মঙ্গলবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৬, ০৩:০৬:০০

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র: ইউনেস্কোর উদ্বেগের জবাব দিচ্ছে সরকার

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র: ইউনেস্কোর উদ্বেগের জবাব দিচ্ছে সরকার

হাসনাইন ইমতিয়াজ: রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের পরিবেশ (বায়ু ও পানি) দূষণের আশঙ্কা নেই। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনেস্কোর উদ্বেগের জবাবে এ কথা বলেছে বাংলাদেশ সরকার। ইউনেস্কোর প্রতিবেদন প্রকাশের পর পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এর জবাব তৈরি করে। এতে আরও বলা হয়েছে, ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে অনেক তথ্যগত ভুলভ্রান্তি রয়েছে। সর্বাধুনিক আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে এবং বিশ্বব্যাংক ও এর গ্রুপ প্রতিষ্ঠান আইএফসির পরিবেশগত গাইডলাইন শতভাগ মেনে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে। তাই সুন্দরবন নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া কারণ নেই। এতে বলা হয়েছে, ভারতের গঙ্গা নদী থেকে চুক্তি অনুযায়ীই পানি পাওয়া যাচ্ছে, যা সুন্দরবন এলাকার লবণাক্ততা কমাতে সাহায্য করছে।

জবাবটি আজ মঙ্গলবার ইউনেস্কোর কাছে পাঠানো হতে পারে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তবে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, জবাব রোববার রাতেই পাঠানো হয়েছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই সুন্দরবনের পাশে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে। যার পক্ষে-বিপক্ষে দেশ-বিদেশে প্রচুর সমালোচনা-আলোচনা চলছে।

বন ও পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের কার্যক্রমের সঙ্গে ইউনেস্কোর প্রতিবেদনের তথ্যগত পার্থক্য রয়েছে। জবাবে এ বিষয়টি জানানো হচ্ছে। কারণ সরকার পরিবেশের বিষয়টি সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন। দূষণের সব বিষয় মাথায় রেখেই রামপাল কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ আশা করছেন, সরকারের এই জবাব পাওয়ার পর ইউনেস্কোর ভ্রান্ত ধারণা দূর হবে। তারা রামপাল বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করবে।

গত আগস্টে সরকারের কাছে পাঠানো ৩০ পাতার এক প্রতিবেদনে ইউনেস্কো জানায়, রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হলে হুমকিতে পড়বে সুন্দরবন। সরকারকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে অবিলম্বে এ কেন্দ্রের নির্মাণকাজ বন্ধ করে প্রকল্পটি অনত্র সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেয় ইউনেস্কো। গত ২২ থেকে ২৮ মার্চ বাংলাদেশ সফরকালে সুন্দরবন ও তদসংলগ্ন এলাকা ঘুরে দেখে এবং সরকার, কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি পাঠায় ইউনেস্কো। এ বিষয়ে ১১ অক্টোবরের মধ্যে সরকারের জবাব জানতে চেয়েছিল সংস্থাটি।

বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের এক কর্মকর্তা জানান, ইউনেস্কো তাদের প্রতিবেদনের বিষয়ে বাংলাদেশের বক্তব্য জানাতে বলেছিল। সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি প্রতিবেদনটির জবাব তৈরি করে। সেখানে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে পরিবেশ দূষণ কমাতে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তা তুলে ধরা হয়েছে।

জাহাজ চলাচল: বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কয়লা পরিবহন নিয়ে ইউনেস্কো আশঙ্কা জানিয়ে বলেছিল, এখানে জাহাজের চলাচল বেড়ে যাবে। এতে সুন্দরবনের পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হবে। সরকারের তরফ থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের পশুর নদীর নৌরুটি মংলা বন্দর ব্যবহার করছে। একই নৌরুটে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আনা হবে। এতে বর্তমানের তুলনায় জাহাজের পরিবহন মাত্র ২ শতাংশ বাড়বে।

পানি শুদ্ধকরণ: জবাবে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ক্লোজ সাইকেল পানি ঠাণ্ডাকরণ পদ্ধতি ব্যবহৃত হবে। এজন্য কোনো গরম পানি উন্মুক্ত জলাশয়ে ছাড়া হবে না। ফলে আশপাশের জলজ পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না। এখানে খুব উন্নতমানের পরিশোধনাগার নির্মাণ করা হবে। যেখানে তেল ও অন্যান্য বিষাক্ত বর্জ্য পৃথকীকরণের জৈবিক, রাসায়নিক ও যান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যবহৃত হবে। পরিশোধিত পানির বড় অংশই আবার ব্যবহার করা হবে। ফলে পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা থাকবে না।

বায়ু দূষণ রোধ: সর্বাধুনিক প্রযুক্তির হওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৯৯ দশমিক ৯ ভাগ ছাই ধরা হবে, যা বাতাসে ছড়াতে পারবে না। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই বাতাসে ছড়িয়ে যে পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। সংগৃহীত ছাই সিমেন্ট কারখানা ও সিরামিক কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হবে। ছাই সংরক্ষণের জন্য ২৫ একর সংরক্ষণাগার নির্মাণ করা হবে। সালফার ডাইঅক্সাইড (সক্স) এবং নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড (নক্স) বাতাসে ছড়ানোর বিষয়ে ইউনেস্কোর উদ্বেগের জবাবে সরকারের বলেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে অ্যাডভান্সড লো নক্স বার্নার প্রযুক্তি যুক্ত করা হবে। এতে করে বাতাসে নক্স ছড়ানোর মাত্রা বিশ্বব্যাংক এবং আইএফসির গাইড লাইনের মধ্যেই থাকবে। আরও জানানো হয়েছে, কেন্দ্রটিতে ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজার ইউনিট (এফজিডি) ব্যবহার করা হবে, যা অতিমাত্রায় কর্মদক্ষ হওয়ায় সক্স ধরে ফেলবে, বাতাসে ছড়াতে দেবে না।

বলা হয়েছে, বাতাসের বার্ষিক প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এ এলাকায় বছরের বেশিরভাগ সময় বায়ু দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়। শুধু নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাতাস উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। ফলে বায়ুপ্রবাহ সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না; বরং এটা বনের জন্য একটি প্রাকৃতিক রক্ষা কবচ হিসেবে কাজ করবে। কারণ প্রকল্প স্থানটি সুন্দরবন থেকে উত্তরে অবস্থিত।

গঙ্গা থেকে পর্যাপ্ত পানি: ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে গঙ্গার পানিপ্রবাহ কমে গিয়ে সুন্দরবন এলাকার লবণাক্ততা বেড়ে গেছে বলে ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। সুন্দরবন এলাকায় মিঠা পানির প্রবাহ বাড়ানোর জন্য ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি যাতে পুরোপুরি মানা হয়, তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিল ইউনেস্কো। জবাবে সরকার জানিয়েছে, বাংলাদেশ গঙ্গা চুক্তি অনুসারে পুরো পানি পাচ্ছে, যা সুন্দরবন এলাকার লবণাক্ততা কমাতে সাহায্য করছে। একই সঙ্গে এলাকার ভূ-উপরিস্থিত ও ভূগর্ভস্থ পানির গুণাবলিও রক্ষিত হচ্ছে।-সমকাল
১১ অক্টোবর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে