সোমবার, ০৫ অক্টোবর, ২০১৫, ০১:২৫:৩৪

'আমাকে স্যার বলবে না'

'আমাকে স্যার বলবে না'

সমরেশ মজুমদার : বাড়িতে আমাকে নিয়ে একটা রসিকতা চালু আছে। সাধারণত সকালবেলায় আমি লেখালেখি করি, সেটা চলে ১১টা পর্যন্ত এবং ওই সময়ে আগাম না জানিয়ে কেউ এলে দেখা করি না। না করার কারণ, লেখা ছেড়ে গেলে আর মন বসাতে পারি না। দ্বিতীয়ত, যিনি আসছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো জরুরি কারণে আসেননি। কিন্তু বাড়ির লোকেরা যখন তাদের বলেন, 'উনি এখন লিখছেন, দেখা করবেন না' তখন তাদের অনুরোধ অথবা অভিযোগ শুনতে হয়।

এর জন্য তারা বিরক্ত হয়ে থাকেন, আমাকে বলতে পারেন না। কিন্তু বাড়ির লোকেরা যখন তাদের বলেন, উনি এখন লিখছেন, দেখা করবেন না' তখন তাদের অনুরোধ অথবা অভিযোগ শুনতে হয়। এর জন্য তারা বিরক্ত হয়ে থাকেন, আমাকে বলতে পারেন না। কিন্তু আগন্তুক যদি বলে, আমি শিলিগুড়ি অথবা জলপাইগুড়ি অথবা আলিপুর দুয়ার কিংবা কোচবিহার থেকে এসেছি এবং সেটা যদি আমার কানে পৌঁছায় তাহলে আমি লেখা ছেড়ে দেখা করতে যাই।

রসিকতা হলো, নর্থবেঙ্গুলে ভাইবোন এলে আর দেখতে হবে না, সব নিয়ম শিকেয় উঠবে। মেঘ দেখলে যেমন ময়ূর পেখম মেলে! তাহলে অন্যরা এলে আমাদের দিয়ে কড়া কথা বলানোর কী দরকার?

হ্যাঁ, রসিকতাটা শেষ পর্যন্ত অভিযোগ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রোজ বাড়িতে কেউ এলেই যদি দেখা করি তাহলে কাগজ তুলে রেখে কলম বন্ধ করতে হবে। আবার উত্তরবঙ্গের কেউ এলে আমার শৈশব বাল্যকাল এবং তরুণ বয়সটা এমন হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ে যে, না দেখা করে পারি না। মনে পড়ে যায় ১৭ বছর বয়সে যখন কলকাতায় পড়তে এসেছিলাম, তখন এই শহরে আমার পূর্ব পরিচিত কোনো মানুষ ছিলেন না। উত্তবঙ্গের বিখ্যাত হয়ে যাওয়া কোনো মানুষ কলকাতায় থাকেন কিনা তা জানা ছিল না। সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় অধ্যাপনার সুবাদে কিছুকাল জলপাইগুড়িতে ছিলেন কিন্তু তাকে উত্তরবঙ্গের লোক বলা যায় না। গায়ক প্রদ্যোৎ বর্মণ 'শুকতারা ওই দ্যাখো ডুবে যায়' গানটি রেকর্ড করে নাম করেছিলেন কিন্তু তিনি কলকাতায় থাকেন কিনা তা জানা ছিল না। জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়ায় আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতেন আনন্দ চক্রবর্তী মশাই। বেশ রাশভারী মানুষ।

সেই বাড়ির ছেলে সিনেমা করছে বলে জানা গেল। এ কাজটা ওই সময়ের রক্ষণশীল পরিবার কুকর্ম বলে মনে করত। চক্রবর্তী পরিবার ব্যাপারটিকে তাই মনে করছে কিনা বোঝার আগে জলপাইগুড়ির রাস্তায় তিন চাকার সাইকেলে মাইক বেঁধে ঘোষণা শুরু হয়ে গিয়েছিল। শুনুন, শুনুন, আমাদের শহরের ছেলে, উত্তরবঙ্গের প্রথম চলচ্চিত্র পরিচালক প্রফুল্ল চক্রবর্তী পরিচালিত দুরন্ত হাসির ছবি 'যমালয়ে জীবন্ত মানুষ' দেখতে দলে দলে চলে আসুন। যমালয়ে জীবন্ত মানুষ' ওই সফল ছবি পরিচালনার জন্য প্রফুল্ল বাবুর খুব খ্যাতি হয়েছিল। এখনো টিভিতে দেখানো হলে দেখতে মজাই লাগে।

কেন গিয়েছিলাম এখন মনে নেই। হয়তো স্ব-জায়গার বিখ্যাত মানুষের স্নেহধন্য হওয়ার তাগিদ ছিল। কিন্তু চক্রবর্তী মশাই দেখা করলেন না। আমি উত্তরবঙ্গ, বিশেষ করে তার পাশের বাড়ির ছেলে শুনেও না। বলে পাঠালেন, স্ক্রিপ্ট নিয়ে ব্যস্ত, ওসব জলপাইগুড়ি-টলপাইগুড়ির জন্য নষ্ট করার সময় তার নেই। ব্যস্ততার সময় কথাগুলো মনে হলে তাকে আমি এখন দোষ দেব না, কিন্তু সেই তরুণ বয়সে বেশ ক্ষিপ্ত হয়েছিলাম। স্থির করেছিলাম, আমার কাছে কেউ এসে যদি বলে উত্তরবঙ্গ থেকে এসেছি, তাহলে অবশ্যই তার সঙ্গে দেখা করব।

পরবর্তীকালে উত্তরবঙ্গ থেকে কয়েকজন লেখক খ্যাতি পেয়েছেন, খেলোয়াড়রাও বিখ্যাত হয়েছেন। শ্রদ্ধেয় রুনু গুহঠাকুরতা বা মণিলাল ঘটকের সঙ্গে পরে আলাপ হয়েছিল এবং তারাও জলপাইগুড়ি শুনে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এসপি রায়, বীরন্দ্রে কাঠাম, বিসি ঘোষ মশাইরা জলপাইগুড়িতে আমার অধরা হওয়া সত্ত্বেও এদের সঙ্গে কথা বলার সময় এমনভাবে চলে আসতেন যে শুনলে যে কেউ ভাববে নিত্য ওঠাবসা আছে। মণিলালদা বা রুনুদা অবশ্যই তাদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন, আমি দূর থেকে, কিন্তু কথা বলার সময় সব দূরত্ব ঘুচে যেত।

একদিন সকাল সাড়ে ৯টায় একটি ছেলে এলো। রোগা, বছর বাইশের ছেলের হাতে ব্যাগ। বলল, থাকে বেলাকোবাতে। বিএ পাস করেছে। অনেকদিন থেকে লেখালেখি করে। কোথাও ছাপতে দেয়নি। আমি যদি তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা এবং একটা চাকরি করে দিই, তাহলে সে খুব সিরিয়াস হয়ে লিখতে পারবে। আমি অবাক হয়ে তাকালাম। সে বলল, আর কিছু না হোক, আপনি কোনো প্রকাশককে বলে প্রুফ দেখার কাজ পাইয়ে দিন। আমি এটি দেবের-অভিধান থেকে প্রুফ দেখা শিখেছি। আর একটা সস্তার মেসে থাকার ব্যবস্থা করে দিন। বাংলা সাহিত্যের অনেক বিখ্যাত লেখক এভাবেই জীবন শুরু করেছেন। এমনকি, আপনার 'এক জীবনে অনেক জীবনে' পড়ছি, আপনিও তাই করেছেন।

অনেক বুঝিয়ে, বকুনি দিয়ে সেই দুপুরের তিস্তাতোর্ষা এঙ্প্রেসে চাপিয়ে ফেরত পাঠিয়েছিলাম ছেলেটিকে।

একটি মেয়ে ফোন করল, 'স্যার, আমি আলিপুরদুয়ারের মেয়ে, কলকাতার কলেজে পড়ছি।

খুশি হয়ে বললাম, বাঃ, বলো, কেন ফোন করলে?

'আমি আপনার সব বই পড়েছি। খুব ভালো লাগে। ফোনের সামনে নিজেদের দেশটাকে দেখতে পাই। শিলিগুড়ি শহরের উপর লেখাটা যে কী ভালো লাগে। একদিন দেখা করতে চাই স্যার।

প্রথমত, আমাকে স্যার বলবে না। দাদা, কাকা, জ্যাঠা যা ইচ্ছা বলতে পার। যেদিন আসবে তার আগে ফোন করে আসবে। হেসে বললাম।

তার দু-দিন পরে একটি ছেলে ফোন করল। তারও নাকি আমার লেখা ভালো লেগেছে। সে আমার ফোন নম্বর কোথায় পেল, জিজ্ঞাসা করাতে আলিপুর দুয়ারের মেয়েটির নাম বলল, 'ও আমাকে দিয়েছে, বলেছে আপনার সঙ্গে কথা বলতে।'

'কী বিষয়ে?'

'কাকু, আমি ওকে খুব ভালোবাসি। ও আমাকে ঠিক বুঝতে পারছে না, এ অবস্থায় কী করা যায় তা ভেবে পাচ্ছি না। আপনি সমাধান করে দিতে পারেন বলে আমাদের ধারণা।

ফোন রেখে দিয়েছিলাম। ইচ্ছা হয়েছিল মেয়েটিকে ফোন করে ধমক দিই। আলিপুর দুয়ারের নাম ভাঙিয়ে আমাকে যন্ত্রণা দেওয়ার জন্য। শেষ পর্যন্ত মায়া এলো মনে।

এক ভদ্রলোক টালিগঞ্জে থাকেন, অল্প পরিচয় ছিল। ফোন করলেন, সমরেশবাবু একটু বিরক্ত করছি। আপনি নন্দিতা বলে কোনো মেয়েকে চেনেন?

মনে করতে পারলাম না। ভদ্রলোক বললেন, জলপাইগুড়ির মেয়ে। ওর দাদু গয়েরকাটা চা বাগানে কাজ করতেন।

নাম জানার পর চিনতে পারলাম। ভদ্রলোক জানালেন, তাহলে অসুবিধে নেই। আমি উটকো লোককে ভাড়া দেব না। মেয়েটি চাকরি করে। আমার বাড়িতে অল সেপারেট, এক ঘরের ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে চায়। আপনার পরিচিত যখন আপত্তি করব না।

উত্তরবঙ্গের যে কোনো মেয়ে বা ছেলেকে সাহায্য করলে মন ভালো হয়ে যায়। হয়তো নিজে এমন সাহায্য কখনোই পাইনি, তাই। মাসখানেক পরে ভদ্রলোক আবার ফোন করলেন, 'আচ্ছা, সমরেশবাবু, নন্দিতাকে আপনি কতটুকু চেনেন? কারণ জিজ্ঞাসা করলে ভদ্রলোক বললেন, এত বয়ফ্রেন্ড ওর যে, পাড়ার লোকজন কথা বলছে। আপনি কিছু মনে করবেন না, ওকে ঘর ছেড়ে চলে যেতে বলব।

কী উত্তর দেব! শুধু উত্তরবঙ্গের মানুষ, এই পরিচয় তো কোনো মানুষের সম্পূর্ণ পরিচয় হতে পারে না।
৫ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে