকে দেয়নি উল্লিখিত অপরাধী চক্র। এসব অবিবেচনাপ্রসূত আত্মঘাতী কাজের প্রায়শ্চিত্ত এখনো করে চলেছে বিএনপি। একজন বদরুদ্দোজা চৌধুরী, একজন মান্নান ভূঁইয়ার যে কি প্রয়োজন ছিল বিএনপিতে, সংস্কারের মাধ্যমে দলকে দুর্বৃত্তায়নমুক্ত করা যে কত জরুরি ছিল, যাদের তা বোঝার ক্ষমতা আছে দলের তারা তা বুঝছেন, টের পাচ্ছেন হাড়ে হাড়ে। বিএনপি এখন মাজা সোজা করে দাঁড়াতেই পারে না। এখনো এত বিপুল জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও তা ক্যাশ করতে অক্ষম বিএনপি। সংগঠন দুর্বল হলে, নেতৃত্ব মানহীন ও বিপথগামী হলে জনসমর্থন কোনো কাজে আসে না।

আমাদের প্রতিবেশী দেশের দিকে তাকালেই প্রমাণ মেলে। অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস এখনো সারা ভারতে একটি জনপ্রিয় দল, অথচ কী দুর্ভাগ্য, ৫৫৪ আসনের লোকসভায় ৫৪টি আসন নিয়ে সংসদীয় বিরোধী দলের মর্যাদাও আদায় করতে পারেনি দলটি। কংগ্রেসপ্রেমী, কংগ্রেস অনুরাগী অনেকেই নাকি সে দেশে এমন মন্তব্য করে থাকেন যে, ‘পোলার মুতে আছাড় খেয়েই’ সোনিয়া গান্ধী নিজের ও দলের এমন সর্বনাশ অনিবার্য করেছেন। অথচ অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, কংগ্রেসের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত অধঃপতনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে দেশের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির সৌরভ।

বাংলাদেশেও বিএনপির বর্তমান ভঙ্গুর দশায় বেগম খালেদা জিয়া বা সাংগঠনিকভাবে বিএনপিই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ, ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে রাষ্ট্রের ওপর সব নাগরিকের মালিকানার অধিকার, বাড়ছে জনগণের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। বিএনপির জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে প্রতিপক্ষ নানা সমালোচনা করে। এটা স্রেফ রাজনৈতিক সুবিধা লাভের একটি হাস্যকর ও নোংরা প্রক্রিয়া। সত্য কথা হচ্ছে, দলটির জন্ম হয়েছে সময়ের দাবিতে, কালের চাহিদায়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সুপরিকল্পিতভাবে বাকশাল গঠনের পর এদেশে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ এবং আধিপত্যবাদবিরোধী একটি দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী দল গঠন ছিল প্রকৃতই সময়ের দাবি। এটা হতোই।

বিএনপি নামে না হয়ে হয়তো অন্য কোনো নামে হতো। জিয়া না হয়ে হয়তো অন্য কোনো সাহসী দেশপ্রেমিক বীর হতেন সে দলের প্রতিষ্ঠাতা। ভাগ্যের বরপুত্র জিয়াই হয়ে গেলেন দলটির প্রতিষ্ঠাতা, দলটি বিএনপি। যে ঐতিহাসিক কারণে ও চাহিদায় জাতীয় গণআকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে জন্ম নিয়েছিল বিএনপি, সেই কারণ, সেই চাহিদা এখনো বিদ্যমান বলেই মনে করেন রাজনৈতিক অনেক বিশ্লেষক। কিন্তু দলটি সে চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। বিএনপির আগে জাসদের জন্ম হয় এবং বেশ জনপ্রিয়তাও পায়। কিন্তু একই ‘কেবলার’ অনুসারী হিসেবে পরিচিত এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের সশস্ত্র হঠকারী রাজনৈতিক লাইন জাসদকে জাতির কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক শক্তির অবস্থান দেয়নি বলেই বিএনপি অতি দ্রুত মানুষের হৃদয়ে আসন গেড়ে নেয়।

এ আসন কারও জন্য কখনো চিরস্থায়ী হয় না। ভুল করলেই পতন অনিবার্য। ছুড়ে ফেলে জনগণ। বিএনপি নেতৃত্বের (যারা এখন দলকে নিজেদের মালিকানাধীন সম্পত্তি মনে করেন) যদি আত্মোপলব্ধি না হয়, আমূল সংস্কারের মাধ্যমে দলের অবয়বে জনগণের কাঙ্ক্ষিত ও সময়ের চাহিদা অনুযায়ী পরিবর্তন না আনেন, ‘আধুনিক মুসলিম লীগ’ থেকে দলকে আবার জিয়ার বিএনপিতে ফেরত না নেন, তাহলে জনগণ ও সময় খালেদা-তারেক বিএনপির ভরসায় বসে থাকবে তেমন ভাবা বোকামি হবে। সময়ের চাহিদা, কালের দাবিতে আবার হয়তো গড়ে উঠবে নতুন আরেক বিস্ময়শক্তির; নতুন নামে নতুন কোনো দল। - বিডি প্রতিদিন
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে