নিউজ ডেস্ক: তিন দশকের মধ্যে চীনের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে পৌঁছেছেন শি জিনপিং। দুই দেশই আশা করছে, চীনা প্রেসিডেন্টের এই সফর ঢাকা-বেইজিং অর্থনৈতিক সম্পর্কের ‘নতুন দিগন্ত উন্মোচন’করবে।
শি জিনপিংকে বহনকারী এয়ার চায়নার স্পেশাল ভিভিআইপি ফ্লাইট ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায় শুক্রবার বেলা ১১টা ৩৬ মিনিটে। ১২টা ৩ মিনিটে বিমান থেকে নেমে এলে তাকে স্বাগত জানান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি চীনের প্রেসিডেন্টের উড়োজাহাজটি বাংলাদেশের আকাশ সীমায় ঢোকার পর তাকে পাহারা দিয়ে বিমানবন্দরে নিয়ে আসে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর চারটি জেট ফাইটার।
অবতরণের পর রাষ্ট্রীয় এই অতিথিকে ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে স্বাগত জানানো হয়। দুটি শিশু ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়ার পর লাল গালিচায় হেঁটে তিনি সংবর্ধনা মঞ্চে পৌঁছান।
সামরিক বাহিনীর সুসজ্জিত একটি দল এ সময় চীনের প্রেসিডেন্টকে গার্ড অফ অনার দেয়। বাজানো হয় দুই দেশের জাতীয় সংগীত।
চীনা প্রেসিডেন্টের আগমন উপলক্ষে বিমানবন্দরের ভিভিআইপি টার্মিনাল দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের ছবি দিয়ে সাজানো হয়। বিমানবন্দর ও হোটেল লো মেরিডিয়ানের পথে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা ব্যানারে দেখা যায় সম্ভাষণ- ‘স্বাগতম হে মহামান্য অতিথি’।
‘ওয়ান-বেল্ট, ওয়ান রোড’ নীতি ধরে এগিয়ে যাওয়া চীনের সহযোগিতা সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে শি জিনপিং য়ের এই ঢাকা সফর। ১৯৮৬ সালে লিশিয়ানইয়ানের পর বাংলাদেশে আসা প্রথম চীনা রাষ্ট্রপ্রধান তিনি।
আর এমন এক সময় তিনি ঢাকা এলেন, যখন বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের কাতার থেকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য শিল্পায়ন আর বিনিয়োগের জন্য মুখিয়ে আছে।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের রাষ্ট্রপ্রধানের এ সফরকে সম্পর্কের ‘নতুন যুগের সূচনা’ বলছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শি জিনপিংও দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার আশার কথা বলেছেন।
এই সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে অন্তত ২৫টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হবে বলে বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে সহযোগিতামূলক চুক্তি ও সমঝোতার আওতায় চীনের কাছ থেকে ২০ থেকে ২৫ বিলিয়ন ডলারের সহায়তার আশা করছেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা।
বেইজিংয়ের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে’ যোগ দেওয়ার পাশাপাশি গত কয়েক বছরে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও গাঢ় করেছে ঢাকা, যাকে বাংলাদেশের পূর্বমুখিতাও বলা হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানানো চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের দিকে ওয়াশিংটনের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার প্রভাবশালী রাষ্ট্র ভারতের নজর থাকবে।
এই সফরে চীনা প্রধানমন্ত্রী উঠবেন বিমানবন্দর সড়কের লো মেরিডিয়ান হোটেলে। তার চলাচলের জন্য ২৪ ঘণ্টা ওই সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করবে পুলিশ।
১৩ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে ঢা এসেছেন শি, যে দলে ক্ষমতানীন কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা ছাড়াও কয়েকজন মন্ত্রী রয়েছেন।
হোটেল থেকে বেলা ৩টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যাবেন চীনের প্রেসিডেন্ট। সেখানে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর দুই নেতার উপস্থিতিতে সই হবে চুক্তিগুলো।
এরপর চীনা প্রেসিডেন্ট হোটেলে ফিরলে সেখানে তার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হবেন দুই রাষ্ট্রপ্রধান মো. আবদুল হামিদ ও শি জিনপিং। সফররত প্রেসিডেন্টের সম্মানে নৈশভোজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি।
বেইজিংয়ের ‘এক চীন নীতি’তে সমর্থন দিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ এখন চীনের হাত ধরে অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাতে চায়।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির চীনের প্রেসিডেন্টের এই সফরকে নানা কারণেই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চীনের প্রেসিডেন্ট যে ‘ওয়ান-বেল্ট, ওয়ান রোড’ নীতি নিয়েছেন, তাতে তাদের অংশীদার দরকার।
“বাংলাদেশ দুটি কারণে অংশীদার হতে পারে। একদিকে বাংলাদেশের আরও চীনা বিনিয়োগ কিংবা পণ্য নেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে। অন্যদিকে তাদের রয়েছে উদ্বৃত্ত, প্রয়োজন বিনিয়োগের নতুন স্থান, পণ্যের নতুন বাজার।”
দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ হাজার ডলারে পৌঁছালেও ব্যবধান এখনও দুস্তর। বছরে সাড়ে নয়শ কোটি ডলারের পণ্য আমদানির বিপরীতে চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি আশি কোটি ডলারের মত।
ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশ চীনের কৌশলগত মিত্র হতে পারে বলেও মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন।
তিন দশক পর চীনের কোনো প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরে আসার দিকটি তুলে ধরে তিনি বলেন, তারা এখন বাংলাদেশের প্রতি মনোযোগ দিতে চাচ্ছে। এই সফর সেই সম্পর্ক বিনির্মাণের সুযোগ হতে পারে ঢাকার জন্য।
অন্যদিকে ভূ-রাজনৈতিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্র বন্দরে নির্মাণের কাজ পেতে চায় চীন, যা নিয়ে আগ্রহ ভারতসহ অন্য কয়েকটি দেশেরও।
তবে শির এই সফরে এই সমুদ্র বন্দর আলোচ্যসূচিতে নেই। ২০১০ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে সফরে এসে ওই সমুদ্র বন্দরে নিজ দেশের আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন তিনি।
এরপর নানাভাবে সোনাদিয়া নিয়ে আগ্রহের কথা এসেছে চীনের কাছ থেকে; সেই সঙ্গে এটাও বলা হয়েছে যে এর সঙ্গে সামরিক কোনো অভিপ্রায় নেই। তবে বাংলাদেশ এখনও সমুদ্র বন্দরটি নিয়ে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেনি।
ভূ-রাজনীতিতে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চিহ্নিত চীনের প্রেসিডেন্টের এই সফর নিয়ে দেশটির সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমসের এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, তা ভারতের ‘দক্ষিণ এশিয়া কৌশল’ পুনর্মূল্যায়নে নয়া দিল্লির উপর চাপ তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশ ও চীনের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক নিয়ে ভারতের ঈর্ষান্বিত হওয়ার কিছু নেই বলেও মন্তব্য করে সংবাদপত্রটি।
তবে চীনের সংবাদপত্রটির সঙ্গে একমত পোষণ করেন না বলে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী।
ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু গৃহীত পররাষ্ট্র নীতিই অনুসরণ করছে বর্তমান সরকার। সেটা হল- ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’।
বাংলাদেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে চীনের সঙ্গে সব ক্ষেত্রে সম্পর্কের সম্ভাবনাগুলো খুলতে সরকারের নীতির ধারাবাহিকতায়ই শি জিনপিংয়ের এই সফর বলে তিনি মন্তব্য করেন।
শনিবার সকালে সাভারে স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন চীনের প্রেসিডেন্ট। এর পরপরই ঢাকা ছেড়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা হবেন তিনি।-বিডি নিউজ
১৪ অক্টোবর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/হাবিব/এইচআর