আহমদুল হাসান আসিক : রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় ১৭ বিদেশীসহ ২০ জনকে হত্যার পর আরও অন্তত ৮০ জন বিদেশীকে হত্যার মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছিল নতুন ধারার জেএমবি বা নিউ জেএমবি।
এ লক্ষ্যে বিদেশীরা সমাগম হয় এমন দুটি স্থান ঠিক করে এবং দুটি অপারেশনাল ইউনিটকে কল্যাণপুরের আস্তানায় ‘উদ্বুদ্ধকরণ’ ও ‘সামরিক’ প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। চূড়ান্ত হামলার আগে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) নামে দায় স্বীকারের কথিত বার্তা প্রচারের জন্য আত্মঘাতী জঙ্গিদের ছবিও তুলে রাখা হয়েছিল। গুলশান ও কল্যাণপুরে হামলার ঘটনার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
নিউ জেএমবির সমন্বয়ক তামিম আহমেদ চৌধুরীসহ অন্তত ১০ জন ‘বড় ভাই’ ওই দুই অপারেশনাল ইউনিটের সদস্যদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে হামলার চূড়ান্ত ছক তৈরি করছিল। হলি আর্টিজানে হামলাকে ব্যাপক সফলতা হিসেবেই দেখছিল নিউ জেএমবি। গোপন অ্যাপসের মাধ্যমে এই ‘সফলতা’র কথা বলে কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করছিল সংগঠনের ‘বড় ভাইয়েরা’। তবে ২৬ জুলাই ভোরে পুলিশের অভিযানে ‘আত্মঘাতী স্কোয়াডের’ ৮ সদস্যসহ ৯ জন নিহত হওয়ার পর তাদের এই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
গোয়েন্দাদের দাবি, গুলশানে হামলার সঙ্গে জড়িত চার শীর্ষ জঙ্গি তামিম আহমেদ চৌধুরী, তানভির কাদেরি ওরফে আবদুল করিম, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ও রায়হান কবির ওরফে তারেক পৃথক অভিযানে নিহত হওয়ার পর সংগঠনটি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। একজন শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, গুলশান হামলার পর রাজধানী ও এর আশপাশে অন্তত ১৫টি জঙ্গি আস্তানায় সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়। এসব অভিযানে রাজধানীতে ১১ জন এবং নারায়ণগঞ্জে তিন জন মারা গেছে। এসব আস্তানা থেকে উদ্ধার হওয়া বিভিন্ন আলামত পরীক্ষা করে সংগঠন সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে।
তবে পাঁচ শীর্ষ সংগঠক এখনও পলাতক থাকায় গোয়েন্দারা নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। এর মধ্যে গুলশান হামলার অপারেশনাল কমান্ডার নুরুল ইসলাম মারজান, উত্তরাঞ্চলের শীর্ষ কমান্ডার ‘রাজীব গান্ধী’ ও বাসারুজ্জামান এখনও দেশেই রয়েছে। অপরদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম হত্যার সঙ্গে জড়িত শরীফুল ইসলাম খালিদ ও মামুনুর রশীদ রিপন ভারতে পালিয়ে গেছে। তারা দু’জনই উত্তরবঙ্গে একাধিক জঙ্গি হামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, নিউ জেএমবির শক্তি অনেক ক্ষয় হয়ে গেছে। তবে তারা এখনও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়নি। তারা আর কোনো নাশকতা করতে না পারে এ বিষয়ে গোয়েন্দারা ব্যাপক তৎপর রয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, যে শীর্ষ পাঁচ জঙ্গিকে খোঁজা হচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল উত্তরবঙ্গের কমান্ডার রাজীব গান্ধী। এটি তার সাংগঠনিক নাম। সে সুভাষ গান্ধী ও শান্ত নামেও সংগঠনে পরিচিত। উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে টার্গেট কিলিংসহ ৩২ ঘটনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। সে পুরনো জেএমবি থেকে নিউ জেএমবিতে যুক্ত হয়। আনুমানিক ৩৫ বছর বয়সী ও এইচএসসি পাস এ জঙ্গির গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা জেলায়। সে টেকনোলজিতে খুবই পারদর্শী।
গুলশানে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গির মধ্যে বগুড়ার দু’জনকে সে রিক্রুট করেছিল। রাজীব গান্ধীর পরেই গুলশান হামলার অপারেশনাল কমান্ডার নুরুল ইসলাম মারজানের অবস্থান। তার স্ত্রী আফরিন ওরফে প্রিয়তিকে আজিমপুরের আস্তানা থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। রাজশাহীর এক জঙ্গি নেতা বাসারুজ্জামান ওরফে চকলেটও দেশেই অবস্থান করছে। তার স্ত্রী শায়লা আফরিনকে আজিমপুরের আস্তানা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের ব্রিফিং : সোমবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক অনির্ধারিত ব্রিফিং করেন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, গুলশান হামলার তদন্তে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে অনেক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ গ্রেফতার হয়েছে, আবার অনেকেই অভিযানে নিহত হয়েছে। যারা পলাতক রয়েছে তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।
তিনি বলেন, জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র কেনার অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে আসার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে বাংলাদেশী নাকি কোনো বিদেশী এই অর্থ পাঠিয়েছে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। হুন্ডির মাধ্যমে আসা ১৪ লাখ টাকার একটি চালান জঙ্গি বাসারুজ্জামান গ্রহণ করেছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। দেশে আসা অস্ত্রগুলো কারা গ্রহণ করেছে সে বিষয়েও তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো ভারত হয়ে বাংলাদেশে এসেছিল।
সাইফুল ও শাওন জঙ্গি কিনা এখনও নিশ্চিত নন গোয়েন্দারা : গুলশান হামলার পর সশস্ত্র বাহিনীর অভিযানে নিহত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনকে জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন গোয়েন্দারা। অপরজন হলি আর্টিজান বেকারির বাবুর্চি সাইফুল হক চৌকিদার জঙ্গি কিনা তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সাইফুল জঙ্গি নন বলে পরিবার দাবি করলেও তাকে গুলশানের ঘটনায় করা মামলায় আসামি করা হয়েছে।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, সাইফুল হামলাকারীদের সঙ্গে থেকে তাদের সহায়তা করেছেন। এদিকে হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওই এলাকা থেকে জাকির হোসেন শাওন নামে এক যুবককে রক্তাক্ত অবস্থায় আটক করেছিল পুলিশ। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তিনি হলি আর্টিজান বেকারির বাবুর্চির সহকারী ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্রিফিংয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, এখনও সাইফুলের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। শাওনের বিষয়েও সন্দেহাতীত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। - যুগান্তর
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি