জাকিয়া আহমেদ : ‘বাবা সুস্থ হলে কতদিনে আবার একটি চাকরি করতে পারবে সেটা বুঝতে পারছি না। আমারও লেখাপড়া শেষ হয়নি। দায়িত্বটা এবার আমাকেই নিতে হবে বুঝতে পারছি’ বলেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন মাসুদ রানা। টঙ্গীর টাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় আগুনের ঘটনায় আহত হয়ে মাসুদ রানার বাবা জাহাঙ্গীর মৃধা গত পাঁচদিন ধরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে রয়েছেন।
গত ১০ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের টাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জাহাঙ্গীর মৃধাকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে ১৪ সেপ্টেম্বর অবস্থার অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। এ দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৩৪ জন, ঢাকা মেডিক্যালের ওয়ার্ডে আছেন চার জন আর গুরুতর অবস্থায় আইসিইউতে আছেন ২ জন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চতুর্থ তলায় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের সামনে রোগীর স্বজনদের বসার জন্য চেয়ার সাজানো রয়েছে। চেয়ারে জায়গা না পেয়ে কেউ মেঝেতে বিছানা এবং চাদর বিছিয়ে শুয়ে আছেন, আবার কেউ বসে আছেন। ভেতরে থাকা বাবা, মা, ভাই, বা পুত্র কন্যার জন্য অপেক্ষায় আছেন তারা।
রবিবার বাবাকে আইসিইউতে রেখে বারান্দায় পায়চারি করছিলেন মাসুদ। এ সময় তিনি বলেন, ‘কোনদিক দিয়ে দিন হয়, দিন পার হয়ে রাত হয় আর তারপর ভোর হয় টেরই পাচ্ছি না। গত পাঁচদিন ধরে এখানেই দাঁড়িয়ে আছি একটা সুখবরের আশায়। বাবার অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক, সারাক্ষণ বুকের ভেতরে ধুকধুক শব্দ শুনছি, খোদা যেন আমাকে কোনও খারাপ খবর না শোনান সেই জন্য তার দরবারে হাত তুলে আছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাবা মা আর দুই বোনকে নিয়ে তার সংসার। বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন প্রায় ১৫ বছর ধরে ঐ কারখানায় মেশিন অপারেটরের কাজ করেন। বাবার দুর্ঘটনার পরে মাও অসুস্থ হয়ে পড়েছে, ছোট বোনটি সাত মাসের গর্ভবতী। সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য গত চারমাস ধরে সে বাড়িতে থাকছে। কিন্তু আমার বোনটাও এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ওকে নিয়েও আমরা প্রচন্ড টেনশনে আছি।’
মাসুদ বলেন, ‘সেদিন বাবার মর্নিং শিফট ছিল। আমাকে এক চাচা ফোন করে বলেন, টঙ্গিতে নাকি একটা বিল্ডিং ভেঙ্গে পরছে, খোঁজ নাও। তখন বাবার ফোনে কল দিয়ে বন্ধ পাই। তখনি ছুটে গিয়ে দেখি কারাখানায় আগুন জ্বলতেছে দাউ দাউ করে। ফোন দিতেছি, কিন্তু কল যাচ্ছিলো না। হঠাৎ একসময় নেটওয়ার্ক পাই, অন্য একজন বলেন, আমি মোবাইলটা পেয়েছি, ওনাকে টঙ্গী মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাড়াতাড়ি খোঁজ নেন। আমি সেখানে যাই, কিন্তু তারা বলেন, অনেক মানুষকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, ওখানে যান। তারপর ঢাকায় থাকা আমার খালাতো ভাই এখানে এসে তাকে জরুরি বিভাগের সামনে পায়। তারপরই আমরা সবাই এখানে ছুটে আসি।’
এখন কী অবস্থা ওনার জানতে চাইলে মাসুদ বলেন, ‘ওনার মাথায় আর বুকে আঘাত, মাথায় মগজে আঘাত পেয়েছে আর বুকে চাপা লাগায় বুকের ভেতরে রক্ত জমা হয়ে আছে। সেখানে পাইপ লাগানো হয়েছে, কিন্তু যখন জ্ঞান ফেরে তখন তীব্র যন্ত্রণায় হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে। যার কারণে তিনবার পাইপ ছুটে গেছে। তাই তাকে সবসময় ওষুধ দিয়ে ঘুম পড়িয়ে রাখা হয়। কিন্তু এভাবে কতদিন যাবে সেটা বুঝতে পারছি না। ডাক্তাররাও আশার কথা কিছু শোনাতে পারছেন না।’
এদিকে, ছোট চাচা ইকবাল হোসেনের অপেক্ষায় মাদারীপুরের লালন হোসন বসে আছেন আইসিইউর সামনে। ১০ থেকে ১২ বছর ধরে এই কারখানায় কাজ করছিলেন ইকবাল হোসেন। আট বছরের এক ছেলে আর তিন বছরের দুই সন্তান রয়েছে ইকবাল হোসেনের। ঘটনার দিনই তাকে আইসিইউতে নিয়ে আসা হয়, সেই থেকে এখানেই রয়েছেন ইকবাল হোসেন।
লালন হোসেন বলেন, ‘আইসিইউতে থাকা চাচা তাকে জানিয়েছেন,তার ডিউটি ছিল সেদিন দুপুরের শিফটে, কিন্তু তার আরেকজন কলিগের সকালে ব্যক্তিগত কাজ থাকায় তার সঙ্গে শিফট এক্সচেঞ্জ করেন ইকবাল করেন। ইকবাল পৌনে ছয়টার দিকে যখন কারখানায় প্রবেশ করছিলেন তখন দেখতে পান আগুন লেগেছে। উনি দৌড় দিলে ওপর থেকে তার ঘাড়ের ওপর কিছু একটা পরে, তখন তিনি ওখানেই বসে পরেন, সেখানে আবার বড় একটি ধ্বংসস্তুপ পরে তার পায়ের ওপর। তাতেই তার দুই পায়ের হাটুর নিচের অংশের হাড় আলাদা হয়ে যায়।গড়িয়ে গড়িয়ে মূল ফটকের বাইরে আসেন, ফোন করেন বাসায়। প্রথমে টঙ্গি হাসপাতাল,পরে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে আসা হয় তাকে। ছোট ছোট কাচের টুকরো পুরো শরীরে ঢুকে গিয়েছিল। সেদিনই অপারেশন শেষে তাকে আইসিউতে স্থানান্তর করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ঈদের দুইদিন খুব সমস্যায় ছিলাম। ঈদের আগের দিন এবং ঈদের দিন অর্থোপেডিকসের কোনও ডাক্তার না থাকায় তার ড্রেসিং হয়নি। পুরো কারখানা ধ্বংস হয়ে গেছে, আর তারতো দুই পাই ভেঙ্গে গেছে, হয়তো রড দিয়ে জোড়া লাগানো থাকবে। তিনি ভারি কোনও কাজ করতে পারবেন না। এই সংসারের দায়িত্ব এখন আমাদের নিতে হবে।’ -বাংলা ট্রিবিউন।
১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম