গোলাম মওলা : ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ব্যাংকিং ব্যবসা করে যাচ্ছে জুবিলী ব্যাংক লিমিটেড। দেশের সবচেয়ে পুরনো এই ব্যাংকটিতে শেয়ার রয়েছে বঙ্গবন্ধুর তিন খুনির। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল (অব.) ফারুক ও কর্নেল (অব.) রশীদের নামে রয়েছে ৮৫ হাজার শেয়ার। এছাড়া, মেজর (অব.) বজলুল হুদার নামেও বেশ কিছু শেয়ার রয়েছে। জুবিলী ব্যাংকের কোনও শাখা নেই। কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার জানিপুরে একটি মাত্র কার্যালয়ে কার্যক্রম চলছে এ ব্যাংকের। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সরকারের যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের পরিদফতর (আরজেএসসি) এর তথ্য অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধুর তিন খুনি জুবিলী ব্যাংকের মালিকানায় ছিলেন। তবে দীর্ঘদিন এ তথ্য গোপন করেছে জুবিলী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে এ বিষয়ে ব্যাপক খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী জুবিলী ব্যাংকের বিষয়ে খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘যদি অসৎ উদ্দেশ্যে তথ্য গোপন করা হয়, তাহলে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে বড় ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।’
নিয়ম অনুযায়ী, সরকারের যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের পরিদফতর (আরজেএসসি)কে শেয়ার ধারণের তথ্য জানানোর কথা থাকলেও ব্যাংকের পক্ষ থেকে তা করা হয়নি। এমনকি কর্নেল (অব.) ফারুক ও কর্নেল (অব.) আব্দুর রশিদের নামে কী পরিমাণ শেয়ার ছিল, তার তথ্যও আরজেএসসিতে জমা দেওয়া হয়নি। যদিও কর্নেল (অব.) ফারুক ও কর্নেল (অব.) আব্দুর রশিদের নামে থাকা ৮৫ হাজার শেয়ার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে আরজেএসসি।
এছাড়া, বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি মেজর (অব.) বজলুল হুদা দুবছর ব্যাংকটির পরিচালক ছিলেন। সে তথ্যও গোপন করা হয়েছে। ব্যাংকটির ১৯৯২ সালের বিবরণীতে তাকে আর পরিচালক উল্লেখ করা হয়নি। তার শেয়ারের বিষয়েও সরকারকে কোনও তথ্য দেয়নি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
এ প্রসঙ্গে জুবিলী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার এমবিআই মুন্সী রবিবার বলেন, ‘একটি গ্রুপ আছে যারা অনেকদিন ধরেই ব্যাংকের ক্ষতি করার জন্য ঝামেলা করছে। বিষয়টি আমরা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘কর্নেল (অব.) খন্দকার আব্দুর রশিদ ও কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান এক সময় এ ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডার ছিলেন। ৩০ থেকে ৪০ বছর আগে থেকেই তাদের শেয়ার ছিল। অবশ্য ব্যাংকের বোর্ড তাদের এই শেয়ার অবৈধ ঘোষণা করেছে। এর ফলে তাদের শেয়ার কেউ কিনতে পারবে না। বিক্রি করতেও পারবে না। আপাতত এই শেয়ার ব্যাংকের এ্যাসেট হয়ে থাকবে। তবে সরকার ইচ্ছে করলে এই শেয়ার জব্দ করে হস্তান্তর করতে পারবে।’
প্রসঙ্গত, গত জুনে জুবিলী ব্যাংকের এক শেয়ার হোল্ডার অর্থমন্ত্রীর কাছে চিঠি দেন। ওই চিঠিতে বলা হয়, জুবিলী ব্যাংকে বঙ্গবন্ধুর দুই খুনির বিপুল পরিমাণ শেয়ার রয়েছে।এ থেকে প্রতি মাসে বড় অঙ্কের মুনাফা পাচ্ছে তাদের পরিবার। যা দেশবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রমে এবং জঙ্গি অর্থায়নে ব্যবহৃত হচ্ছে। এরপর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। এরই অংশ হিসাবে জুবিলী ব্যাংকে থাকা দুই খুনির শেয়ার বাজেয়াপ্ত করার জন্য গত ২৯ জুন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) চিঠি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। এটি পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত না থাকায় বাজেয়াপ্ত করার বিষয়ে অপারগতা জানিয়ে গত ২৬ জুলাই মন্ত্রণালয়কে ফিরতি চিঠি দেয় বিএসইসি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, এরপর ব্যাংকটিতে থাকা বঙ্গবন্ধুর দুই খুনির শেয়ার বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে বলা হয়। পাশাপাশি আরজেএসসিকেও এসংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরই প্রেক্ষিতে আরজেএসসি ১৯৯০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জুবিলী ব্যাংকের বার্ষিক মূলধন বিবরণী যাচাই করে দেখেছে যে, ব্যাংকটিতে বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজর (অব.) বজলুল হুদারও শেয়ার রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আরজেএসসির নিবন্ধক মো. আতিকুর রহমান বলেন, ‘জুবিলী ব্যাংকের বিষয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে যাবতীয় তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। সে অনুযায়ী প্রতিবেদন তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শেয়ার বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়া নিয়ে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে।’
জানা গেছে, ১৯৯১ সালের বার্ষিক মূলধনের বিপরীতে মেজর (অব.) বজলুল হুদাকে জুবিলী ব্যাংকের পরিচালক দেখানো হয়। কিন্তু সে সময় তার কী পরিমাণ শেয়ার ছিল তা উল্লেখ নেই। ১৯৯১ সালের ২৩ জানুয়ারি জুবিলী ব্যাংকের দাখিল করা ১৯৯০ সালের বার্ষিক মূলধন বিবরণী অনুযায়ী, ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন ছিল ১০ কোটি টাকা। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর দুই খুনি কর্নেল (অব.) ফারুক ও কর্নেল (অব.) আব্দুর রশিদ পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।
জানা গেছে, ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স নেয় ব্যাংকটি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৭০ বছর এটি সমবায় ব্যাংক হিসেবে পরিচালিত হতো।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নন সিডিউল ব্যাংক হিসাবে এক সময় এই প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যাংকিং করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার আগেও দীর্ঘ পুরনো এই প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংকিং করতো।
তিনি বলেন, যখন ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করার অনুমতি দেওয়া হয়, তার আগে এটি হিসেবে ছিল সমবায় ব্যাংক।
ব্যাংকটির বর্তমানে আমানতকারী দুই হাজার এবং ঋণ নিয়েছে ৭০০ জন। ১৯৮২ সাল থেকে খুলনায় ব্যাংকটির আরেকটি শাখা থাকলেও ২০০০ সালে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। মূলত জমি এবং স্বর্ণ বন্ধকের মাধ্যমে ঋণ দিয়ে থাকে ব্যাংকটি।
জানা গেছে, জুবিলী ব্যাংক ১৯১৩ সালের ১৫ এপ্রিল ‘খোকসা জানিপুর জুবিলী ব্যাংক লিমিটেড’ নামে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধ বা আরজেএসসিতে নিবন্ধিত হয়। নিবন্ধন নম্বর- সি-২৩৭৩। ১৯৮৭ সালের ২৬ জানুয়ারি নাম পরিবর্তন করে ‘জুবিলী ব্যাংক লিমিটেড’ নামে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে।
জানা গেছে, ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে যখন লাইসেন্স নেয়, তখন মিয়া আবদুর রশীদ নামে এক ব্যক্তি এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সে সময় তার হাতে ব্যাংকের শেয়ার ছিল ৫১ শতাংশ। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনিই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন। পরে ব্যারিস্টার এমবিআই মুন্সী ২০০২ সালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ২০০৮ সালে তিনি আবারও এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান পুনর্নির্বাচিত হন। বর্তমানেও তিনিই ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। -বাংলা ট্রিবিউন।
১১ অক্টোবর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম