আলাউদ্দিন আরিফ : বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে চুরির সঙ্গে দেশী-বিদেশী ৭৯ নাগরিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য পেয়েছে তদন্ত সংস্থা সিআইডি। তাদের মধ্যে আছেন ব্যাংক কর্মকর্তা, অর্থ গ্রহণকারী, পরিবহনকারী ও সুবিধাভোগী। চুরির সঙ্গে সম্পৃক্ততা মিলেছে ৫ বিদেশী প্রতিষ্ঠানেরও।
প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, ২৫ বিদেশী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৩ কর্মকর্তা চুরি প্রক্রিয়া এবং অর্থ স্থানান্তরের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। ৩৯ বিদেশী জড়িত ছিল পরোক্ষভাবে। দায়িত্বে অবহেলা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন ৩ কর্মকর্তার। জড়িত বিদেশীদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য ১১টি দেশে চিঠি পাঠিয়েছে তদন্ত সংস্থা সিআইডি। তাদের পাঠানো চিঠির জবাব না পাওয়ায় অনেকটাই থমকে আছে এ সংক্রান্ত মামলার তদন্ত। বিশেষ করে ফিলিপাইন, শ্রীলংকা, জাপান ও চীন এই চার দেশ থেকে চিঠির জবাব না পেলে তদন্ত প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়া প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে সিআইডির তদন্ত দলের প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (এডিশনাল ডিআইজি) শাহ আলম সোমবার বলেন, সুইফটের মাধ্যমে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে হ্যাকিং ও চুরি প্রক্রিয়ায় বিপুলসংখ্যক দেশী-বিদেশী নাগরিকের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে আছেন ব্যাংক কর্মকর্তা, অর্থ গ্রহণকারী, প্রদানকারী, আমানতকারী ও বহনকারী। চুরির টাকায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুবিধাভোগী অনেকেই আছেন এই তালিকায়। দীর্ঘ তদন্তে আমরা তাদের শনাক্ত করেছি এবং তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য চেয়ে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছে চিঠি দিয়েছি। আমরা জড়িতদের বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। রিজার্ভ চুরি প্রক্রিায়ায় দেশী-বিদেশী কত নাগরিকের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে তার সংখ্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে সংখ্যা বলা যাবে না। আমাদের তদন্ত অব্যাহত আছে।
জানা গেছে, বিদেশী যেসব প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে সেগুলো হচ্ছে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (আরবিসিসি), ফিলিপাইনের ক্যাসিনো ইস্টার্ন হাওয়াই লেইজার কোম্পানি, অর্থ বহনের কাজে ব্যবহৃত মানি এক্সচেঞ্চ প্রতিষ্ঠান ফিলরিমে মানি সার্ভিস লিমিটেড, ব্ল–বেরি অ্যান্ড হোটেল ও শ্রীলঙ্কার বেসরকারি সংস্থা শালিকা ফাউন্ডেশন। এছাড়া ফরাসউদ্দিন তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে রিজার্ভে চুরির সঙ্গ ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিক্সকেও দায়ী করা হয়েছে। যদিও সিআইডি বিষয়টি নিশ্চিত করেনি।
মামলার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত দলের ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (অর্গানাইজড ক্রাইম) আবদুল্লাহ হিল বাকী বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ইন্টারপোলের মাধ্যমে কয়েকটি দেশে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তারা এখন পর্যন্ত জবাব দেয়নি। চিঠির জবাব না পেলে রিভার্জে চুরির তদন্ত এগিয়ে নেয়া যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, প্রথমে মামলার তদন্ত যতটা সহজ মনে হয়েছে কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অসহযোগিতার কারণে ধীরে ধীরে বিষয়টি জটিল আকার ধারণ করছে। আমরা তাদের কাছ থেকে জবাব পাওয়ার অপেক্ষায় আছি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট অপর একজন কর্মকতা জানান, বাংলাদেশের পুলিশ চাইলেই বিদেশীরা চিঠির জবাব দিতে বাধ্য নয়। নানাবিধ কারণে তাদের এ বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করাও অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব।
তাছাড়া বাইরের রাষ্ট্রগুলো হুট করেই তাদের নাগরিকের সম্পৃক্ততা স্বীকার করবে না। আমাদের চিঠি পাওয়ার পর প্রথমে তদন্ত করবে, নিশ্চিত হলে জবাব দেবে। আবার তারা (বিদেশী দেশ ও সংস্থা) জবাব নাও দিতে পারে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর মাধ্যমে চিঠির জবাব দ্রুত পাওয়ার চেষ্টা করা উচিত। এজন্য তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা নিচ্ছেন।
রিজার্ভে চুরি প্রক্রিয়ায় জড়িত সন্দেহভাজন দেশী-বিদেশী নাগরিকদের সংখ্যা ও নাম প্রকাশ করেননি তদন্ত সংস্থা সিআইডির দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র বলছে, বিদেশীদের মধ্যে ফিলিপাইনের ৩০, চীনের ২৩, শ্রীলংকার ৭ ও জাপান, ভারত ও সিঙ্গাপুরের একজন করে তিন নাগরিক রয়েছে। চূড়ান্ত তদন্তে এ সংখ্যা কম-বেশি হতে পারে।
সিআইডি সূত্র জানায়, রিজার্ভে চুরি প্রক্রিয়ায় সন্দেহভাজন হিসেবে ফিলিপাইনের নাগরিকের মধ্যে ব্যাংক কর্মকর্তা, অর্থগ্রহণকারী ও সুবিধাভোগী ব্যক্তিরা আছেন। চুরির অর্থ ফিলিপাইনের ব্যাংক থেকে বের হওয়ার পর চলে যায় চীনের ২৩ জুয়াড়ির হাতে।
এদের মধ্যে ক্যাসিনো মালিক, এজেন্টও আছেন। ফিলিপাইনের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ কাউন্সিল (এএমসিএল) তাদের নাম-ঠিকানা সিআইডিকে দিয়েছে। এছাড়া চুরি হওয়া অর্থ নিয়ে ফিলিপাইনের আরসিবিসি কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে যেসব কথাবার্তা বলেছেন, তার রেকর্ডও সিআইডির হাতে পৌঁছেছে।
রিজার্ভের চুরিতে সন্দেহভাজন হিসেবে আছেন মায়া সান্তোস দেগুইতো, ফিলিপাইনের ক্যাসিনো ইস্টার্ন হাওয়াই লেইজার কোম্পানির মালিক কিম অং ওরফে ক্যাম সিং অং (চীনা ব্যবসায়ী), অর্থ পাঠানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত প্রতিষ্ঠান ফিলরিমের প্রেসিডেন্ট স্লুইড বাতিস্তা, ফিলিপাইনের ব্যবসায়ী উইলিয়াম সো গো, ফিলিফাইনের নাগরিক ফ্রান্সিসকো ক্রুজ, জেসি ক্রিস্টোফার লাগ্রোসাস, আলফ্রেড সান্তোস ভেরগারা, এনরিকো টিয়োডরো ভ্যাসকুয়েজ ও রোমালদো আগ্রাদোসহ আরও কয়েকজন। চীনের ২৩ নাগরিকের মধ্যে আছেন ক্যাসিনো এজেন্ট সুহুয়া গাও এবং ডিং ঝিজে।
এছাড়া শ্রীলঙ্কার বেসরকারি সংস্থা শালিকা ফাউন্ডেশনের ছয় পরিচালক শালিকা গোমেজ পেরেরা, সানজেবা টিসা বান্দারা, শিরানি ধাম্মর্কি ফার্নান্দো, ডন প্রসাদ রোহিতা, নিশান্থা নালাকা ও ওয়ালাকুরুয়ারাচ্চির ব্যাপারে তথ্য পেয়েছে সিআইডি। এছাড়া তাদের এক দালালের নামও জেনেছেন তারা। পাশাপাশি রিজার্ভ চুরিতে সহায়তাকারী জাপানি নাগরিক হচ্ছেন সাসাকিম তাকাশি।
সিআইডি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৩ কর্মকর্তার মধ্যে অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের ব্যাক অফিস অব দ্য ডিলিংস রুমের ৪ জন, ইনফরমেশন সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ৩ জন, পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগের ৪ জন ও ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ২ জন। এছাড়া দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও অধীনস্থ কর্মকর্তাদের তদারকিতে ব্যর্থ ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ২ জন ভাইস প্রেসিডেন্ট ও একজন জিএম। সিআইডির একজন কর্মকর্তা তাদের প্রসঙ্গে জানান, চুরির অর্থ যাদের কাছে গেছে এবং হ্যাকার গ্র“পের সঙ্গে ওইসব কর্মকর্তার কতটুকু যোগসূত্র ছিল তা নিশ্চিত হওয়ার কাজ চলছে। অর্থাৎ আদালতে মামলা প্রমাণের জন্য প্রত্যেকের আলাদা দায় নির্ধারণের কাজ করছে তদন্ত সংস্থা।
এদিকে সিআইডি ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বাংলাদেশ ব্যাংকে ১৬ কর্মকর্তার নাম প্রকাশ করেনি। তবে সরকার গঠিত ফরাসউদ্দিন তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৬ কর্মকর্তার দায়িত্বহীনতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তারা হচ্ছেন অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের যুগ্ম-পরিচালক ও মামলার বাদী জোবায়ের বিন হুদা, উপপরিচালক মিজানুর রহমান ভুঁইয়া, উপপরিচালক জিএম আবদুল্লাহ ছালেহীন, সহকারী পরিচালক শেখ রিয়াজ উদ্দিন, রফিক আহমদ মজুমদার ও মইনুল ইসলাম।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তারা নিজেরা জেনে বা না জেনে অপরাধীদের সহায়তা করেছেন। এসব কর্মকর্তা নিজেদের পাসওয়ার্ডের গোপন তথ্য সাইবার অপরাধীদের হাতে তুলে দিয়েছেন। আর রিজার্ভের চুরির চার মাস আগেই সাইবার দুষ্কৃতকারী চক্র বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাক অফিস অব দি ডিলিং রুমের কর্মকর্তা জোবায়ের বিন হুদা এবং আবদুল্লাহ ছালেহীনের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড নকল করেছিল। ওই আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে সুইফটের মাধ্যমে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে ৩৫টি অবৈধ ভুয়া পেমেন্ট ইন্সট্রাকশন দেয়া হয়। এর মধ্যে ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকে পাঠানো ৫টি আদেশ কার্যকর করা হয়। যার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটে। স্টপ পেমেন্ট আদেশ অগ্রাহ্য করে অর্থ প্রদান করায় ফিলিপাইনের রিজেল কমার্শিয়াল ব্যাংককে দায়ী করেছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় ১৫ মার্চ যুগ্ম পরিচালক জোবায়ের বিন হুদা বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় মামলা করেন। মামলার মূল তদন্ত করছে সিআইডি। - যুগান্তর
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি