এস এম আজাদ : সশস্ত্র হামলার মাধ্যমে কথিত খিলাফত প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী হয়ে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) নতুন ধারার সঙ্গে যারা যুক্ত হয় তাদের প্রথমেই ধর্মীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ওই ধর্মীয় প্রশিক্ষণে কোরআন ও হাদিসের বিশেষ বা খণ্ডিত কিছু আয়াতের ব্যাখ্যা দিয়ে নতুন সদস্যদের কথিত ইসলামবিরোধীদের হত্যায় উদ্বুদ্ধ করা হয়।
অনলাইনে পাওয়া কিছু লেখা এবং জেএমবির নেতাদের সংগ্রহ করা বই থেকে ওই ধর্মীয় প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। প্রথমে বয়ান শুনে যারা বিশ্বাসী হয়ে ওঠে এবং তাদের মধ্যে যারা ভালো বক্তা তাদেরই পরবর্তী সময়ে ধর্মীয় প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত করে সংগঠনের জ্যেষ্ঠ নেতারা। নব্য জেএমবির একটি দলে এমনই প্রশিক্ষক ছিল ২০ বছরের তরুণ রাকিবুল হাসান রিগ্যান। গত বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকায় এসে জেএমবিতে যোগ দেয় সে।
রাজধানীর কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেপ্তার হওয়া রিগ্যানকে আদালতের নির্দেশে দুই দফায় ১৩ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন পুলিশের কাউন্টার টোররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিসিটিসি) কর্মকর্তারা। সেখানে তার জঙ্গিসংশ্লিষ্টতা এবং তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বে জঙ্গি প্রশিক্ষণকেন্দ্রের ব্যাপারে অনেক তথ্য মিলেছে। গতকাল রবিবার রিমান্ড শেষে ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে রিগ্যান।
সে-ই একমাত্র জঙ্গি যে অভিযানের সময় জীবিত অবস্থায় ধরা পড়েছে এবং সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার ঘটনায় প্রথমবারের মতো স্বীকারোক্তি দিয়েছে। জেএমবির সাম্প্রতিক ঘটনার তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রিগ্যানের পাশাপাশি কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় হামলার ঘটনায় আটক হয়েছিল জঙ্গি শফিউল ইসলাম ডন। পরে ময়মনসিংহে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ডন নিহত হয়। ডনের দেওয়া তথ্যে দিনাজপুর থেকে গ্রেপ্তার হয় সাহাবুদ্দিন শিহাব রকি। রিগ্যান, ডন ও রকি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্য দিয়েছে। আলামত থেকেও মিলেছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, আজিমপুরে অভিযানের সময় আত্মহত্যাকারী ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের কর্মী তানভীর কাদেরী ওরফে আব্দুল করিম ওরফে শিপার সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার সংগঠক তামিম আহমেদ চৌধুরীর অন্যতম সহযোগী ছিল। গুলশানে হলি আর্টিজান হামলার আগে বারিধারার একটি বাসায় তারা একই সঙ্গে ছিল। তামিমের সঙ্গে তানভীরও বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) নেটওয়ার্ক স্থাপনের কাজ করেছে। তাদের ফোন ও ল্যাপটপ থেকে আইএস সক্রিয় হয়ে ওঠার তথ্য দিয়ে বাংলাদেশে ইসলামী খেলাফতের আমির হিসেবে ‘শায়খ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফ’ নাম ঘোষণা করা হয়।
ঘোষণাটি গত বছরের নভেম্বরে প্রকাশিত আইএসের বার্তা ম্যাগাজিন ‘দাবিক’-এ প্রকাশ করা হয়েছে। এর পরও তারা আইএস নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কানাডিয়ান একটি সংবাদ মাধ্যমে ‘শায়খ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফ’ হিসেবে তামিম চৌধুরীকে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তামিমের মৃত্যুর পর যোগাযোগের নেটওয়ার্কটি ধরে রেখেছিলেন তানভীর কাদেরী। তামিম বিশেষ আইডি পাসওয়ার্ড ও অ্যাপস ব্যবহার করে যোগাযোগ করতেন। একইভাবে তানভীর কাদেরীও যোগাযোগ চালানোর চেষ্টা করেন।
সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সম্প্রতি বলেন, ‘ধারাবাহিক অভিযানে নব্য জেএমবির নেটওয়ার্ক অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি আমরা। এই জেএমবির যেভাবে উত্থান হয়েছে, সেভাবেই এটি শেষ হবে বলে আশা করছি।’
দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, আজিমপুরের আস্তানা থেকে গ্রেপ্তার করা তিন নারী এখনো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা মুখ খুলছে না। তবে ওই আস্তানা থেকে উদ্ধার করা চারটি ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন পরীক্ষা করে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। নিহত মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলামের একটি ডায়েরি ও দুটি নোটবুক পাওয়া গেছে ওই ডেরা থেকে। এর আগে নারায়ণগঞ্জের অভিযানের পর উদ্ধারকৃত তামিম চৌধুরীর ভাঙা দুটি মোবাইল ফোনসেট মেরামত করে সেখান থেকেও কিছু তথ্য ও ছবি পাওয়া গেছে। এসব নিয়ে বিশ্লেষণ করছেন সিটিটিসি ইউনিটের কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে সিটিটিসি ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার আব্দুল মান্নান গতকাল বলেন, ‘কল্যাণপুরের আস্তানা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া রিগ্যান গতকাল ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তাকে দুই দফায় রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদেও কল্যাণপুরের আস্তানা সম্বন্ধে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে।’
সিটিটিসির অন্য একটি সূত্র জানায়, গত ২৬ জুলাই রাতে কল্যাণপুরের জাহাজবাড়িতে পুলিশের অভিযানে ৯ জঙ্গি নিহত হলেও জীবিত ধরা পড়ে রিগ্যান। ওই অভিযানে ইকবাল নামের আরেক জঙ্গি অস্ত্র নিয়ে পালিয়েছে। গুলিবিদ্ধ রিগ্যানকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার পর এখন সে স্টেচারে ভর করে হাঁটতে পারে। আদালতের নির্দেশে তাকে প্রথম দফায় সাত দিন এবং দ্বিতীয় দফায় ছয় দিনের রিমান্ডে নিয়ে আসে পুলিশ। গতকাল ওই রিমান্ড শেষে রিগ্যানকে ঢাকার মহানগর হাকিম সাব্বির ইয়াছির আহসান চৌধুরীর আদালতে হাজির করা হয়। তখন সে কল্যাণপুরের অভিযানে মিরপুর থানায় দায়ের করা মামলায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। জবানবন্দি রেকর্ড করে আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
সূত্র জানায়, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে রিগ্যান সংগঠনের গোপনীয় বিষয়গুলো বলতে রাজি হয়নি। তবে জঙ্গি সংগঠনে তার যুক্ত হওয়া এবং কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছে। বগুড়ার জামিলনগরের তরুণ রিগ্যানের বাবা রেজাউল করিম মারা গেছেন। তার মা রোকেয়া আক্তার নন্দীগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ নার্স। তার এক বোন আছে। রিগ্যান ২০১৩ সালে বগুড়া শহরের করতোয়া মাল্টিমিডিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করে। এরপর ২০১৫ সালে সরকারি শাহ সুলতান কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির জন্য বগুড়ায় রেটিনা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়। এরপর গত বছরের ১৪ জুলাই কোচিং সেন্টারে যাওয়ার কথা বলে রিগ্যান নিখোঁজ হয়। পরদিন তার বাবা বগুড়া সদর থানায় ছেলে নিখোঁজ হওয়ায় ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। রিগ্যান এক বছর ধরে কোনো যোগাযোগ করেনি পরিবারের সঙ্গে।
সূত্র জানায়, এইচএসসিতে পড়ার সময় রিগ্যানের সঙ্গে পরিচয় হয় সাব্বির নামের এক বড় ভাইয়ের। যে রিগ্যানকে উগ্রপন্থার মাধ্যমে কথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী করে তোলে। তার কথায় বাড়ি ছেড়ে সে ঢাকায় চলে আসে। কল্যাণপুরের আস্তানায় যাওয়ার আগে সে রাজধানীর পাইকপাড়া, শেওাড়াপাড়াসহ তিন-চারটি আস্তানায় ছিল। সূত্র মতে, এসব আস্তানায় প্রথমে ধর্মীয় বিষয়ে নতুন সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ হয়। রিগ্যান ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে পারে বলে তাকে পরে ধর্মীয় বিষয়ে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে রিগ্যান বলেছে, তামিম, মেজর (অব.) জাহিদ ও তানভীর কাদেরীকে সে দেখেছে। তাদের আস্তানায় তারা ঘুরে গেছেন। কল্যাণপুরের আস্তানায় ১১ জন ছিল বলেই দাবি করেছে রিগ্যান।
যোগাযোগ রেখেছে তানভীর : সিটিটিসি সূত্র বলছে, নারায়ণগঞ্জে তামিম চৌধুরীর মৃত্যুর পর সমন্বয়কের দায়িত্ব নেয় ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরে অভিযানে নিহত তানভীর কাদেরী। দায়িত্ব নিয়েই সে হামলার পরিকল্পনা করে। এর অংশ হিসেবে নরসিংদীর মাধবদীতে চিত্তরঞ্জন আর্য্য নামে মন্দিরের এক তত্ত্বাবধায়কের ওপর হামলা চালানো হয়। আজিমপুরের আস্তানা থেকে সংগঠনটির জঙ্গি প্রশিক্ষক জাহিদের একটি কালো রঙের ডায়েরি ও দুটি নোটবুক উদ্ধার করা হয়। সেখানে জঙ্গিদের ব্যবহূত চারটি ভাঙা ল্যাপটপ ও একটি পেনড্রাইভও পাওয়া গেছে। আস্তানায় জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার ইসলামের ট্রাস্ট ব্যাংকের একটি জমা স্লিপ বই এবং একটি চেক বই পাওয়া যায়।
সূত্র মতে, তামিম, জাহিদ ও তানভীর নিহত হওয়ার পর আইএস মতাদর্শের নব্য জেএমবি অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। তামিম দেশে আসার পর অর্থ সংকট কেটে যায় তাদের। এর আগে ব্যাংক লুট, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা থাকলেও তামিমকে পেয়ে হামলার দিকেই মনোযোগ ছিল জঙ্গিদের। সম্প্রতি তামিম নিহত হওয়ার পর সহযোগীরা ফের ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনা করে। -কালেরকণ্ঠ
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি