আহমদুল হাসান আসিক : নতুন করে ‘আত্মঘাতী সেল’ তৈরি করে বড় ধরনের হামলার মিশন নিয়ে কাজ করছিল জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) নতুন ধারার (নিউ জেএমবি) অন্তর্বর্তীকালীন সমন্বয়ক তানভির কাদেরি ওরফে আবদুল করিম।
গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর নিউ জেএমবির ‘আত্মঘাতী সেলের’ অন্তত ১৫ জন জঙ্গি আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহত হওয়ার পর সংগঠনে কর্মী সংকট দেখা দেয়। তাছাড়া গত মাসে ‘আত্মঘাতী সেলের’ আরও পাঁচ জঙ্গি পুলিশের একটি বিশেষ শাখার হাতে ধরা পড়েছে। এ কারণে এ সেলের মাধ্যমে এখন বড় ধরনের হামলার সক্ষমতা নেই নিউ জেএমবির।
নারায়ণগঞ্জে পুলিশের অভিযানে নিউ জেএমবির সমন্বয়ক তামিম আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর সংগঠনের দায়িত্ব নিয়ে বড় হামলার পরিকল্পনা করে করিম। রাজধানীর একটি আস্তানায় ‘আত্মঘাতী সেলের’ সদস্যদের প্রশিক্ষণও দেয়া হচ্ছিল। বড় হামলার সক্ষমতা অর্জনের আগে টার্গেট কিলিংয়ের পরিকল্পনা ছিল করিমের। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নরসিংদীর মাধবদীতে মন্দিরের এক তত্ত্বাবধায়কের ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। ঢাকা মহানগর পুলিশের বিশেষ শাখা কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট এবং ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্র এসব তথ্য জানায়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. দিদার আহমেদ বলেন, সম্প্রতি কয়েকটি সফল অভিযানে নিউ জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ নেতা নিহত হওয়ার পর সংগঠনের দায়িত্ব নেয় আবদুল করিম। সে নতুন করে ‘আত্মঘাতী সেল’ তৈরি করে আবারও বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা করছিল।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নিউ জেএমবির নেটওয়ার্ক পুরোপুরি ভেঙে পড়ার পর জঙ্গিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। সংগঠনের নিুস্তরের কর্মীদের চাঙা করতে আবারও টার্গেট কিলিংয়ের মিশন বাস্তবায়ন করা চেষ্টা করছিল। আগস্টের শেষ দিকে নরসিংদীর মাধবদীতে চিত্তরঞ্জন আর্য্য নামে এক মন্দিরের তত্ত্বাবধায়কের ওপর হামলাও চালিয়েছিল তারা। বড় ধরনের হামলার সক্ষমতা অর্জন করার পূর্ব পর্যন্ত তারা বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর হামলার মিশন বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছিল। নতুন করে ‘আত্মঘাতী সেল’ প্রস্তুত হওয়া পর্যন্ত তারা ছোট ছোট টার্গেটে এগোনোর পরিকল্পনা ছিল তাদের। এর মাস্টারমাইন্ড ছিল জঙ্গি করিম।
এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও ‘আত্মঘাতী সেলের’ সদস্যদের প্রশিক্ষণের মূল দায়িত্বে ছিল রূপনগরে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম। পুরান ঢাকার কোনো একটি আস্তানায় জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেয়ার তথ্যও পাওয়া গেছে। ওই আস্তানাটি খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরের আস্তানায় অভিযানের পর সেখান থেকে উদ্ধার হওয়া চারটি ভাঙা ল্যাপটপ, একটি পেনড্রাইভ ও মেজর (অব.) জাহিদের ডায়েরি থেকে সংগঠনের নানা পরিকল্পনার বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। তাছাড়া আস্তানা থেকে আহত অবস্থায় তিন শীর্ষ জঙ্গির স্ত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেও তাদের পরিকল্পনার কথা জানা গেছে।
তাদের দেয়া তথ্যে জানা গেছে, তামিম চৌধুরীর মৃত্যুর পর সংগঠনে অর্থ সংকট দেখা দেয়। ‘আত্মঘাতী সেলের’ সদস্যদের বিভিন্ন আস্তানায় রেখে প্রশিক্ষণ দেয়া, তাদের ভরণ-পোষণ এবং অস্ত্র কেনার সামর্থ্য নেই নিউ জেএমবির। এ কারণে করিম ব্যাংক ডাকাতি এবং ছিনতাইয়ের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করার পরিকল্পনাও করছিল। আজিমপুরে অভিযানের সময় জঙ্গি করিম গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করে। ওই আস্তানা থেকে তার ১৪ বছর বয়সী ছেলে তাহরীম কাদেরি ওরফে রাসেলকেও গ্রেফতার করে পুলিশ।
গোয়েন্দারা বলছেন, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) ‘স্লিপার সেলের’ ধারণা থেকেই তামিম চৌধুরী আরও ভয়ংকর ‘সুইসাইডাল স্কোয়াড’ বা ‘আত্মঘাতী সেল’ তৈরি করে। ‘স্লিপার সেল’ গঠন করে এবিটি গত ৩ বছরে একের পর এক গুপ্তহত্যার মিশন বাস্তবায়ন করেছে। এ সেলের সদস্যরা আত্মঘাতী নয় এবং একে অপরকে চেনে না। তবে নিউ জেএমবির ‘আত্মঘাতী সেলের’ সদস্যরা একে অপরকে চেনে।
এ সেলের সদস্যরা একে অপরের সম্পর্কে অনেক তথ্যই জানে। এ সেলের সদস্যদের বন্ধু ও আত্মীয়কেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় ‘ইনডোরে’। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ হামলা করে এ সেলের পাঁচ সদস্য। পরে কমান্ডো অভিযানে তারা নিহত হয়। এ সেলের আরও দুই সদস্য কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় হামলা চালায়। তারা আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর পৃথক অভিযানে নিহত হয়। কল্যাণপুরের আস্তানায় এ সেলের আট সদস্য নিহত হয়। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে রাজধানীর দারুস সালাম থেকে গ্রেফতার করা হয় এ সেলের পাঁচ সদস্যকে।
‘আত্মঘাতী সেলের’ চার সদস্যকে খুঁজছেন গোয়েন্দারা : নিউ জেএমবির ‘আত্মঘাতী সেলের’ চার জঙ্গিকে খুঁজছেন গোয়েন্দারা। আগস্টের মাঝামাঝি দারুস সালাম এলাকা থেকে এ সেলের পাঁচ সদস্য আবদুল করিম বুলবুল, আবুল কালাম আজাদ, মতিউর রহমান ও শাহীনুর রহমান হিমেলকে গ্রেফতার করে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। এ সময় নান্নু, সজিব, জিপসী ইমরান পালিয়ে যায়। এ চারজনের সঙ্গে করিমের যোগাযোগ ছিল বলে গোয়েন্দারা জানান। তাদের গ্রেফতার করা গেলে নিউ জেএমবির পরবর্তী মিশন ও পরিকল্পনা সম্পর্কে আরও ধারণা পাওয়া যাবে।
দুই জঙ্গি নেতার স্ত্রীদের আদালতে নেয়া হতে পারে আজ : আজিমপুরের আস্তানা থেকে আহত অবস্থায় গ্রেফতার জঙ্গি নেতা তানভির কাদেরি ওরফে আবদুল করিমের স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা ওরেফ খাদিজা, বাসারুজ্জামানের স্ত্রী শায়লা আফরিন ও নুরুল ইসলাম ওরফে মারজানের স্ত্রী আফরিন ওরফে প্রিয়তিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
তাদের মধ্যে শায়লা ও প্রিয়তির অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। আজ তাদের আদালতে হাজির করে রিমান্ড আবেদন করা হতে পারে। আবদুল করিমের ১৪ বছর বয়সী ছেলে তাহরীম কাদেরি ওরফে রাসেলকেও মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। সে এখন গাজীপুরের কিশোর সংশোধনী কেন্দ্রে রয়েছে। আজ তার রিমান্ড আবেদনের শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। - যুগান্তর
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি