মনে করেছিলাম জামাই চাকরি করে, এখন দেখি মাস্টারি করে'

মোঃ মহসিন মিয়া: শিক্ষকতা বা তথাকথিত মাস্টারি পৃথিবীর একটি অতি আদি পেশা ৷কেউ এ পেশাটাকে আমাদের দেশে ছোট করে দেখে আবার কেউ বা সম্মানি পেশাও বলে থাকে ৷ যারা প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন তাদের এ কাজটিকে সমাজে মাস্টারি করা হিসেবেই দেখে থাকেন ৷ তবে আমরা যারা শিক্ষকতা করি আমারা পেশাটাকে শুধু চাকরি হিসেবেই দেখছি না আমাদের ঘাঁড়ে জাতির একটি গুরু দায়িত্ব হিসেবেই ভাবছি৷ আবার সমাজের কেউ কেউ বলে থাকেন, যারা কোন চাকরি পায় না তারাই মাস্টারি করে৷

মাস্টরদের বেতন কম এ কথাটা Naturally-ই সবাই জানে৷ এটি কেউ জানতে বা শিখতে হয় না৷ আসলে বেতন কম না; অন্যান্য চাকরিজীবীদের মতো শিক্ষকদেরকে যে বাড়ি ভাড়া,মেডিক্যাল ভাতা, ইনক্রিমেন্ট ও অন্যান্য ভাতা দেয়া হয় না; তাই এ পেশার লোকদের বেতন কম বলেই সবাই জেনে থাকেন৷ আমি শহর থাক দূরের কথা উপজেলা সদরেই বাসার কথা কোনদিন ঘুমিয়েও স্বপ্ন দেখি না ৷তাই একটি জুট মিলের পাশেই গ্রামের একটি বাড়িতে বাসা নিয়ে থাকি ৷ একদিন সন্ধ্যায় মিলের তথা কথিত দুই জন অফিসারদের সাথে আলাপ চলছিল৷ তখন  তারা তাদের ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার খোজ খবর নিচ্ছিল ৷ তাদের সাথে ছিল ঐ মিলেরই একজন গাড়ি চালক ৷ এক পর্যায়ে চাকরির বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা, অসুবিধা ও চাকরির অবস্থানের আলাপ এসে পড়লো ৷ কথার এক পর্যায়ে গাড়ি চালক বলে উঠলো , ” মাস্টারগো তো বেতন কম ৷ এ টাকা দিয়ে তারা চলে কিভাবে?” আমি ভাবলাম গাড়ি চালকের মুখেই শিক্ষকদের বেতন সম্পর্কে এ মন্তব্য তাহলে তার অফিসারদের মুখে যেন কি মন্তব্য থাকতে পারে! তাই, আমি তো আলাপ বন্ধ করে নিজেকে খুব ব্যস্তভাব দেখিয়ে স্থানটি দ্রুত ত্যাগ করলাম ৷

যদি শিক্ষকদের সকল সুযোগ সুবিধা শিক্ষকদেরকে দেয়া হতো বা স্কুলগুলো যতি জাতীকরন করা হতো,তাহলে কি এ সকল অপমানজনক মন্তব্য কারো মুখ দিয়ে আসতো? আমার সহকর্মি শিক্ষক একদিন তাদের গ্রামের একটি মাহফিলে দাওয়াত করলে আমি উৎসাহ নিয়েই তার সাথে গেলাম৷ রাতভর মাহফিল শোনলাম ৷পরের দিন সকালে তিনি আমাকে তাদের গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন ৷ হঠাৎ তার বাড়ির শহর থেকে আসা এক চাচি  অনেকদিন পর দেখে তাকে ডাকলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন,” কেমন আছো ? এখন কী করছো ?” তিনি উত্তর দিলেন, ”আমি একটি হাই স্কুলে আছি ৷” শুনে তার চাচি তাকে বললেন, ”মাস্টারি করছো! কোন চাকরি বাকরি ব্যবস্থা করতে পারলা না?” দেখুন মাস্টারির প্রতি সমাজের কি ধারনা ৷ যদি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো শিক্ষকতাকে সরকার সম্মানজনকভাবে মূল্যায়ণ করতো তাহলে হয়ত ওনার চাচি ওনাকে অভিনন্দন জানাতো!

ঐ স্যারের চাচাতো ভাই এইচএসসি পাশ করার পরে সৌদি চলে যায় ৷১০ বছর পরে সৌদি থেকে এসে হঠাৎ আমার সাথে বাজারে দেখা হলো ৷ সে অনেক টাকা অর্জন করেছে ৷ বাড়িতে অনেক সুন্দর করে বাড়ি বানিয়েছে জায়গা জমি কিনেছে এবং আমার সাথে এ গল্প করতে করতে ঐ শিক্ষকের নাম ধরে বলল, ” ভাইয়ে ১২ বছর ধরে মাস্টারি করতেছে, কিছুই করতে পারে নাই, হেরে কতবার কইলাম একটা ভিসা পাঠাই, কোন কথা হোনল না, এখন পোলাপাইন নিয়া টানাটানির মধ্যে চলে ৷”

আরেকটি গল্প মনে পড়ে গেল ৷ এক শিক্ষক বিয়ের পড়ে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে সকালে স্কুলে আসার জন্য খুব তাড়াহুড়া করতেছিল ৷ তার স্ত্রীকে তার শ্বাশুরি জামাইর তাড়াহুড়া করার কারন জিজ্ঞাসা করল৷ স্ত্রী বলল যে, তার স্বামির স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষার চলছে ৷ শ্বাশুরি তো এ কথা শুনে হতবাক ৷ তিনি আর কথা বলছিলেন না ৷
ঐ শিক্ষক শ্বশুর বাড়ি ত্যাগ করাতে না করতেই দৌড়ে তার শ্বাশুরি শ্বশুকে বলল, ”তুমি না বলেছিলা জামাইয়ে চাকরি করে, এখনদি শোনলাম মাস্টারি করে!”এর মানে কী? শিক্ষকতা করে এ কথাটা শোনলে মানুষ অবাক ও মুখ থেতলে মন্তব্য করে কেন? কোন সরকারি স্কুলে শিক্ষক হলে তো এরকম করে না ? আমাদের অপরাধ কী? আমরা কি কম পরিশ্রম করি? আমাদের স্কুলের ফলাফল কি ভাল হয় না নাকি আমরা কারো করুনায় পেশাটা গ্রহণ করেছি? আমাদের বাড়ি ভাড়া নামে মাত্র দেয়া হয় কেন? সবাই বৈশাখি ভাতা পেল আমরা পেলাম না কেন? ঈদ বোনাস সকল সরকারি চাকুরেরা শতভাগ পায় আমরা কেন ২৫% দেয়া হয়? বাজারে কি আমাদের জন্য আলাদা জামা কাপড় বিক্রি হয় যেগুলো শিক্ষক হলে ৭৫% ছাড়? আমাদের জন্য কি সরকার আলাদা বাড়ির ব্যবস্থা রেখেছে যেখানে ১০০০ টাকায়ই থাকা যায় ? বিদ্যুৎ বিল ও গ্যাস বিল কি শিক্ষকেরা দেয়া লাগে না? সরকারি চাকুরেরা শিক্ষা ভাতা পাবে আর আমাদের ছেলে মেয়েরা কি মুর্খ থাকবে?তাহলে কেন বাড়ি ভাড়া, অন্যান্য ভাতা ও ইনক্রিমন্ট আমাদেরকে দেয়া হবে না? উক্ত প্রশ্নগুলো সর্বদাই সকল শিক্ষকদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়ে মনের ভিতরই ঘুরপাক খায় ৷ কখন যেন সেগুলো ঘুর্ণিঝড়ে পরিনত হয় তা বলা যাচ্ছে না৷

পরিশেষে বলতে চাই, মাননীয় প্রধান মন্ত্রী, আপনিই ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে এক যোগে জাতীয়করন করে মহানুভবতা ও উদারতার পরিচয় দিয়েছেন ৷ আপনি জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা ৷ শিক্ষকদের  প্রতি সহানুভুতিশীলতা আপনারই খাটে ৷ তাই আর কালক্ষেপন না করে সকল মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকে একযোগে জাতীয়করন করে বাংলাদেশে আরেকটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করার জন্য শিক্ষক সমাজ আপনার দিকে অধির আগ্রহে তাকিয়ে আছে৷-শিক্ষা বার্তা
১৪ অক্টোবর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর