ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল : ৩০ আগস্ট দিনটি যে অন্য রকম একটি দিন হবে সেদিন সকালবেলা আমি সেটি একেবারেই অনুমান করতে পারিনি। ভাইস চ্যান্সেলরকে সরিয়ে দেওয়ার জন্যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা প্রায় চার মাস ধরে আন্দোলন করছেন। খুবই নিরামিষ ধরনের আন্দোলন, নিজেদের পদ থেকে পদত্যাগ করে সিঁড়ির ওপর তারা চুপচাপ বসে থাকেন।
এই দেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বার ভাইস চ্যান্সেলরকে সরিয়ে দেওয়ার আন্দোলন হয়েছে। খুব দ্রুত ফল পাবার জন্যে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়া হয়, ভাইস চ্যান্সেলরের বাসার পানি-ইলেকট্রিসিটির লাইন কেটে দেওয়া হয় এবং তাঁকে ঘরের ভেতর আটকে রেখে দেওয়া হয়। বিষয়টা অমানবিক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম একটা ঘটনার সমালোচনা করে আমি একটা লেখা লিখেছিলাম বলে আমাকে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষকদের অনেক গালমন্দ শুনতে হয়েছিল।
যাই হোক, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তার মাঝে গেলেন না। ভাইস চ্যান্সেলের কথা দিয়েছেন দুই মাস পরে নিজে থেকে চলে যাবেন, সেটা বিশ্বাস করে অপেক্ষা করতে থাকলেন এবং দুই মাস পর আবিস্কার করলেন, ‘কেউ কথা রাখে না’! কাজেই তারা প্রতিবাদ করে সিঁড়ির ওপর বসে থাকেন এবং মাঝে মাঝে গরম বক্তৃতা দেন।
৩০ আগস্ট সিঁড়ির ওপর বসে থাকতে গিয়ে তারা আবিস্কার করলেন, সেখানে প্রায় ভোররাত থেকে ছাত্রলীগের ছেলেরা বসে আছে। শিক্ষক হয়ে তারা তো আর ছাত্রদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করতে পারেন না। তাই ব্যানারটা হাতে নিয়ে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে রইলেন। ভোরবেলা যেহেতু অন্য শিক্ষকেরা আসতে পারবেন না, তাই কী হয় দেখার জন্য আমি তাদের সঙ্গে গিয়ে ফ্ল্যাগ পোস্টের বেদিতে বসে রইলাম।
ছাত্রলীগের ছেলেরা স্লোগান দিতে লাগল, ‘জয় বাংলা’। স্লোগানটা শুনতে আমার ভালোই লাগে। কিন্তু ভাইস চ্যান্সেলরের কিছু হলে তারা কীভাবে আগুন জ্বালিয়ে দেবে কিংবা আন্দোলনরত শিক্ষকদের জামায়াতের দালাল বলে গালি দিয়ে কীভাবে তাদের হুঁশিয়ার করে দেওয়া হবে সেই স্লোগানগুলো শুনে আমি একটু অস্বস্তি অনুভব করছিলাম। তবে আমি কোনো দুশ্চিন্তা অনুভব করিনি, কারণ প্রচুর পুলিশ আছে। তার চাইতেও বড় কথা, প্রক্টর আছেন, ছাত্র কল্যাণ উপদেষ্টা আছেন, ভাইস চ্যান্সেলরের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন সে রকম সব বড় বড় শিক্ষকেরা আছেন। এত জন সব গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকদের সামনে ছাত্রলীগের ছেলেরা নিশ্চয়ই আর যাই করুক, শিক্ষকদের উপর হামলা করবে না।
আমি মোটামুটি নিশ্চিন্ত মনে বেদির উপর বসে একটা কাগজ বের করে চিঠি লিখতে বসেছি। অনেক দিন ধরে পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম আমাদের শিক্ষামন্ত্রীকে একটা ব্যক্তিগত চিঠি লিখব। সেখানে তাকে বলব, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা মেটানোর জন্যে তিনি যে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেছেন, সেই কাজটা ঠিক হয়নি। একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেদিন থেকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের কথা শুনে পরিচালনা করা শুরু হয়, মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সেইদিন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির মৃত্যু ঘটে যায়।
আমি যখন চিঠির আধাআধি লিখেছি, তখন হঠাৎ করে ছাত্রলীগের ছেলেদের মাঝে এক ধরনের উত্তেজনা লক্ষ্য করলাম। উত্তেজনার কারণটা বোঝার জন্য আমি রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি, ভাইস চ্যান্সেলরের গাড়ি থেমেছে, তিনি গাড়ি থেকে বের হলেন। আন্দোলনরত শিক্ষকেরা ব্যানার হাতে পথ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের সাথে কথা বলার কোনো চেষ্টা না করে তিনি পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলেন। তার চারপাশে অসংখ্য ছাত্রলীগের কর্মী। তারা রীতিমতো কমান্ডো স্টাইলে অল্প কয়জন শিক্ষকদের উড়িয়ে দিয়ে ভাইস চ্যান্সেলরকে বিল্ডিংয়ের ভেতর নিয়ে গেল। এক ধরনের হুটোপুটি হইচই চেঁচামেচি। কী হচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, ছাত্র কল্যাণ উপদেষ্টা এবং অন্য সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে পুরো ব্যাপারটি ঘটতে দিলেন। অল্প কয়জন বয়স্ক শিক্ষক, তার মাঝে মহিলাও আছেন, তাদের হামলা করেছে অসংখ্য কমবয়সী তরুণ। পুলিশ ছোটাছুটি করছে, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই তাদের উপর আদেশ দেওয়া আছে ছাত্রলীগকে তাদের কমান্ডো মিশন সফল করতে দিতে। তারা সেটা করতে দিলেন।
আমি পাথরের মতো বসে থেকে পুরো ব্যাপারটি দেখলাম। কোনো সাংবাদিক বা টেলিভিশন ক্যামেরা নেই, ছাত্রলীগের ছেলেরা সেই সুযোগটি গ্রহণ করল। তারা এবারে শিক্ষকদের হাত থেকে ব্যানারটি কেড়ে নিতে তাদের উপর হামলা করল। অল্প কয়জন বয়স্ক শিক্ষক, অসংখ্য তেজী ছাত্রলীগের সাথে কেমন করে পারবে? তারা শিক্ষকদের নাস্তানাবুদ করে ব্যানার কেড়ে নিতে তাদের উপর হামলা করল। আমার কাছে মনে হল, আমি একটি সুররিয়াল দৃশ্য দেখছি। এর মাঝে কোনটি বাস্তব কোনটি পরাবাস্তব এবং কোনটি অবাস্তব, আমি আলাদা করতে পারছি না।
দীর্ঘ সময় ছাত্রলীগের কর্মীরা শিক্ষকদের উপর হামলা করে গেল এবং বলা যায় আমি তখন আমার জীবনের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্যটি দেখতে পেলাম। ছাত্রদের হাতে শিক্ষকদের নিগৃহীত হওয়ার দৃশ্যটি নিশ্চয়ই অত্যন্ত চমকপ্রদ। কারণ প্রক্টর, ছাত্র কল্যাণ উপদেষ্টা এবং অন্যান্য শিক্ষকেরা একবারও ছাত্রদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেন না। আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে দেখলাম, মানুষ যেভাবে সার্কাস দেখে তারা সবাই ঘুরে ঘুরে সেই সার্কাসটি দেখে গেলেন।
এই শিক্ষকেরা কেউ কিন্তু আমাদের দূরের মানুষ নন, তারা সবাই আমার খুব কাছের মানুষ। আমরা দীর্ঘদিন পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ করেছি। গণিত অলিম্পিয়াড করতে সারা দেশে ঘুরে বেড়িয়েছি। এক গাড়িতে করে ঢাকা গিয়েছি, ফিরে এসেছি। গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে পড়েছি। জামায়াত-বিএনপির দুঃসহ সময়ে আমরা ‘টুইসডে আড্ডা’র প্রচলন করেছি। সেখানে একসাথে রাজা-উজির মেরেছি। আমাদের আপনজন অসুস্থ হলে তারা হাসপাতালে দিনের পর দিন বসে থেকেছেন। তাদের পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে আমরা তাকে দেখতে গিয়েছি। ছেলেমেয়ের বিয়েতে গিয়েছি।
এখন তারা অনেক দূরের মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তাদের সাথে দেখা হলে তারা না দেখার ভান করে চলে যান। আগে হোক পরে হোক, বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলর একদিন চলে যাবেন, আমরা সব শিক্ষকেরা থাকব। আমাদের ভেতরে যে বিশাল দূরত্ব তৈরি হয়েছে সেই দূরত্ব নিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয় কেমন করে চলবে?
খবর পেয়ে এক সময় সাংবাদিকেরা টেলিভিশন ক্যামেরা নিয়ে আসতে শুরু করলেন। ততক্ষণে যা ঘটার ঘটে গেছে। ছাত্রলীগের ছেলেদের স্লোগান ছাড়া আর কিছু নেই। ক্ষুব্ধ শিক্ষকেরা তাদের ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়ার কথা জানালেন। স্লোগানের কারণে সেগুলোও চাপা পড়ার উপক্রম হল।
আমি তখনও একই জায়গায় বসে আছি। মাঝে মাঝেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি আমার খুব প্রিয়, আমি চুপচাপ সেই বৃষ্টিতে বসে রইলাম। কী করব বুঝতে পারছি না। সাংবাদিকেরা ঘুরেফিরে আমার কাছে এসে আমার বক্তব্য শুনতে চাইলেন। আমি তাদের বললাম, ‘আমার বলার কিছু নেই। আমি শুধু একজন দর্শক। শিক্ষকদের এই আন্দোলনে আমার কোনো ভূমিকা নেই, তাদের জন্যে সহমর্মিতা জানানো ছাড়া আমি কিছু করিনি’। তারপরও সাংবাদিকেরা ঘুরেফিরে আমার কাছে ফিরে এলেন; বললেন, ‘আপনি এখানে বসে থেকে সব দেখেছেন, আপনার কিছু একটা বলতে হবে’।
আমি বাধ্য হয়ে তখন তাদের সাথে কথা বললাম। যতদূর মনে পড়ে শেষ বাক্যটি ছিল এ রকম, ‘আমি আজকে যাদের দেখেছি, তাদের একজনও যদি সত্যি সত্যি আমাদের ছাত্র হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের গলায় দড়ি দেওয়া উচিত’। আমার এই কথাটির কারণে অনেকেই মনে খুব কষ্ট পেয়েছেন। এখন বুঝতে পারছি, এ রকম একটি কঠিন কথা বলা মোটেই ঠিক হয়নি।
সারাটি দিন খুব মন খারাপ ছিল। আমাদের নিজেদের ছাত্ররা তাদের শিক্ষকের উপর এভাবে হামলা করবে এটি আমি নিজের চোখে না দেখলে কখনও বিশ্বাস করতাম না। নিজেকে সান্তনা দিয়ে বোঝালাম, এই হৃদয়বিদারক ঘটনার হয়তো একটা ভালো দিক আছে। আন্দোলন করা শিক্ষকেরা যে বিষয়টা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, সেটি এখন নিজে থেকে প্রমাণিত হয়ে গেল। যখন সবাই দেখবে, একজন ভাইস চ্যান্সেলর তার চেয়ারে বসে থাকা নিশ্চিত করতে ছাত্রলীগের মাস্তানদের দিয়ে তাদের শিক্ষকদের উপর হামলা করান, তখন সবাই নিশ্চয়ই আসল ব্যাপারটা বুঝে ফেলবে। সরকার নিশ্চয়ই এ রকম একজন ভাইস চ্যান্সেলরকে দায়িত্বে রাখতে চাইবে না। আন্দোলনরত শিক্ষকরা যেটি চাইছেন, স্বাভাবিকভাবেই সেটি ঘটে যাবে।
মজার ব্যাপার হল, আমি প্রথমে খবর পেলাম ভাইস চ্যান্সেলর হামলাকারী ছাত্রদের ধন্যবাদ জানালেন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্যে। আমার জন্যে আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। খবর পেলাম মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী কোনো একটা সভায় ছাত্রলীগের কর্মীদের আচরণের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করার সাথে সাথে বলেছেন, ‘ভাইস চ্যান্সেলরের উপর শিক্ষকদের হামলা করার কাজটি মোটেও উচিৎ কাজ হয়নি’।
শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এই দেশের একজন শিক্ষামন্ত্রী সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেন যে, অসংখ্য মারমুখো ছাত্রলীগের কর্মীদের মাঝখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বয়স্ক শিক্ষক-শিক্ষিকার পক্ষে ভাইস চ্যান্সেলরের উপর হামলা করা সম্ভব? শিক্ষামন্ত্রীর কথা শুনে আমি হাসব নাকি গলা ছেড়ে কাঁদব বুঝতে পারিনি।
দেশের একজন শিক্ষামন্ত্রী কীভাবে এ রকম আজগুবি একটা বিষয় বিশ্বাস করতে পারেন সেটা অবশ্যি আমি পরদিন ভোরবেলাতেই বুঝতে পেরেছিলাম। অনলাইনে খবরটি নিশ্চয়ই আগেই ছাপা হয়েছে, আমি দেখিনি। সারা দেশের সকল পত্রপত্রিকা যখন ছাত্রলীগের এই হামলার নিন্দা করে খবর ছাপিয়েছে, সকল টিভি চ্যানেল যখন খুব গুরুত্ব দিয়ে খবরটি প্রচার করেছে, তখন ‘প্রথম আলো’ তাদের খবরের শিরোনাম করেছে এভাবে: ‘ছাত্রলীগের হাতে শিক্ষক এবং শিক্ষকের হাতে উপাচার্য লাঞ্ছিত’।
‘প্রথম আলো’ এই দেশের মূলধারার পত্রিকা। এই দেশের মূলধারার অনেক মানুষ এই পত্রিকা পড়েন, তাদের সার্কুলেশন বিশাল। কাজেই ঘটনার পরের দিন বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ জেনে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এতই নিকৃষ্ট শ্রেণির প্রজাতি যে, তারা ভাইস চ্যান্সেলরকে লাঞ্ছনা করতে সংকোচ বোধ করেন না। ‘প্রথম আলো’র ইতিহাসে এই প্রথমবার ছাত্রলীগের দুস্কর্মের বর্ণনা ‘হা বিতং’ করে ছাপা হল না!
মনে আছে, আমি তখন মনে মনে খুব লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম। কারণ সত্যিকারের ঘটনাটি যখন ঘটে তখন সেখানে কোনো সাংবাদিক বা টেলিভিশন ক্যামেরা ছিল না। কাজেই যার যা ইচ্ছে তাই বলতে পারবে আর সেই কথা বিশ্বাস করে যার যা ইচ্ছে তাই লিখে বসে থাকতে পারবে। ঘটনার প্রতিবাদ করে কোনো লাভ নেই। অন্যায় কিছু ঘটলে সংবাদপত্রের মাধ্যমে তার প্রতিবাদ করা হয়। একটা সংবাদপত্র যখন অন্যায় করে তখন হঠাৎ করে তার প্রতিবাদ করার কোনো জায়গা থাকে না।
‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’ বলে একটা কথা আছে। আমি কথাটাকে আগে গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু হঠাৎ করে দেখতে পেলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মের কলটি বাতাসে নড়তে শুরু করেছে! কয়েক বছর আগে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা জায়গায় সিসিটিভি বসিয়েছিলাম। তার ফুটেজ বের করে আমরা হঠাৎ করে সেখানে পুরো ঘটনার একটা ভিডিও পেয়ে গেলাম। সেখানে অন্য অনেক কিছুর সাথে দেখা গেল, ছাত্রলীগের কর্মীরা একজন অধ্যাপকের দুই হাত ধরে রেখেছে এবং স্বয়ং ভাইস চ্যান্সেলর সেই অধ্যাপকের কলার ধরে ধাক্কাধাক্কি করছেন। শুধু তাই নয়, সেই অধ্যাপককে ছাত্রলীগের ছেলেরা আক্ষরিক অর্থে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে এবং আরেকজন শিক্ষক সময়মতো তার মাথাটা ধরে না ফেললে কী হত আমরা এখনও জানি না।
সিসিটিভির সেই ফুটেজ কতজন দেখেছে জানা নেই। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী দেখার সুযোগ পেয়েছেন কিনা কিংবা দেখে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্পর্কে তার মনোভাবের পরিবর্তন করেছেন কিনা আমার জানার কৌতূহল ছিল।
ভাইস চ্যান্সেলর শুরুতে ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তদের ‘সচেতন শিক্ষার্থী’ হিসেবে প্রশংসা করে থাকলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে সরাসরি ‘আগাছা’ হিসেবে উপড়ে ফেলার পরামর্শ দিলেন। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ তিনজনকে বহিস্কার করল। চক্ষুলজ্জার খাতিরে ভাইস চ্যান্সেলরও চারজনকে বহিস্কার করলেন। তারা অবশ্যি নিয়মিত পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। দেশের কাছে অন্তত একটি বিষয় জানানো সম্ভব হল, সত্যি সত্যি ছাত্রলীগের ছেলেরা তাদের শিক্ষকদের উপর হামলা করেছিল।
আমার একটিই প্রশ্ন: কেন করেছিল? মজার ব্যাপার হল, সেটি নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। ছাত্রলীগের ছেলেরা ঘোরতর অন্যায় করেছিল, তাদেরকে শাস্তি দিতে হবে, সেটাই হয়ে গেল মূল বিষয়। শিক্ষকদের এই নিরামিষ ধরনের গান্ধীবাদী আন্দোলনের সাথে আমি সেভাবে যুক্ত ছিলাম না। শুধু একদিন দূর থেকে বসে দেখার চেষ্টা করে সারাজীবনের জন্যে একটা ভয়ংকর অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছি। আমার বাসায় টেলিভিশন নেই, আমি ফেসবুক করি না। কাজেই বিষয়টি নিয়ে কী ধরনের আলোড়ন হয়েছে আমি জানি না। কিন্তু পরের দিন ঢাকা থেকে অনেককেই সিলেটে চলে আসতে দেখে একটু আঁচ করতে পেরেছিলাম।
সাংবাদিকেরা আমার পিছু ছাড়েন না এবং আমি তোতা পাখির মতো শুধু একটা কথাই বলে গেছি: ‘ছাত্রলীগের কর্মীরা যে অন্যায় করেছে, তার থেকে একশ গুণ বেশি অন্যায় করেছে যারা তাদের ব্যবহার করেছে তারা। কাজেই মূল অপরাধীর শাস্তি না দিয়ে শুধুমাত্র ছাত্রলীগের ছেলেদের শাস্তি দিলে প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি দেওয়া হবে না’। আমি মোটামুটি বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলাম, পেছন থেকে গডফাদাররা কী করেছে সেটি নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। সামনাসামনি লাঠিয়াল বাহিনী কী করেছে সেটি নিয়ে সবার একমাত্র মাথাব্যথা!
যাই হোক, এই নিরামিষ আন্দোলনে শিক্ষকরা যেহেতু কখনও ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করেননি, তাই ছাত্রেরা কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, সে কারণে তাদের সেটা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু যখন শিক্ষকরা ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে নিগৃহীত হলেন তারা হঠাৎ করে নড়েচড়ে বসেছে। একজন ছাত্র কখনও তার শিক্ষকের অপমান সহ্য করে না। কাজেই খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা ক্ষুব্ধ হয়ে বের হয়ে এসেছে। তারা কী করবে আমাদের জানা নেই। তাই সামনের দিনগুলোতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কপালে কী আছে আমরা কেউ জানি না।
শুধু একটা বিষয় জানি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা দলের নানা মতের শিক্ষকরা পাশাপাশি থাকতেন, এখন তাদের ভেতর যোজন যোজন দূরত্ব। আমি কখনও এ রকম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখিনি।
২. ৩০ আগস্ট যখন ছাত্রলীগের ছাত্ররা শিক্ষকদের উপর হামলা করেছে, আমি তখন হতবাক হয়ে কাছাকাছি একটা জায়গায় বসেছিলাম। মাঝে মাঝে আঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়েছে, আমি একা একা সেই বৃষ্টিতে বসে থেকেছি। প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে প্রতিবাদ করার সময় আমি একদিন শহীদ মিনারে বসেছিলাম, সেদিনও এভাবে বৃষ্টি হয়েছিল। আমি বৃষ্টি ভালোবাসি, তাই মনে হয় বৃষ্টিও আমাকে ভালোবাসে।
যাই হোক, আমার সেই একাকী বৃষ্টিতে ভিজে ঝড়ো কাক হয়ে থাকার ছবিটি মনে হয় ব্যাপকভাবে প্রচার হয়েছে এবং কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে সবার মনে খুব দাগ কেটেছে। ‘ডেইলি স্টার’ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠাতেও আমার সেই বিপর্যস্ত ভঙ্গিতে বসে থাকার ছবিটি ছাপা হয়েছে এবং সত্যি কথা বলতে কী, সেই ছবি দেখে আমি নিজেও চমকে উঠেছিলাম।
এর পর আমি সারা দেশের অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে সমবেদনার সাড়া পেয়েছি। আমি জানি, আমি অসংখ্য মানুষের চক্ষুশুল, সেটি আমাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করে না। কারণ আমি তাদের বিপরীতে এই দেশের অসংখ্য মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এবং শিশু-কিশোরের ভালোবাসা পেয়েছি। আমি তাদের সবাইকে জানাতে চাই, এই দেশ, দেশের মানুষ নিয়ে আমার ভেতরে কোনো হতাশা নেই। আমি মোটেও হতোদ্যম নই, আমি নিজেকে কখনও পরাজিত একজন মানুষ ভাবি না। আমার সেই বিপর্যস্ত ঝড়ো কাকের ছবি দেখে কেউ যেন ভুল না বুঝে।
বেঁচে থাকতে হলে মাঝে মাঝে ঝড়-ঝাপটা সইতে হয়। কিন্তু সেই ঝড়-ঝাপটার কারণে একজন মানুষ কখনও ভেঙে পড়ে না। কী কারণ জানা নেই, আমি এই দেশের অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। সেই ভালোবাসা আমি কীভাবে তাদের ফিরিয়ে দেব ভেবে কুল পাই না।
আমার মনে হয় না এই বাংলাদেশে আমার চাইতে আশাবাদী কেউ আছে, কিংবা আমার চাইতে আনন্দে কেউ আছে!
লেখক : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি